গোধুলী বেলার একটুখানি আলো

বাসন্তি সাহা:

উর্মি আর আসে না। গত চার বছরে উর্মি আমার, আমার ছেলে-মেয়ের খুব ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছিল। উর্মি একজন স্পেশাল টিচার, শুধু টিচার নয়, নির্ভরযোগ্য অসাধারণ এক মেয়ে। সিঙ্গল মাদার। তিন মাসের টাকা দিয়ে না করে দিয়েছি। এমনি করে না করেছি রূপাকে, শান্তাকে, স্বপনদা আর সাহায্যকারী শারমিনকেও। অনেককেই হয়তো বলবেন, কেন রেখে দিলেন না? সত্যি যদি পারতাম!

মানুষের প্রতি ভালবাসা বড় কষ্ট দেয়। হৃদয়ের মধ্যে বেড়ে ওঠা অদম্য এই আলোর, এই ফুলের পাপড়ির কোনো রঙ নেই। কিন্তু প্রকাশ বড় রঙিন, আনন্দের। হৃদয়ের কোনে জন্ম নিয়ে ক্রমশ সে দিনে দিনে ছড়িয়ে যায়। বেড়ে ওঠে ডালপালা নিয়ে। তাই তাকে তুলে ফেলতে যে কী কষ্ট! কতবার কতদিন এসে বলেছে, আন্টি এখন একটু শুয়ে থাকেন, আমি তো আছি। অথবা চায়ের কাপ হাতে তুলে দিয়ে বলেছে সবসময় তো আপনিই দেন। আজ আমি আপনাকে দিলাম। প্রতি মুহূর্তে ভাবি রূপা ও উর্মি দুজনেই সিঙ্গল মাদার। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একাই লড়ে যাচ্ছিল মেয়ে দুটোকে মানুষ করার জন্য। কী আত্মবিশ্বাস দেখেছি তাদের চোখে মুখে! কিন্তু কোনোভাবেই তাদের পাশে আমি থাকতে পারলাম না। ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’। কেবল শুনেই গেলাম।

আমরা যারা পলায়নবাদী, মানুষের পাশে দাঁড়ানোতে অসহায়তার অজুহাতে মুখ লুকোতে চাই , নিজে ভালো থেকে দূর থেকে কান্নার ইমো দিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চাই, অথবা বলি বাচ্চারা ছোট তাই, না হলে কতকিছু করতাম! তাদেরও সময় এসেছে ভাবার নিজেকে নিয়েও। যখন অতি আপনজন স্ত্রী, সন্তান আক্রান্ত বাবাকে খাবার না দিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখবে, মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত। অনেক ডাকাডাকি করার পরেও কেউ এগিয়ে আসবে না্। তাদের জন্য সেইদিন অপেক্ষা করছে। করোনার চেয়ে এই অমানবিক, দানবিক রূপ ভয়ঙ্কর। দু’বছর, পাঁচবছর পরে হয়তো করোনার থাবা আমরা কাটিয়ে উঠবো কিন্তু মানুষের এই রুপ কাটানো সহজ হবে না।

এই দুর্ভাবনার সময়ে গোধুলীবেলার একটু আলোর মতো দুই একটি সংবাদ আমাদের আশা জাগায়। আত্মীয় সন্তানরা যাকে ছেড়ে গেলো তাকে দাহ করছে একজন অনাত্মীয়, ভিন্ন ধর্মের মানুষ। এমন দু’একটা খবরে যন্ত্রণার উপশম হয়, অবসান হয় না। যেনো বিষন্ন প্রদীপগুলো শেষরাতে আস্তে আস্তে নিভে যেতে থাকে। তবু সেই একশটার মধ্যে নব্বইটা নিভে গেলেও দশটা প্রদীপ টিম টিম করে জ্বলে, তবে বাকিদেরও বেঁচে থাকার সাধ হয়।
মাঝে মধ্যে এও ভাবি, এটা কী আমাদের বানানো? কেউ এভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে নাতো! বাইরে বের হলে সাধারণ মানুষের যে চলাচল তা দেখেতো মনেই হয় না আমরা একটা এমন অস্থির, আশঙ্কার সময় কাটাচ্ছি। হয়তো এটাই আসলচিত্র। তাহলে যে মানুষগুলো মারা যাচ্ছে প্রতিদিন! কোনটা সত্যি! ভাবনাগুলো নির্ঘুম রাতগুলোকে কেবল বিভ্রান্ত, বিষন্ন করে তোলে।

আমরা শুধু ঘরে বসে টেলিভিশনের স্ক্রিনে ফেরিঘাটে, দোকানে, বাজারে মানুষগুলোকে দেখে তাদের বোধ-বুদ্ধি নিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। ভাবি না খেয়ে ঘরে বসে মরুক বরং কেনো বাইরে বের হবে! আমরা যারা লকডাউনে ঘরে বসে দেখছি তাদের কাছে পুরোটাই দৃশ্য, অনুভূতি আর উপলদ্ধির আবছায়া প্রকাশ, সত্যটাকে এড়িয়ে যাওয়ার একটা ছোট্ট প্রয়াস। আমরা জানি মানুষগুলো খাবে কী ঘরে থাকলে? কারণ এই আগুনের আঁচ আমাদের দিকেও আসছে একটু একটু করে।

সময় সমস্ত ক্ষতকে প্রলেপ দেয়। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের জীবনে সবকিছুর সাথে এই উপলব্ধি, এই অসহায়তা কী একেবারে মুছে ফেলতে পারবো? করোনা চলে গেলেও? যারা বলছে ভাবছি না চিন্তা করছি না। তারাও কী নিজেকে বোঝাচ্ছে নাতো! ‘ভেসে থাকতে পার যদি সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়, না পারতো বিনা বাক্যে টুপ করিয়া মরিয়া যেয়ো। এটা কিছু অপূর্ব নয় ঘটনা সামান্য খুবই। আবার এটাও তো ঠিক ‘‘শঙ্কা যেথায় করে না কেউ সেখানেই হয় জাহাজ ডুবি’’।

বাসন্তি সাহা
উন্নয়ন কর্মী
[email protected]

শেয়ার করুন: