জান্নাতুল নাঈম পিয়াল:
আমার বেস্টফ্রেন্ড একটা মেয়ে। তাছাড়া আরো কয়েকজন মেয়ের সাথেই মোটামুটি ঘনিষ্ঠতা আছে বা ছিল। ঘনিষ্ঠতা বলতে যাদের সাথে একটু পারসোনাল ব্যাপার শেয়ার করা যায় আরকি! তো, এই মেয়েদের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকার ফলে একটা জিনিস খুব ভালো করেই জানতে পেরেছি যে, মেয়েদের ইনবক্স মানেই হলো প্রেমিক পুরুষদের নানাবিধ মেসেজের সমাহার। সমবয়সী থেকে শুরু করে এমনকি বাপ-দাদার বয়সী অনেকেও মেয়েদেরকে ক্রমাগত মেসেজ দিয়ে যায়। আর মেয়েরা যদি ভদ্রতার খাতিরে পরিচিতদের মেসেজের রিপ্লাই দেয়, যাদেরকে রিপ্লাই না দিলেই নয়, কয়েকদিন পর দেখা যায় তারা নানাভাবে প্রেম নিবেদন শুরু করে দিয়েছে। কেউ হয়তো কবিতা পাঠাচ্ছে, কেউ সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি সমৃদ্ধ সেমি চটি গল্প পাঠাচ্ছে, কেউ সরাসরি ভালোবাসি বলে দিচ্ছে, আর কেউ তো এত টাইপিংয়ের ঝামেলায় না গিয়ে স্রেফ নিজের গোপনাঙ্গের ছবিটা তুলে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
যারা গোপনাঙ্গের ছবি পাঠায়, তাদের কথা না-হয় বাদই দিলাম। কিন্তু কবিতা-গল্পের মাধ্যমে কিংবা সরাসরি যারা ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়, তাদের মধ্যেও বেশিরভাগকেই মেয়েরা ইগনোর করে যায়। কখনো কখনো ব্লকও করে দেয়। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে কি এই ইগনোর করা বা ব্লক করা সম্ভব? সম্ভব না। কারণ প্রেম-প্রত্যাশী পুরুষটি হয়তো ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র, দুঃসম্পর্কের খালাতো-ফুপাতো ভাই, কিংবা বাবার অফিসের সহকর্মী। এরকম পুরুষদের তো চাইলেই ইগনোর বা ব্লক করা যায় না। তাই যথাযথ বিনয়ের সাথে তাদের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে হয়। বলতে হয়, “সরি ভাইয়া/আংকেল/নানা, আমার একটা বয়ফ্রেন্ড আছে”, কিংবা “আমি এসবে ইন্টারেস্টেড না।”
কিন্তু এই বিনয়াবনত প্রত্যাখ্যানের সাথে সাথেই কি প্রেমিক পুরুষরা থেমে যায়? না। কারণ আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, মেয়েদের ‘না’ মানেই হলো ‘হ্যাঁ’। আসলে মেয়েটা প্রেম করতে ইচ্ছুক ঠিকই, কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারছে না। কিংবা কোনো কোনো পুরুষ এমন মানসিকতার অধিকারীও হতে পারে যে, “আরে, আমার মুখের উপর না বলে দেয়, এই মেয়ের সাহস কত! আমি যখন প্রপোজ করেছি, আমার সাথে ওকে প্রেম করতেই হবে। আমি ওকে আমার প্রেমে পড়তে বাধ্য করবো।”
এসব ভাবনা থেকেই প্রেমিক পুরুষেরা মেয়েদের মেসেজে উত্যক্ত করা থামায় না। ভয়েস কল, ভিডিও কল দেয়। কেউ কেউ ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফোনেও কল দিতে থাকে।
এরকম পরিস্থিতিতে মেয়েদের কী করণীয়? বাবা-মাকে জানানো? ৯০% সম্ভাবনা, বাবা-মাও মেয়েদেরকেই দোষারোপ করবে। সাফ জানিয়ে দেবে, “তোমার আর মোবাইলের প্রয়োজন নেই।” তাহলে কি সাইবার ক্রাইমে মামলা করবে? সেরকম মনের জোর, সাহস কিংবা সুযোগও অধিকাংশ মেয়ের থাকে না। এবং ব্লক-ইগনোর করার কথাই যদি ধরেন, আগে যেসব কারণে এগুলো তারা করতে পারেনি, এবারও হয়তো সেই একই কারণেই কাজটি তারা করতে পারে না।
