আফরোজা আলম:
আধুনিক এবং চরম সভ্যতার যুগে বসবাস করেও চলছে এক নীরব নির্যাতন। আর সে নির্যাতন চলছে একান্ত নিভৃতে, গৃহে চার দেয়ালের ভেতরে।
নির্যাতন শব্দের সাথে দৈহিক নির্যাতনের কথা স্বভাবতই মনে আসে। কিন্তু না, এই নির্যাতন যতটুকু মানসিক, ততটুকু শারীরিক নয়। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন যিনি, ডাক্তারের ওষুধে ভালো হয়ে উঠার সুযোগ থেকে যায় তার। মানসিক নির্যাতন ক্ষয় করে মনকে, পঙ্গু করে দেয় এবং অথর্ব করে দেয় তার চিন্তা আর চেতনাকে।
এর শিকার হচ্ছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারী। উচ্চবিত্তেও আছে, নিম্নবিত্তেও অনেক আছে। তবে সেক্ষেত্রে দেখা যায় সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁদের অনেক কম থাকে। এই নির্যাতনের নাম ‘পরকীয়া প্রেম” ইংরাজিতে যাকে বলে extra-marital affair.
এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে পারি ব্যাপারটাকে।
অতীতের নির্যাতন, ধর্মীয় প্রভাব, সামাজিক প্রেক্ষাপট সর্বদাই নারীর বিপক্ষে অবস্থান, এবং পরিত্রাণের পথ ইত্যাদি।
অতীতে মানসিক নির্যাতন পর্যালোচনায় দেখা যায় জমিদার প্রথা, রাজা বাদশাহ বা এইসব উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিগণ মনোরঞ্জনের জন্য কর্মকাণ্ড করতেন বহির্বিশ্বে বা নিজ দেশে, এজন্য তাদেরকে কোন অপরাধি বলে গণ্য করা হতো না। তাদের এক বা একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাদের মনোরঞ্জনের জন্য ছিল বাগানবাড়ি। ছিল রক্ষিতা, ইত্যাদি।
অবধারিতভাবে তাদের স্ত্রীরাও এইসব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন সারাজীবন। যেন তারা ধরেই নিয়েছিলেন নারীমাত্রই সম্ভোগের বস্তু। স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাই তারা স্বামীগণের বহুগামিতাকে মন্দ চোখে দেখার সাহস করেননি।
অতীতে এই রকমভাবে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করে রক্ষিতা বা বাঈজী রাখা হতো। রাজা বাদশাহ বা জমিদারগণ তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য অধিক সময় সেখানেই ব্যয় করতেন।
রাজা, বাদশাহ’র স্ত্রীরা একপ্রকার জড়বস্তুর মতোই নানান সাজসজ্জায় নিজেদের ব্যস্ত রাখতেন। একসময় তাদের রাজত্বের অবসান ঘটে। অবিভক্ত ভারতে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হয়। সেই সাথে সভ্যতার আলো প্রবেশ করতে শুরু করে। একদিকে ইংরেজ রাজত্ব দমন নীতি চালিয়েছিল, কিন্তু কিছু সভ্যতার আলো আমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছিল তা অতি সত্য কথা।
বর্তমান সভ্যতার আলোকে এই আলোচ্য বিষয়টা প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্বামী অফিসে যান বা কর্মক্ষেত্রে, যার যেখানে অবস্থান, সেখানে নারী সহকর্মী থাকেন অথবা যেখানে থাকেন না, সেখানেও দেখা যায় অনেকক্ষেত্রে পরকীয়া প্রেমে আসক্ত হন। হয়তো প্রশ্ন হবে, ব্যাপারটা তো একতরফা হয় না। দুই বা ততোধিক জনের জড়িত হয়েই ঘটনা ঘটে থাকে। মেনে নেয়া যায় যুক্তি।
স্বামী ঘরে ফেরেন, কিন্তু অশান্তির কালো মেঘ ধীরে ধীরে ঘনীভূত হতে থাকে। স্ত্রীর প্রতি নানা কারণে অবহেলা শুরু হয়। চার দেয়ালে আবদ্ধ গৃহবধুটা নিষ্পেষিত হতে থাকেন। তাদের মাঝে কলহ বিদ্বেষ শুরু হয়। আর স্ত্রী যদি হন স্বামীর উপার্জনে নির্ভরশীল তাহলে তো কথাই নেই। অশান্তি এমন চরম আকার ধারণ করে যে স্ত্রীকে একসময় বাধ্য করা হয় গৃহত্যাগে।
ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায় সম্পূর্ণ দোষ গিয়ে পড়ে স্ত্রীর উপরে। বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটলে সন্তানদের মাঝে দেখা যায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা বোধ। তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। স্ত্রীরাও সামাজিকভাবে হেয় হতে থাকেন। শোনা যায় নানা কথা। একান থেকে সে কান। স্ত্রীরাই নাকি স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে পারেন না, তাই স্বামীরা হন বহির্মুখী।
