জিন্নাতুন নেছা:
ফেইসবুকের সুবাদে বাংলাদেশের তথাকথিত লেবাসধারী মুমিন সম্প্রদায়ের একটা পোস্ট চোখে পড়লো। যদিও আমি এই ধরনের লেবাজধারী মুমিনগনের পোস্ট ইগনোর করি, কিন্তু আজ পারলাম না। কারণ গত মে মাস ছিলো মিনস্ট্রুয়াল হাইজিন প্রমোশনের মাস এবং এই সম্পর্কিত একটা লেখাও আমার কয়েকটি পোর্টালে এসেছে। সেজন্যই লেখাটা পড়তে গিয়ে চক্ষু চড়ক গাছ! আমি জানি বাংলাদেশে ধর্ম ব্যবসা করে, ধর্ম বেচে খায় এরকম সম্প্রদায়ের অভাব নাই। আর বাংলাদেশে এমন মুসলমানেরও অভাব নাই যারা সত্য মিথ্যার বিচার না করে হুজুর বেটা যা বলেছে তাতেই বেশ কিংবা চিরন্তন সত্য, এমন ভাবনার!
বিজ্ঞাপনটি যখন দেখলাম আমার কাছে কোনভাবেই মনে হয়নি এটা দৃষ্টিকটু, বিব্রতকর কিংবা অশালীন। বিজ্ঞাপনটি ছিলো এরকম, একজন বোন তার মাসিকের সময়ে একটু মানসিক দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত, স্যানিটারি ন্যাপকিন কীভাবে কিনে আনবে তা ভেবে মনে হচ্ছে কিছুটা উদ্বিগ্ন। কিন্তু তার ভাইকে সে খুলে বলতে দ্বিধা করছিল দেখে ভাই এক পর্যায়ে বুঝে যায় এবং তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করে। অনলাইনের মাধ্যমে টোল ফ্রি লাইনে অর্ডার করে দেয়। যা একভাবে দেখলে ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম উদাহরণ।
আমি বিশ্বাস করি মাসিক কোন লজ্জার, লুকানোর কিংবা হাস্যকর বিষয় নয়। পাশাপাশি নারীর পাশে এই সময়ে পরিবারের সকলের এমনকি বন্ধুবান্ধব, স্কুলের শিক্ষক সকলেরই থাকা দরকার, এই বিষয়টিই প্রমোট করা হয়েছে এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। কোনভাবেই মনে হয়নি এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেক্সুয়ালিটিকে প্রমোট করা হয়েছে। আমার মাসিক হয়েছে, আমার ভাই আমাকে ন্যাপকিন কিনে এনে দিয়েছে, তাতেই কি আমার প্রতি ভাইয়ের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টশন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে? নাকি মুমিনগণ, আপনাদের শরীরে সমস্যা দেখা দিয়েছে টিভিসির মেয়েটাকে দেখে বা মেয়েটার যৌনাঙ্গের ইমাজিনেশন করে, যা বলতে পারছেন না। তাই এমন সেনোরা বর্জনের পোস্ট দিয়ে দিলেন এবং প্রচার চালাতে লাগলেন!
মাসিক নারীদের একটা খুব স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক এবং নিয়মিত বিষয় ব্যাপার। এর সাথে নারীর সন্তান জন্মদানের একটা যোগসূত্র আছে। নারীর প্রজনন ক্ষমতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এইটি। হ্যাঁ, আমরা নারী, আমাদের মাসিকের রক্ত আমাদের যৌনাঙ্গ দিয়েই বের হয়। আর আপনিও আপনার মায়ের এই যৌনাঙ্গ দিয়েই বের হয়েছিলেন। তাহলে আপনি অপবিত্র হয়ে যাননি?
আপনি পুরুষ আপনি জানেন না একজন নারীর প্রতি মাসেই মাসিক হয়? আপনার মতো আমি বোধ করি সকল পুরুষরাই এইটা জানে। কিন্তু যা জানে তা ভুল জানে। তারা এটাকে লজ্জার, লুকানোর বিষয় হিসেবে জানে। আর এজন্যই কোনো কারণে নারীর জামার পিছনে যদি রক্তের দাগ লেগে থাকে তা নিয়ে হাসাহাসি করে, নানা কটু মন্তব্য করে। মুমিন সাহেব এটা আপনাদের দৃষ্টিতে খুব জায়েজ, তাই না? কিন্তু একজন ভাই যখন বোনকে সেনোরা বা অন্য কোন ন্যাপকিন কিনে এনে দিচ্ছে বা দিতে সহায়তা করছে, তাতেই আপনার মনে হলো এইটা জেনা করার শামিল। আর আপনি তাই একটা হাদিস ও সাথে জুড়িয়ে দিয়েছেন যেনো আবাল, মূর্খ বাঙালীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু কেন? ভাই-বোন, মেয়ে-বাবা জেনা করা নিষিদ্ধ বলেই জানি ইসলাম ধর্মানুযায়ী। তাহলে এমন বিকৃত চিন্তা আপনাদের মাথায় কিংবা ভাইদের মাথায় কিংবা বাবাদের মাথায় আসবেই বা কেন? ভাইবোনের সম্পর্ক ভালোবাসার, সৌহার্দ্যের। এখানে কোনো পাপাচার যেমন থাকে না, তেমনি ভাবাটাও অন্যায়, পাপ, এই হাদিস আপনি পড়েননি? এটা আপনাদের মগজে বোধ করি নাই, তাই না?
আপনি ইমাজিন করতে বলেছেন পিতা সন্তানকে সেনোরা কিনে দিচ্ছে, পেন্টি কিনে দিচ্ছে! করলাম ইমাজিন, কিন্তু কই, কিছুই তো হলো না আমার! এইখানেই আপনাদের মতো মুমিন ধ্বজাধারীদের, লেবাসধারীদের সাথে আমাদের পার্থক্য। আমরা যেকোনো বিষয়ে ইমাজিন করে আপনাদের মতো জিভে জল নিয়ে ঘুরি না। আর নারীর ভ্যাজাইনার কথা মনে করেই শিশ্ন উঁচু করে তুলি না। আর আপনিই বা ঠিক করে দেবার কে আমি নারী আমাকে কে সেনোরা কিনে এনে দেবে, কে পেন্টি কিনে এনে দেবে? সঠিক মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আমার অধিকার। আমার অধিকার নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতাও আমার আছে। তাই আমি ঠিক করবো আমার ন্যাপকিন কে কিনে এনে দেবে আমার মা, ভাই, বোন নাকি বাবা অথবা স্বামী বা ছেলে বন্ধু।
বন্ধ করুন এমন বিকৃত চিন্তা, এমন বিকৃত ভাবনা। তাহলেই দেখবেন আপনারাও ভাবতে পারছেন মাসিক কোন লজ্জার বিষয় নয়, লুকানোর বিষয় নয়। নারীর যৌনাঙ্গ কোন গোপন অঙ্গ নয়। হাত, পা ,নাক মুখের মতো এটাও স্বাভাবিক একটা অঙ্গ।
আপনাদের এরকম পোস্ট-ই বরং ভাই এবং বোন কিংবা বাবা-মেয়ের মাঝে সে সেক্সুয়াল সম্পর্ক হতে পারে তাকে প্রোমট করে, এই বিজ্ঞাপনটি নয়।। তাই আসুন ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করে মানবতার ধর্মে বিশ্বাসী হই।
উন্নয়ন কর্মী।