কোভিড-১৯: যে নারীরা এখনও সবার নজরের বাইরে

উপমা মাহবুব:

করোনা সংক্রমণের প্রভাব কোন জনগোষ্ঠীর উপর কীভাবে, কতোটুকু পড়ছে তা নিয়ে বিশ্বব্যাপি প্রচুর আলোচনা ও গবেষণা হচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। সবচেয়ে বেশি আলোচনায় সম্ভবত এসেছে নারীর উপর সংসারের কাজ সামলানোর চাপ বেড়ে যাওয়া এবং পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি। তবে নারীর সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি বিষয় নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা গবেষণা আমার চোখে পরেনি। অথচ এই নারীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই অনুভূতি থেকেই আজকের লেখাটি লিখছি।

করোনার সংক্রমণের কারণে যারা খুবই সংকটময় অবস্থায় আছেন তাদের মধ্যে গর্ভবতী নারীরা অন্যতম। বাংলাদেশে গর্ভকালীন অবস্থায় নারীরা এমনিতেই নিজেদের লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। তারা যে গর্ভধারণ করেছেন এটা তারা বা তাদের পরিবার সবার কাছে প্রকাশ করতে চান না। অনেক গর্ভবতী মেয়ে তাদের সমস্যা চেপে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করেন। সামগ্রিকভাবে আমাদের পুরো সমাজই গর্ভকাল সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করাকে নিরুৎসাহিত করে। ধারণা করছি এই সামাজিক ট্যাবুগুলোর কারণেই বাংলাদেশে গর্ভবতী নারীরা বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন, সেগুলোর সমাধানে কী উদ্যোগ প্রয়োজন, ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচনার টেবিলে স্থান পাচ্ছে না।

যতদূর জানি বর্তমান পরিস্থিতিতে গাইনোকোলজিস্টরা অতিরিক্ত কোনো সমস্যা না থাকলে গর্ভবতী মায়েদের রেগুলার চেকআপে যেতে নিষেধ করছেন। এই ডাক্তারদের বড় একটা অংশ টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছেন। ফেসবুকে গর্ভবতী মায়েদের জন্য গাইনোকোলজিস্টদের নিয়ে লাইভ প্রোগ্রামও হতে দেখেছি। এগুলো অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। তারপরও কোনো শারীরিক সমস্যা হলে বা টেস্ট করার জন্য একজন গর্ভবতী মাকে কোনো না কোনো সময় নিশ্চয় হাসপাতালে যেতে হচ্ছে৷ এ সময় নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা বা টেস্ট করার সময় যেন শরীরে করোনা সংক্রমণ না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলো মা এবং তার পরিবারের সদস্যরা কীভাবে নিশ্চিত করছেন, তা একটা দুশ্চিন্তার বিষয়ই বটে।
আমার একজন পরিচিত নারী আছেন যিনি তার গাইনোকোলজিস্টের কাছে যেতে পারছেন না কারণ ঐ ডাক্তার যে হাসপাতালে বসতেন সেটিকে করোনা চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড করা হয়েছে। ফলে ওনার গাইনোকোলোজিস্ট এখন রোগী দেখছেন না। এদিকে আমার সেই কলিগ তার কিছু শারীরিক জটিলতার কারণে নতুন কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সাহসও পাচ্ছেন না। শহরে থাকা গর্ভবতী মায়েদেরই এখন এই অবস্থা, আর মফস্বল বা গ্রামে কী অবস্থা কে জানে!

গত কয়েকদিনে গর্ভবতী মায়েদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনা আমাকে অত্যন্ত বিচলিত করেছে। একটি ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানে সোহওয়ার্দি হাসপাতালের একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ ওনার তত্ত্বাবধানে থাকা ছয়জন গর্ভবতী নারীর কথা বলছিলেন। তাদের মধ্যে তিনজনের করোনা হয়েছিল, কিন্তু কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই তারা সুস্থ শিশুর জন্ম দিয়েছেন৷
এই সঙ্গে তিনি ভয়ংকর একটি অভিজ্ঞতাও শেয়ার করলেন। করোনা আক্রান্ত ঐ নারীদের একজনের স্বামী প্রবাসী। মেয়েটির করোনা ধরা পড়ার পর থেকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে এক রুমে আইসোলেটেড করে রাখে এবং পুরোটা সময় তিনি তাদের কাছ থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা বা যত্ন পাননি। প্রসব বেদনা উঠার পর মেয়েটি নিজে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে একা হাসপাতালে হাজির হন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তো অনেক পরের কথা, এসময় তার নিজের আত্মীয়-স্বজনরাও তাকে সঙ্গ দিতে রাজি হয়নি। সিজার করার আগে অনেক কষ্টে ঐ ডাক্তার মেয়েটির মাকে হাসপাতালে আসতে রাজি করান। কিন্তু মেয়েটির সন্তানটি পৃথিবীর আলো দেখার পর কেউই তার দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি। ঐ ডাক্তার নিজে একটি কেবিনের ব্যবস্থা করেন, যেখানে পুরো একদিন সদ্যজন্ম নেওয়া শিশুটি একজন আয়ার কাছে ছিল। তার মা তখন পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারে। এরপর একটু সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটি একাই তার সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন এবং সন্তানকে নিয়েও একাই শ্বশুর বাড়ি ফিরে যান।

