অনিন্দিতা চৌধুরী:
প্রচলিত গণমাধ্যমের মধ্যে চলচ্চিত্র বহুল জনপ্রিয় একটি মাধ্যম, এতে সন্দেহ নেই। বিনোদনের প্রভূত উৎস এই মাধ্যমটির বিষয়, কাহিনী, উপস্থাপন ইত্যাদি তাই দর্শকব্যক্তিত্বেও কিছু না কিছু ছাপ ফেলে।
কোনো একটি বিষয় সমাজে কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তার প্রতিফলন যেমন চলচ্চিত্রে পড়ছে, ঠিক একইভাবে কিন্তু চলচ্চিত্রের কন্টেন্টের প্রভাবও সমাজ জীবনে পড়ছে। এই মিথস্ক্রিয়ামূলক যোগাযোগের মধ্যে আমরা কথা বলবো বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে জেন্ডার সংবেদনশীলতার উপস্থিতি নিয়ে।
বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে নারী, পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতেই উপস্থাপন করা হয়। ‘ভালো’ চরিত্রের নারী; সংসার সুখের হয় যে রমণীর গুণে, সেই নারী সর্বদা নিজের চরিত্র বা ইজ্জত বাঁচাতে সদা তৎপর। নারীর সম্মানই সবচেয়ে বেশি ঠুনকো।
ওদিকে পুরুষকেও ‘পৌরুষ’ ধ্বজা ধরে রাখতে বেশ ভালোই কসরত করতে হয়। সিনেমার হিরো একজন পুরুষই হবেন এবং তার হিরোগিরির প্রমাণ ও পুরস্কার উভয়েই যাত্রা করবে নারীর মোড় ঘুরে। অর্থাৎ নারীকে কোনো খলনায়কের হাত থেকে উদ্ধার করবে পুরুষ, বেশিরভাগ সময় ‘স্বল্পবসনা’ নারীকে নিজের গায়ের শার্ট খুলে দিয়ে ‘ইজ্জত’ বাঁচায় পুরুষ। এবং সেক্ষেত্রে পুরুষ উদোম গায়ে থাকলে এতে তার পৌরুষই বজায় থাকে, এক ফোঁটা ইজ্জত বাড়ে বৈ কমে না। একদিকে তো নারীদেহকে দৃষ্টিসুখের জন্য যৌনবস্তু হিসেবে প্রদর্শন করা হয়, আবার আরেকদিকে পুরুষতন্ত্রের অন্য পালে হাওয়া দেয়া হয় এই রক্ষার দৃশ্যগুলো দ্বারা।
বাংলা চলচ্চিত্রে একটি মুখ্য দৃশ্য যে মারামারির দৃশ্য, সে কেইবা ভুলতে পারে! নায়কের সাথে একবার (কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক) ‘ঢিসুম ঢিসুম’ আওয়াজসহ মারামারি বাংলা চলচ্চিত্রের প্যাকেজের অবিচ্ছেদ্য ‘আইটেম’। মজার বিষয় হলো, সাধারণ কলেজপড়ুয়া ছেলে থেকে শুরু করে নিরীহ দোকানদার, নায়ক যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, মারামারিতে সে সিদ্ধদেহ হবেই হবে! তাকে হারাতে পারবে না খলনায়ক লাঠিয়াল দল, তাকে হারানোর সাধ্য নেই আপাতদৃষ্টিতে বেশি শক্তিশালী কারোরই। কেন? কারণ সে ‘নায়ক’।
বাংলা চলচ্চিত্রে নারী ‘অবলা’ হয়, ‘ভোগ্য’ হয়, কখনও দাপট দেখালেও সেটা কারও ধার করা দাপট এবং হিরোরুপী পুরুষটি সেই দাপট ভেঙে দিয়ে নারীর প্রকৃত স্থান যে চার দেয়াল ও ঘোমটার মধ্যেই আবদ্ধ, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।
শাবানা থেকে শুরু করে হালের অপু বিশ্বাস, এরা সবসময়ই নারীর এই রূপায়নগুলোর সাথে পর্দায় হাজির হয়েছেন এবং বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে এর ব্যত্যয় ঘটা ভার।
আর নায়িকা মাত্রই যে একগাদা রং মাখা ‘রূপসী’, এবং কিম্ভূতকিমাকার পোশাক পরিহিতা, যার পেছনে দু’তিন দল পুরুষ পাগল হয়ে ছুটবে এবং চলচ্চিত্রের শেষে সে নায়কের হাতেই উঠবে নায়কোচিত কাজের পুরস্কার হয়ে, সেটি এলোমেলোভাবে ক’টি মূলধারার চলচ্চিত্র দেখলেই টের পাওয়া যাবে। কেন? কারণ সে ‘নায়িকা’।
এই যে নায়ক-নায়িকার একটি তুমুল স্টেরিওটাইপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাংলা সিনেমার জগতে, সেটা দর্শকমনেও আটকে গেছে। এই দৃশ্যগুলোতেই এখন অভ্যস্ত বাংলা সিনেমার নিয়মিত দর্শকেরা, আর যারা অনিয়মিত, তারা এই দৃশ্যগুলোতে সেভাবে অভ্যস্ত হতে পারেননি বলেই হয়তো।
তৃতীয় লিঙ্গের উপস্থাপন নায়ক কিংবা নায়িকার কাতারে কখনোই পড়ে না সিনেমার এ জগতে। তারা রঙ্গ করেন, হাসিঠাট্টার খোরাক জোগান, নায়ক-নায়িকার ভৃত্য, সহচর কিংবা তোষামোদকারীর ভূমিকায় তাদের দেখা যায়।
‘সিরিয়াস’ কোনো চরিত্রে তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে রাখা হয় না। তাদের যেন সিরিয়াসনেস থেকে দর্শককে ‘কমিক রিলিফ’ দেবার জন্যই রাখা হয় সিনেমায়। কেন? কেননা সে নারী বা পুরুষ নয় এবং তাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়ার সাহস এই চলচ্চিত্র নির্মাতারা করতে পারছেন না।
বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ, কারও ক্ষেত্রেই জেন্ডার সংবেদনশীলতা পালন করা হয় না। সেটা একাল-সেকাল যেকোনো কালেই সত্যি। তবে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে কিন্তু এক্ষেত্রে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। প্রথা ভাঙার একটা মোটামুটি প্রবণতা দেখা দিচ্ছে বেড়ার এদিকটায়। কিন্তু এতোদিনের আটকে যাওয়া জেন্ডার-ধারণা এতো সহজে ভাঙবে বলে মনে হয় না, তবে চেষ্টা চালিয়ে যাবার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক:
শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়