সমাজ যেভাবে দেখে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানকে

শাহরিয়া দিনা:

ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া জয়িতা স্কুল থেকে বের হলো গম্ভীর মুখে। মা জিজ্ঞেস করে,
-মন খারাপ কেন? মিস বকা দিয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?
সে নিরুত্তর। রিক্সায় পাশাপাশি বসে আছে। মেয়েটা ইদানিং গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন তেমন কোনো কথাই বললো না। রাতে মায়ের পাশে শুয়ে বললো,
– আজকে আমার সায়েন্স মিসের কথা শুনে অনেক রাগ লাগছে।
– কেন কী বলেছেন?
– বলেছেন, বাবারা অনেক কষ্ট করে আমাদের জন্য। সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে। সারাক্ষণ আমাদের সুখের জন্য চিন্তা করে। আমাদের কতো আদর করে! কতকিছু কিনে আনে!
– তো, কী হলো তাতে?
– আমার দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, মিস, সব বাবা এমন না। কোনো কোনো বাবা ছেড়ে যায়, বাচ্চার কথা ভাবে না।

দিনভর গম্ভীরতার মেঘ কেটে গিয়ে দু’চোখ বেয়ে অঝোর বৃষ্টি নামে। সান্ত্বনা দিতে গিয়ে মা বলে,
– তোমার ক্লাসে অমুকেরও তো বাবা নেই। সবার বাবা কি আর থাকে!
– হ্যাঁ নেই, কিন্তু ওর বাবা তো মারা গেছে। মারা গেলে তবু মনে হয়, আল্লাহ নিয়ে গেছে, তাই আদর করতে পারছে না। থাকলে নিশ্চয়ই করতো। কিন্তু আমি কী ভাববো?

আসলেই তো জয়িতারা কী ভেবে সান্ত্বনা পায়? ব্রোকেন ফ্যামিলি – ইংরেজি এই শব্দ দুটো আমাদের ভাষায় এমনভাবে নিজেদের অবস্থান জানান দেয় যে, বুঝতে কষ্ট হয় না একটা ভেঙে যাওয়া পরিবার। একটা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মানে, অনেকগুলো স্বপ্নের মৃত্যু, একটা পরিবারের অকাল মৃত্যু। এই ভেঙে যাওয়া পরিবারের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সদস্য হচ্ছে, বাচ্চারা।

এইসব সন্তানের মতো অভাগা খুব কমই হয়। না থাকে পরিবার, না থাকে সান্ত্বনা, থাকে শুধু সামাজিক বক্রদৃষ্টি। পারিবারিক/সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি আড়ষ্টতার সাথে হয়, থাকে কিছু জড়তাও। অনেকেই আলগা দরদ দেখাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, মা/বাবা’কে মিস করো না? কেউ আবার আরেককাঠি সরেস, আহারে বাচ্চাটা বাবা/মা’য়ের আদর পাচ্ছে না বলে। এসব বলা মানে বাচ্চাটার আনন্দে এক বালতি নোংরা জল ঢেলে দেওয়া।

স্কুলে সহপাঠীদের মধ্যেও কানাঘুষা চলে। অমুকের মা/বাবা আলাদা থাকে। অনেক অভিভাবক তো ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চাদের সাথে নিজের বাচ্চাকে মিশতেও মানা করে দেন। এইসব পারিপার্শ্বিকতা প্রভাব ফেলে বাচ্চাদের মনোজগতে, প্রভাব ফেলে তাদের পড়াশোনায়, তাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে। খুব স্ট্রং মাইন্ডের বাচ্চা না হলে খুব ভালো সম্ভাবনা আছে তার অকালে নষ্ট হবার।

কোনো সংসার কেউ শখ করে ভাঙ্গে না। অবশ্যই বড় কোন কারণেই ভেঙে পড়ে। একটা অসুস্থ সম্পর্কে থেকে অসুস্থ পরিবেশে বাচ্চাকে না রেখে যে যার মতো আলাদা হয়ে যাওয়াটা মন্দের ভালো। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বাবা-মা দু’জনেরই দায়িত্ব আছে সন্তানের প্রতি। তাকে সময় দেয়া, তার ঠিকঠাক ভরনপোষণ দেয়া দু’জন ভাগাভাগি করে নিতে হয় যতোটা সম্ভব।