এইদিকে হুমায়ুন আজাদ কী বলেছেন তা পর্যালোচনা করে দেখা যাক।
“পুরুষ নারীকে গৃহে বন্দী করেছে, তাকে সতিত্ব শিখিয়েছে, সতিত্ব নারীর জীবনের মুকুট করে তুলেছে, যদিও লাম্পট্যকে করে তুলেছে নিজের গৌরব। পুরুষ উদ্ভাবন করেছে নারী সম্পর্কে একটি বড় মিথ্যে, যাকে সে বলেছে চিরন্তন নারী। তাকে বলেছে দেবী, শ্বাশ্বতী, কল্যাণী, গৃহলক্ষী, অর্ধেক কল্পনা;
কিন্তু পুরুষ চেয়েছে “চিরন্তন দাসী”। পশ্চিমে নারীরা শোষিত, তবে মানুষ-পুরুষ দ্বারা শোষিত; আমাদের অঞ্চলে নারীরা শোষিত পশু-পুরুষ দ্বারা। এখানে পুরুষেরা পশুরই গোত্রীয়, তাই বঙ্গীয়, ভারতীয়, আর পূর্বাঞ্চলীয় নারীরা যে শোষণ-পীড়নের শিকার হয়েছে, পশ্চিমের নারীরা তা কল্পনাও করতে পারবে না”।
[নারী- হুমায়ুন আজাদ-পৃঃ ১৫]
ধর্মীয় কারণগুলো আলোচনায় আনতে গেলে অনেক বিষয় এসে পড়ে অবধারিতভাবে। ইসলাম ধর্মের বা হিন্দু যে কোনো ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যেতে পারে বহুগামিতা, দাসীর সাথে সহবাসে সম্মতি প্রদান, একের অধিক বিবাহে অনুমতি, নারীর মানসিক নির্যাতনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
প্রশ্ন আসতে পারে যে অনেক পুরানো আমলে বা ১৪০০ সালে কী হয়েছিল, তা ছিল ভিন্ন কথা। এখনকার পটভূতিমে আসে না।
কিন্তু একথা কেউ অস্বীকার করতে পারি না, যে শিশুটি ধর্মীয় অনুশীলন করে এসেছে তার ছায়া বা তার প্রভাব বড় হয়ে উঠা যুবকের উপরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পড়বে না। যে দেশে ধর্মের উপরে ভিত্তি করে সংবিধান রচনা করা হয় সে দেশে কেন প্রভাব পড়বে না? নিশ্চয় বলা যেতে পারে ষোল আনা প্রভাব পড়বে। ধর্মীয়ভাবে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত নারীকে কীভাবে দমন করে রাখা হবে, সেই নির্দেশ দেয়া আছে।
এই প্রসঙ্গে কিছু কথায় আসা যাক-
“বাঙালী সমাজকে অবদমিত কাম-দিয়ে ঘেরা সমাজও বলা যায়; এবং ওই অবদমন নিয়মিতভাবে প্রকাশ পায় ধর্ষণরূপে। তবে শয্যায় তাদের আচরণ সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। বাঙালী নারী-পুরুষের কাম জীবন সম্পর্কে আলফ্রেড কিনসের Sexual Behavior in the Human Male (1948) and Sexual Behavior in the Human Female (1953), বা মাস্টার্স এন্ড জনসনের Human Sexual Responses (1966) মতো বই লেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, তবে এ বিষয়ে যে কিছুই লেখা হয়নি, তাতে বোঝা যায় বাঙালীর কাম জীবন সুস্থ নয়। যা গোপন করে রাখা হয় তা সাধারণত অসুস্থ হয়ে থাকে।
এটা নিষিদ্ধ বিষয়; আর এর পীড়ন ভোগ করে নারী। বাঙালী নারীর যৌন জীবন বলাৎকার ও চরম বিরক্তির অবসাদের সমষ্টি। উচ্চশিক্ষিত কিছু নারী আমাকে জানিয়েছেন, তাঁরা পুলক সম্পর্কে কিছু জানেন না, তাদের স্বামীরা লাফ দিয়ে উপসংহারে পৌঁছেন, এই তাদের চাঞ্চল্যকর কামজীবন। দরিদ্র অশিক্ষিত নারীরা সাধারণত ভোগ করে স্বামীর বলাৎকার। বাংলাদেশের প্রতিটি শয্যাকক্ষ যদি থাকে, নারীর জন্য অবসাদ কক্ষ বা বিরক্তিকর অবসাদ কক্ষ। [নারী-হুমায়ুন আজাদ পৃঃ ২২৭]
এই থেকে আমরা জানতে পারি একান্ত ভেতরের গোপন কথা যা বাইরে কম প্রকাশ পায়। পেলেও ছিঃ ছিঃ রব উঠবে। জানা মতে একজনের কাহিনী তুলে ধরা যাক –
স্বামী বহুগামী। এবং স্ত্রী স্বামীকে অত্যন্ত ভালো বাসেন। স্বামী গৃহকর্মির সাথে শয়ন করতে বা সহবাস করতে পছন্দ করতেন (অবশ্যই অগোচরে)। তাই স্বামীকে কাছে পাবার জন্য স্ত্রীটি গৃহকর্মির কাপড় পরিধান করে স্বামীর কাছে নিজকে উন্মোচিত হতেন। কেননা ঐ গৃহকর্মির কাপড়ের গন্ধ ছাড়া স্বামীর কাম উদ্রেক হয় না। বিয়ের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক, বিয়ের পর হয়ে পড়ে অতি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। অথচ ভালোবাসার প্রথম শর্তই হচ্ছে বিশ্বাস।
ভালোবাসা বোধকরি একটা আভিধানিক শব্দ হয়ে গিয়েছে। পরিশেষে এই বলে শেষ করি-
‘তুমি আমায় বিশ্বাস দাও
আমি তোমায় রঙ্গীন জীবন দেব”।