এই ঘটনাটা শোনার পর যে কতটা কষ্ট লেগেছে তা বলার মতো না৷ একজন মা তার সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়ার সময় পরিবার বা শ্বশুরবাড়ির কাউকে কাছে পেল না, মানুষ কেমন করে এতোটা নিষ্ঠুর হয়? গতকাল মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো নিষ্ঠুরতার আরেক উদাহরণ দেখে। চট্টগ্রামে দশ মাসের শিশুকে পেটে নিয়ে অক্সিজেনের অভাবে হাঁসফাঁস করতে করতে একজন মা মারা গেলেন। তার খুব শ্বাসকষ্ট উঠেছিল যা ছিল গর্ভধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত। অথচ সম্ভাব্য করোনা রোগী সন্দেহে কোনো হাসপাতাল তাকে আইসিইউ-তে ভর্তি করাতে রাজি হয়নি৷ অক্সিজেনের অভাবে প্রথমে মেয়েটি মারা গেছে। তারপর তার পেটে থাকা সুস্থ শিশুটিও মারা যায়। অথচ আর মাত্র কয়েকদিন পর তার পৃথিবীর আলো দেখার কথা ছিল।

এসব ঘটনা শোনার পরও মানুষের প্রতি বিশ্বাস নিয়েই কঠিন সময়টুকু পার করছি৷ মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের মধ্যে ভালো আর মন্দ দুটো গ্রুপই আছে। মন্দগুলোকে পাশ কাটিয়ে তাই ভালো মানুষদের সবসময় খুঁজে ফিরি। আজকে এ রকম একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হলো। তার নাম আরিফা জাহান বীথি। রংপুরে থাকেন। তিনি একজন ক্রিকেটার, তবে ইনজুরির কারণে খেলা ছেড়ে দিয়ে রংপুরে মেয়ে ক্রিকেটারদের জন্য একটি একাডেমি পরিচালনা করছেন। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মানুষের সহায়তায় কিছু একটা করার তাগিদ থেকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন – লকডাউনের কারণে খারাপ অবস্থায় আছেন, কিন্তু কারো কাছে সহায়তা চাইতে পারছেন না, এরকম কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তাদের খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেবেন। নিজের পকেট থেকে এরকম কয়েকজনকে সহায়তা করার পর একদিন একজন গর্ভবতী নারী তাকে কল করেন যার স্বামী লকডাউনের কারণে কাজে যেতে পারছে না। ফলে তারা প্রবল খাদ্যসংকটে আছেন। বিষয়টা আরিফাকে খুব ভাবায়। তার মনে হয় গর্ভবতী যেসব মায়েরা লকডাউনের কারণে আর্থিক সংকটে আছেন, তাদের কথা কেউ আলাদাভাবে ভাবছে না। অথচ এই সময়ে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াটা খুবই জরুরি। তাই আরিফা ঠিক করেন এখন থেকে তিনি গর্ভবতী নারীদের মানবিক সহায়তা হিসেবে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেবেন৷

সেই থেকে শুরু। এখন পর্যন্ত আরিফা তার বড় বোনসহ রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় অনেক গর্ভবতী নারীর কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন৷ কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তি এ কাজে তাকে সহায়তা দিচ্ছেন। বাকিটা তিনি নিজে যতটুকু পারেন করছেন। আরিফার চিন্তার গভীরতা এবং তার এই উদ্যোগ সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে৷

আমি নিজে বেসরকারি সংস্থায় কাজ করি। আমাদের টিমটিও মাঠ পর্যায়ে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের কাজ করছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কাছ থেকেও গ্রামের দরিদ্রতম গর্ভবতী নারীদের তাঁরা কীভাবে সহায়তা করছেন সেইসব গল্প শুনি। তখন খুব ভালো লাগে। মনে হয় কোথাও কেউ না থাকার মুহূর্তগুলোতেও সত্যিই হয়তো দেবদূতের মতো কিছু মানুষ পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপরও সার্বিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে আমি মনে করি, করোনা সংক্রমণকালীন অবস্থায় গর্ভবতী নারীরা কে, কোথায়, কেমনভাবে আছেন, তা খতিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরি।

গর্ভধারণের সময়টা একজন নারীর জন্য একদিকে অত্যন্ত আনন্দের, অন্যদিকে শারীরিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তাই গর্ভবতী মায়েরা যেন বর্তমানে চলমান সংকটময় সময়টুকু নিরাপদে পার করতে পারেন সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.