Run Like A Girl

আলী আজগর রাকিব:

আপনাকে যদি কেউ বলে মেয়েদের মত দৌড়াও তাহলে আপনার রিএকশন কেমন হবে?

ফেসবুকে একজন পোস্ট দিয়েছেন মেয়েদেরকে উদ্দেশ্য করে। পোস্টের বিষয়বস্তু হলো, আপনার স্বামী-সন্তানের পরিচয় বাদ দিয়ে আপনার আলাদা পরিচয় আছে কিনা? আপনার হয়তো নিজের কোনো আলাদা পরিচয় নেই, কিংবা নিজের পরিচয় তৈরি করার যোগ্যতা নেই, কিংবা নিজের পরিচয় তৈরি করার ইচ্ছা-সুযোগ নেই। কিন্তু কোনো মেয়ে যখন নিজের পরিচয় তৈরি করার জন্যে লড়ছে, তখন তাকে আপনি বাজে কথা বলছেন। তাকে নিরুৎসাহিত করছেন, অনেকক্ষেত্রে অপমান করছেন।

এই পোস্টের কমেন্ট সেকশনে সম্ভবত মেয়েদের উপস্থিতি বেশি ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই অপমান বোধ করছিল। তাদের বক্তব্য, এখানে গৃহিণীদের অপমান করা হয়েছে। ছেলের খাতিরে, স্বামীর খাতিরে, সুন্দর সংসারের জন্যে মেয়েদের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে পুরোপুরি গৃহিণী হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। এমন করা উচিত মেয়েদের। মা-দাদীরা করে এসেছে, আমাদেরও করা উচিত। আলাদা পরিচয়ের দরকার নেই, ছেলের-স্বামীর পরিচয়ই তাদের পরিচয়। অনেক পুরুষেরও কমেন্ট ছিল। তারা আরও কিছু যুক্ত করেছিল, যেমন, তাদের কাছে তাদের বউ প্রাইম মিনিস্টার, তাদের কাছে রানী, তার বউয়ের তার চেয়ে ভালো চাকরির যোগ্যতা থাকলেও সে পুরোপুরি গৃহিণী হয়েছে নিজের ইচ্ছায় এবং সে কারণে তারা সুখের সংসার করতে পারছে। তারা এবং তাদের বউ এ কারণে লজ্জিত না, বরং গর্বিত।

কেউ যদি নিজের ইচ্ছায় গৃহিণী হয়, অন্যদের সেখানে কিছু বলার উচিত নয়, যেমনটা কোনো চাকরিজীবী নারীদের ব্যাপারে অন্যদের নাক গলানো উচিত নয়। তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, তাদের ইচ্ছাটা কতটুকু তাদের?

আমরা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারে পরে আলোচনা করবো। আপাতত প্রথমে করা প্রশ্নতে ফিরে যাই। আপনাকে কেউ ‘মেয়েদের মতো দৌড়াও বললে আপনি কী করবেন?’ সর্বাধিক ক্ষেত্রে একটা ব্যাঙ্গের হাসি ফুটে উঠবে। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে আপনি দৌড়ে দেখাবেন।

কেন এমনটা করবেন?

হাস্যরসের সাথে উত্তরটা হবে হয়তো, কারণ মেয়েরা এমন করেই দৌড়ায়। আমি আশা করছি আপনি যদি এরকম মত প্রকাশ করেন, সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ আপনাকে সমর্থন করবে এবং অবশ্যই সেখানে মেয়েরাও থাকবে।

আমি আবার যদি প্রশ্ন করি, কিন্তু কেন?

আপনি চাইলে ‘মেয়ের মতো দৌড়াও’ শোনার পর একজন মেয়ে এথলেট যে খুব দ্রুত দৌড়ায় তার মতো দৌড়ে দেখাতে পারতেন, কিন্তু আপনার মাথায় সেটা আসেনি। আপনার মাথায় ‘মেয়েদের মতো দৌড়াও’ কথা শোনার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনে হবে আপনাকে দুর্বলভাবে দৌড়াতে বলা হচ্ছে। একজনকে মেয়েকেও যখন বলা হয়, মেয়েদের মতো দৌড়াও তখন সে ঠিক এটাই ভাবে। কারণ সমাজে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মেয়েরা দুর্বল। তারা দ্রুত দৌড়াতে পারে না। আপনি আস্তে দৌড়ালে আপনার আশেপাশের মানুষজন বলবে,’তুই তো ব্যাটা মেয়েদের মতো দৌড়াস। জোরে দৌড়া’। এই কথা আপনার বোনও শুনছে। শুনে বুঝতে পারছে, সমাজের প্রচলিত নিয়ম হলো মেয়েদের ধীরে দৌড়ানো নিয়ম। কারণ তার দিকে, শরীরেো দিকে মানুষজন তাকিয়ে আছে। তাকে দ্রুত দৌড়ানো চলবে না। তাকে খুব ধীরে, ক্ষেত্রবিশেষে মেকি ঢং করে দৌড়াতে হবে। এটা মেয়েলি আচরণ!

