বনানী রায়:
কেউ কি কোনোদিন জানতে পারবে না চিন্ময়ীর হেরে যাওয়ার কথা? তার গ্লানি আর পরাজয়ের কথা? এই এতো বড় পৃথিবীতে এতো কোটি মানুষ, কোনোদিন কাউকে সে জানাতে পারবে না তার এই লজ্জার কথা? না, সে কাউকে বলবে না। যে ঈশ্বরের উপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিল, সেই বিশ্বাসে ভর করেই তো সে বুকের মধ্যে লালন করেছিল তার স্বপ্ন আর স্বপ্নের সেই না দেখা পুরুষটিকে। কিন্তু কই, ঈশ্বর তো তার বিশ্বাসের মূল্য দেয়নি। তাকেই কি কোনোদিন মূল্য দিয়েছে? তাই সে কাউকে কিছু বলবে না, ঈশ্বরকেও না।
প্রায় ২০ বছর হয়ে গেল তার বিয়ে হয়েছে। এখনও তার মনের মধ্যে জ্বল জ্বল করে, মনে পড়লে যেন চোখ দিয়ে ঠিকরে আগুন বের হয়। কেন যে সেই আগুনে পাষণ্ডটাকে সেদিন পুড়িয়ে মারতে পারলো না। ফুলশয্যা! তার জীবনে বিভীষিকাময় রাত হয়ে রয়ে গেল। হায়রে রক্ত, বিছানা ভিজে গেল। তার চাপা আর্তনাদ, গোঙানি কোনো কিছুই লোকটাকে ছুঁলো না। তার কোন ইচ্ছে, মতামত কোন কিছুর পরোয়াই করলো না। পাষণ্ড, অসভ্য লোকটা তৃপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সারারাত নাক ডেকে ঘুমোলো। আর সে পাশে পাথরের মতো পড়ে রইল। উহ, কী অসহ্য যন্ত্রণা। তবু নড়তে সাহস, শক্তি কোনোটাই পেলো না। সারারাত তার চোখের জল গড়াতে থাকলো, তারপর এক সময় চোখ যেন শুকিয়ে গেল।
ভোরে সে উঠে বাথরুমে গেল, কী কষ্ট এইটুকু পথ হাঁটতে! আয়নায় নিজেকে দেখে সে কী ভীষণ চমকে উঠেছিল। তার সেই সুন্দর চেহারা কোথায় গেল? ঠোঁট দুটো ছিঁড়ে গেছে, চোখ ফুলে গেছে। এই চিন্ময়ীকে সে চিনতেই পারলো না। আস্তে আস্তে সে ধাতস্থ হলো, তার মাথা কাজ করতে শুরু করলো। সে মানুষের সামনে যাবে কী করে? আর বিছানার রক্ত কী করবে? সবাই দেখলে যে বড় লজ্জা! তার বরই কেন এমন হলো? এ যেন তারই লজ্জা। লোকটা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে স্নান করে ভালো কাপড় চোপড় পরে সিঁদুর দিল, টিপ পরলো, হালকা করে লিপস্টিক দিলো, যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। তারপর জানালার পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো, তার চোখে কোনো জল নেই। কারও কাছে তার কোনো নালিশ নেই। যাকে বিধাতা নিজের হাতে মারে, সে কার কাছে নালিশ জানাবে?
একসময় লোকটা উঠলো, উঠে তার কাছে এলো। সে কি একটু কেঁপে উঠলো? এসে তাকে বললো, তোমার কি পিরিয়ড হয়েছে? চিন্ময়ী অবাক হলো, দুদিকে মাথা নাড়লো। তারপর লোকটা যা বললো, সেটা আজও সে ভাবতে পারে না। নোংরা লোকটা তাকে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে এতো রক্ত তো পড়ার কথা নয়। অন্য কেস নয়তো? চিন্ময়ী কোনো কথার মানে বুঝতে পেলো না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। লোকটা আবার বললো, মানে বিয়ের আগে কারও সাথে কিছু ঘটিয়ে আসোনি তো? তারপরও কী কী যেন বলে গেল তার মাথায়, কানে কিছুই ঢুকলো না। তার কান যেন বিধাতা নিজের হাতে বন্ধ করে রাখলেন, তাহলে তিনিও কি লজ্জা পেয়েছিলেন এই লোকটাকে তার জীবনসঙ্গী বানানোর জন্যে?
কলেজ আর খাঁচা এই ছিল তার গণ্ডি। এর বাইরে একটা জগতই ছিল যেখানে সে ছিল মুক্ত বিহঙ্গ। অনেক বই ছিল তার মামার, সে মামার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তো। কত উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ যে সে পড়েছে। সব উপন্যাসের নায়কের কাছ থেকে একটু একটু করে নিয়ে সে তার স্বপ্নের পুরুষকে গড়েছিল। তার সাথে এই সামনে দাঁড়ানো মানুষটার কী ভীষণ অমিল! লোকটার কুরুচিপূর্ণ কথা শুনে তার যেন দাঁড়ানোর ক্ষমতাও চলে গেল, সে চেয়ারে বসে পড়লো। তারপর অনেকক্ষণ পর দেখলো লোকটা বিছানার চাদর তুলে বাথরুমে ফেলে দিল। চিন্ময়ীর বড় জা’কে ডাকলো, বিছানায় চাদর দিতে বলে বাথরুমে ঢুকে গেল। চিন্ময়ীর জা এসে তাকে একটু দেখলো, তারপর হাত দুটো ধরে ফিস ফিস করে বললো, ‘এরা বড় ভয়ংকর, তোমাকে কী সুন্দর দেখতে, লেখাপড়া জানো। কেন ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে তোমার বিয়ে দিল?’
চিন্ময়ী কিছু বললো না, শুধু বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে ভাবলো, যার মা বাবা ছোটবেলায় ফাঁকি দিয়ে ওপারে পাড়ি দেয়, যার বড় হওয়া মামা মামীর দয়ায়, তার আবার খোঁজ খবর! এখানে তাকে মেরে ফেললেও কেউ জবাব চাইবে না। তাকে কি বিয়ে দিয়েছে? কোনো রকমে বেড়াল পার করেছে।
তারপর সেই মানুষটার সাথে এতো দীর্ঘ সময় কেটে গেল। তার একটাই ছেলে, কেমন যেন বাপের ধাঁচ পেয়েছে। তার উপর ভগবানের এতো কীসের রাগ? সে খুব চাইতো তার যেন একটা মেয়ে হয়। মেয়েরা নাকি মাকে খুব বোঝে, তাও হলো না। সে যা চেয়েছে জীবনে, তার ঠিক উল্টোটা হয়েছে। চিন্ময়ী কিছুতেই ভেবে পায় না কেন এমন হলো! হায়! এভাবেই কেটে যাবে বাকি জীবন?