কিংবা মনে করুন, ব্লক-ইগনোর করার সুযোগ মেয়েদের আছে। কিন্তু তার মানেই কি তারা যে কাউকে ব্লক-ইগনোর করতে বাধ্য? তা তো না। কোনো কোনো মেয়ের কাছে তো তার আত্মসম্মানবোধ এতটা জোরালোও হতে পারে যে তারা ভাবে, “কেন আমি একে ব্লক করতে যাবো! একে ব্লক করা মানে এটা বুঝিয়ে দেয়া যে আমি এর ভয়ে ভীত, কিংবা আমার জীবনে এর অনেক প্রায়োরিটি। সুতরাং আমি একে ব্লক করবো না। সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি, এরপরও সে আমাকে মেসেজ দিতে থাকলে সভ্য সমাজের বাসিন্দা হিসেবে যতটুকু রিপ্লাই না দিলেই নয়, সেটুকু দেবো।”
অর্থাৎ বিভিন্ন কারণেই মেয়েরা কোনো উত্যক্তকারী, ছ্যাঁচড়া প্রেমিক পুরুষকে ব্লক বা ইগনোর না-ই করতে পারে। তার সাথে স্বাভাবিক আলাপচারিতা চালিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু আমাদের সমাজ, কিংবা আমাদের সমাজের পুরুষরা মেয়েদের এই আচরণের কী ইন্টারপ্রিটেশন বের করে, জানেন? তারা বের করে, মেয়েটাও নিশ্চয়ই ওই প্রেমিক পুরুষকে ভালোবাসে, তার মনেও নিশ্চয়ই ওই প্রেমিক পুরুষের প্রতি একটু হলেও দুর্বলতা আছে। নইলে সে কেন কথা চালিয়ে গেল? কেন ব্লক করলো না, ইগনোর করলো না?
প্রত্যাখ্যাত হয়েও যে প্রেমিক পুরুষটি তার ছ্যাঁচড়ামো অব্যাহত রাখলো, এ দিকটা কিন্তু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ভাবে না। কারণ তাদের মতে, এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। প্রেমিক পুরুষটি তো মেয়েটিকে ভালোবাসে। আর ভালোবাসার জন্য এমনটা করাই যায়। ওই যে নাটক-সিনেমায় দেখায় না! এমনকি অনেক মেয়েও প্রেমিক পুরুষদের এমন আচরণ মেনে নিয়ে ভাবে, “কী আর করা, ছেলেরা তো এমনই!”
ছেলেরা এমনই, তাই তাদের ছ্যাঁচড়ামো হালাল। কিন্তু মেয়েরা যে ব্লক-ইগনোর না করে কথা বলা চালিয়ে গেল, সেটা হারাম। আসলেই যদি ভালোবাসতে বা সম্পর্কে জড়াতে না চায়, তারপরও কেন সোজা ব্লক করে দিল না? কেন প্রেমিক পুরুষকে এতো পাত্তা দিল, আশকারা দিল, লাই দিয়ে মাথায় তুললো? এটা অবশ্যই মেয়েদের হিপোক্রেসি। তাদের মুখে এক, মনে আরেক। কিংবা তারা হলো বারোভাতারি। স্লাট। হোর। তারা একদিকে কারও সাথে প্রেমও করে, আবার অন্য ছেলের সাথেও কথা বলে। আসলে কথা তো বলে না, হাতে ব্যাকআপ রাখে, কোনোদিন যদি দরকার পড়ে বসে ওই প্রেমিক পুরুষদের! এভাবেই তারা ধোয়া তুলসিপাতা সদৃশ প্রেমিক পুরুষদের ইমোশন নিয়ে খেলা করে।
তো, এই গোটা আলোচনা থেকে কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি আমরা? সেটি হলো: আগে যেমন নারীদেরকে নিজেদের সতিত্বের প্রমাণ দিতে হতো, এখন অনেকটা সেভাবেই মেয়েদেরকে ব্লক করে দিয়ে, কথা না বলে, ইগনোর করে নিজেদের ‘না’-এর প্রমাণ দিতে হবে। প্রমাণ দিতে হবে যে আসলে তারা প্রেমিক পুরুষদের প্রতি মোটেই দুর্বল ছিল না।
এই প্রমাণ যদি কোনো মেয়ে দিতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতে ওইসব প্রেমিক পুরুষ কর্তৃক বড় কোনো হ্যারাসমেন্টের শিকার হলেও দায়টা ওই মেয়ের কাঁধেই বর্তাবে। কেননা দিনশেষে “ছেলেরা তো এমনই, কিন্তু মেয়েরা এমন কেন?”
লেখক:
শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।