আমি গ্রামে বড় হয়েছি। আমার বোন-কাজিন ছিল আমার থেকে বয়সে বড়, সমবয়সীও অনেকে ছিল। আমরা সবাই মিলে গোল্লাছুট খেলতাম। তখন আমার বোন-কাজিন অনেকেই ক্লাস সেভেন-এইটে পড়তো। আমরা ছেলেমেয়ে সবাই একসাথেই খেলতাম। যারা দশ বছর আগেও গ্রামে শৈশব কাটিয়েছেন, তাদের অনেকেই হয়তো বোন-চাচাতো বোন-পাড়তুতো বোনদের সাথে খেলেছেন। আমাদের গোল্লাছুট খেলাতেও আমাদের মধ্যে অনেক মেয়েই ছেলেদের থেকে দ্রুত দৌড়াতো। আমার সে বোনদেরও যদি কাউকে বলা হয় ‘মেয়েদের মতো দৌড়ে দেখাও’ তারাও এখন ধীরে দৌড়ে দেখাবে। কারণ মেয়েরা এভাবেই দৌড়ায়, ধীরে-লোক চক্ষু আড়াল করে। তারা ভুলে যাবে তাদের শৈশব-কৈশোরের দৌড়ানোর কথা। কিন্তু একদিন আমার সে বোনেরাই আমাদের থেকে দ্রুত দৌড়াতো, গোল্লাছুট খেলায় নেতৃত্ব দিত!

এখন চলুন, আমাদের অমীমাংসিত বিষয় এর দিকে নজর দেই। এই যে মেয়েরা বিয়ের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে বা যোগ্যতা থাকার পরও চাকরি-বাকরি-ব্যবসা কিছুই করছে না, বরং নিজেকে আরও গুটিয়ে নিচ্ছে। দিন দিনে পরিণত হচ্ছে স্বামীর স্ত্রী, সন্তানের মা, শ্বশুরবাড়ির পুত্রবধূ হিসেবে কতটা তাদের নিজের ইচ্ছায় করছে?

আমার স্কুল লাইফের একজন বান্ধবী, আমাদের সকল বান্ধবীদের থেকে সবচেয়ে প্রাণবন্ত ছিল, তার বিয়ের পর সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যতদিন না স্বামী নিজে নতুন ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছে ততদিন স্বামীর আইডি দিয়ে ফেসবুকে এসেছে! বিয়ের আগে সে এমন ছিল না, বিয়ের পর কেন এতো পরিবর্তন?

এখানেও আমাদের সমাজের সেই তথাকথিত ‘ভালো মেয়ের ধারণা!’ সমাজের প্রচলিত নিয়ম-ধ্যান ধারণা অনুযায়ী ভালো মেয়েদের বিয়ের পর কাজ হলো স্বামী-সেবা, শ্বশুরবাড়ির মানুষের সেবা এবং বাইরে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। এরকম করলে আপনি ভালো মেয়ে, নাহলে চারপাশে আপনার বিভিন্ন কুৎসা শুনতে পারবেন। অনেক ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়ির মানুষজন সরাসরি মেয়েদের চাকরিতে বাধা দেয়, স্বামীরা বোঝায় সন্তান মানুষ করার জন্যে তার চাকরি-বাকরি-ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা জরুরি!

সন্তান শুধুই একজন মেয়ের, তাকে মানুষ করা দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে একজন মেয়েকে তার ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হবে! এরকম আরও সুন্দর সুন্দর যুক্তি আপনি চারপাশে শুনতে পাবেন। আপনাকে উদাহরণ দেওয়া হবে আপনার মা-দাদীর, যারা সেবাদাসী ও সন্তান উৎপাদন করে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বিসর্জন দিয়ে সারা জীবন হেঁসেল ঠেলে গেছে। পুরুষ বোঝাবে আপনি তার প্রাইম মিনিস্টার, তবে যা বলবে না তা হলো, আপনার লাইফের প্রতিটা সিদ্ধান্তের জন্যে আপনাকে আপনার স্বামীর মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হবে।

আপনি নিজের ইচ্ছায় চাকরি-বাকরি ছেড়ে বিয়ের পর গৃহিণী হয়েছেন। আমার আপনার কথাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ছোট্ট একটা প্রশ্ন আছে,
গৃহিণী হওয়া ছাড়া আপনার আর কোনো উপার ছিল কি?

(একটা ভিডিও লিংক দিলাম নিচে। ভিডিওতে কয়েকজনকে ‘মেয়েদের মতো দৌড়ে, মেয়েদের মতো মারামারি করে দেখাতে বলা হয়। তাদের প্রতিক্রিয়া আর মতামত দেখতে পারবেন এতে।)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.