স্বামী-স্ত্রীর ডিভোর্স হয়, সন্তানের সাথে তো নয়! একটা সময় যে যার মতো হয়তো নতুন করে সংসার পায়, কিন্তু এই বাচ্চাগুলো আর কখনোই তার আপন পরিবার পায় না। তাদের ক্ষতটাতে সময়ের সাথে প্রলেপ পড়লেও কিন্তু আজন্মের দাগ হয়ে থাকে।

এখনকার এই সময়ে এসে মা-বাবা দুজন মিলেও সন্তান মানুষ করতে হিমশিম খান সেখানে কেউ একজন একা তাদের মানুষ করার; বড় করার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হলে কঠিন বিপাকে পড়েন সন্দেহ নাই। ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তানের জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর মুহূর্ত তার বাবা বা মায়ের নতুন বিয়ের মুহূর্তে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্পৃশ্য ভাবনার অদৃশ্য হতে চায় ওই সময়টায়।

আপনি নতুন সংসার করছেন, সেখানে নতুন সন্তানও এসেছে, সেই ছবি দিয়ে আহ্লাদ দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়, অথচ আগের বাচ্চার খবর নেই। তার কপালে আদর তো দূরে থাক, প্রয়োজনীয় খাবারের খরচটাও দিতে পারেন না। কেস-মামলার চাপে পড়ে কেউ কেউ দিতে বাধ্য হন বটে, তবে সেটা নেয়াটা ওই বাচ্চার আত্মসম্মানে কতটা আঘাত হানে তা কেউ জানে না। অবশ্য উচ্চশিক্ষিত ভদ্রপরিবারে আজকাল বিষয়গুলো মিচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর মাধ্যমে সহজে হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করা হয়। একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা থাকে মোটামুটি। তবে এই সংখ্যা খুবই নগণ্য। বেশিরভাগ সম্পর্ক শেষের পরের অবস্থাটা জঘন্য।

ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চারা খুব অল্প বয়সেই দেখে ফেলে দুনিয়ার কঠিন চেহারা। স্বার্থপর পৃথিবীতে মানুষের নোংরা মানসিকতার সাথেও পরিচয় ঘটে তাদের। যেহেতু সমাজের বেঁধে দেয়া মাপকাঠিতে স্বাভাবিক একটা জীবন হয় না, তাই তাদের কষ্টগুলোও অস্বাভাবিক রকম ভারী। এদের নিদ্রাহীন রাতের হিসেব কেউ রাখে না, অলক্ষ্যে ফেলা চোখের জল কেউ দেখে না।

আমাদের সমাজে বিয়ের পর পরই বাচ্চা নেবার খুব তারাহুড়ো থাকে। পারিপার্শ্বিক প্রেসারও থাকে একরকম। আবার সংসারে বনিবনা হচ্ছে না, অশান্তি হচ্ছে, কিংবা স্বামী নেশাগ্রস্ত, সবার উপদেশ বাচ্চা নাও, ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চা নিয়ে কোনকিছু ঠিক হয় না, বরং আরও অনেক বিপদের শুরু হয়। একটা সম্পর্ককে সময় দিতে হবে। বাচ্চার দায়িত্ব নেবার মতো নিজেরা তৈরি কিনা এ বিষয়ে ভেবেচিন্তেই দুজনকে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

বাচ্চা কখনোই কাউকে ঠিক করার হাতিয়ার না, কাউকে ভালো করার মেডিসিন না, কাউকে সংসারে বেঁধে রাখার শিকল না। সে একটা নতুন প্রাণ যাকে আমরা আনি পৃথিবীতে। সে অসহায় থাকে, আমাদের তার সহায় হতে হবে। শক্তি দিয়ে সামর্থ্য মতো গড়তে হবে আমাদের পরের প্রজন্ম। আনলাম, ছেড়ে দিলাম, এই অবস্থা কখনোই কাম্য না।

ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চারা কোন অপরাধী না। তাদের আলাদাভাবে দেখার কিছু নেই। অতি আহ্লাদ কিংবা অহেতুক ছোট চোখে দেখাটা সে চায় না, শুধু স্বাভাবিক আচরণটাই প্রত্যাশা করে সমাজের কাছে। আর যারা বাবা-মা, একটা বিষয় তাদের মনে রাখা দরকার, আপনারা স্বামী বা স্ত্রী নন ঠিকই, কিন্তু সন্তানটা আপনার। সে যার কাছেই থাকুক, দায়িত্ব কিন্তু দু’জনেরই। যে জীবন পৃথিবীতে এনেছেন তার চোখের জলের কারণ হবার মধ্যে সার্থকতা নেই কোন, আছে কাপুরুষতা।

শেয়ার করুন: