জিন্নাতুন নেছা:
মে মাস মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মাস এবং ২৮ মে সারা বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে থাকে মিন্সট্রুয়াল হাইজিন দিবস।
আজ থেকে ১৫ কিংবা ২০ বছর আগেও হয়তো মাসিক নিয়ে এমন করে খোলামেলা কথা বলার স্পেস বলেন, সাহস বলেন কোন কিছুই একজন নারী হিসেবে আমার অন্তত ছিলো না। বোধকরি কোন নারীরই ছিলো না। আমাদের মা, খালা, চাচি, বোনরা এমন শিক্ষা আমাদের দিতো না। বলতো মাসিক মানেই লজ্জার বিষয়। নারীর মাসিক হলেই পুরুষরা হাঁটা দেখলেই বুঝতে পারে, তাই চলাফেরাও বারণ ছিলো। এই ২০২০ এ দাঁড়িয়ে যখন নারীর মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে সরগরম অবস্থা তখন আমি যেমন ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়াচ্ছি, তেমনি পরিবর্তন আদৌ কতটুকু বাস্তবতার ছোঁয়া পেয়েছে নাকি কেবলই কাগজে কলমে হয়েছে তা খুব ভাবাচ্ছে আমায়।
আমি যখন প্রথম ঋতুবর্তী হই ঘটনাটি ছিলো এরকম “আমি তখন ৭ম শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলে যাবার জন্য স্কুল ড্রেস পরে আমি যথারীতি রেডি হয়ে গেছি। কিন্তু এমন সময় আমার ভ্যাজাইনা শুধু ভেজা ভেজা লাগছিলো। এভাবে ৩-৪ বার আমি বাথরুমে যাই আর বের হই। বলা বাহুল্য এই সময় আমি থাকতাম মেসে আমার কাজিনের সাথে। আপা বললো, কী হয়েছে রে তোর? আমি ভয়ে লজ্জায় কিছুই বলতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিলো আমার ভ্যাজাইনাতে কি জোঁক লেগেছে যে এতো রক্ত বের হচ্ছে? আমি ভয়ে রীতিমতো ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছি। আর কান্না করছি। আপু দরজা ধাক্কালেও আমি খুলছি না।অবশেষে বাথরুমে রক্তের স্রোতধারা দেখে আপু বুঝতে পেরেছে আসলে কী হয়েছে? তখন আমাকে ডেকে নিয়ে উনি কাপড়ের এক টুকরা আর ফিতা দিয়ে বললেন এটা কীভাবে পরতে হয়? আরও বলেছিলেন, এইটা মাসিক। মাসের একটা নির্দিষ্ট সময় প্রতিটি নারীর এটা হয়। এই সময় বেশি দৌড়ানো যাবে না, সাবধানে থাকতে হবে। মাছ, মাংস না খাওয়ায় ভালো। তাতে নাকি আঁশটে গন্ধ হয়। এভবেই চলেছে আমার ২০০৭ সাল পর্যন্ত। এই কষ্টের আর অসচেতনতার দিনগুলো আজো আমায় শিউরে তোলে।”
বলে রাখা দরকার এই ট্যাবুগুলো থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি আমি যখন কলেজে পড়ি। অর্থাৎ ২০০৭ সালের পর। সেটাও এই ফেইসবুকের বিভিন্ন পোর্টালের লেখালেখি দেখে। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে জীববিজ্ঞান বই পড়ে।
এখন সময়ের বিবর্তনে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে নারীর মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নানান কাজ হচ্ছে, কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, কতটুকু কাজ হচ্ছে কাজের পরিসর কতটুকু?? পরিবর্তন কতটুকু?
যখন স্কুলে পড়তাম দেখেছি গার্হস্থ্য অর্থনীতি বইতে এই সম্পর্কিত যে চ্যাপ্টার থাকতো, সেটা বাড়ি থেকে পড়ে আসতে বলা হতো। আর ছেলেরা তো কৃষিশিক্ষা পড়তেন, তাই এটি তাদের দরকার নাই।
এমনকি জীববিজ্ঞান বইয়ে যে চ্যাপ্টার আছে এই বিষয়ে নারী কিভাবে গর্ভবতী হয়, এই গর্ভধারণের সাথে নারীর মাসিকের সম্পর্ক, ছেলে সন্তান হবে না মেয়ে সন্তান হবে এইজন্য কার ক্রমোজোম দায়ী তাও সযতনে এড়িয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু এই বিষয়গুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জানা অধিকার। কিন্তু জানানো হয় না। আমি হয়তো অনেক বছর আগের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলাম, কিন্তু আদৌ কি প্রেক্ষাপট খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে? আমার তো মনে হয় হয়নি।
খুব সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ হলো এমন যে, “কোভিড-১৯ নিয়ে একটি ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রোগ্রামে হাইজিন কিট প্যাকেট দেয়া হয়েছিলো এক বেসরকারি সংস্থা থেকে। যেখানে এক প্যাকেজে ৪ প্যাকেট সেনোরা স্যানিটারি ন্যাপকিন ছিলো। এইটার ডেমো সেশনে একজন পুরুষ দাদা লজ্জায় যেমন অডিয়েন্স এর সামনে কিছু বলতে পারেননি, তেমনি এক দিদিও কিছুই বলতে পারেননি। নারীর যে মাসিক হয় তা না বলতে পেরে বলছিলেন, “নারীর যে প্রতি মাসে ইয়ে হয় না”! এইজন্য এগুলা দেয়া হয়েছে। এই হলো ২০ বছরে আমাদের সমাজের পরিবর্তন। নানান আন্দোলনের ফলাফল।
মিন্সট্রুয়াল হাইজিন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় একট রমরমা ব্যবসার নাম। যেমন জেন্ডার টার্ম একটা এনজিওদের ব্যবসার নাম, ঠিক এটাও তাই। আপনি কোন এনজিওতে পিপি রেডি করতে চান তার সাথে কিছু অংশ জেন্ডার, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, নারীর মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এগুলো জুড়ে দিলেই আপনি ফান্ড পাবার জন্য পারফেক্ট।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য কয়টা এনজিও সংস্থায় নারীর জন্য মাসিক বান্ধব টয়লেট আছে?
যেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা হয়? যেখানে এগুলো ফেলার সুব্যবস্থাপনা আছে? এমনকি নারী যখন মাসিকের ব্যথায় কুঁকড়ে মরে যায়, কয়জন বস আছেন ঐ নারীকে সহমর্মিতার চোখে দেখেন কিংবা একবেলা ছুটি দেন? এমনকি সহকর্মী নারী থেকে পুরুষ সকলেরই বাঁকা চোখের অভাব নাই।
কিন্তু নারীর মাসিককালীন ছুটি কি নারীর অধিকার নয়? কর্মস্থলে মাসিক স্বাস্থ্য বান্ধব টয়লেট নারীর অধিকার নয়? কিংবা এই ব্যথায় কুঁকড়ে যাবার মূহুর্তে একটু সহমর্মিতা কি নারী তার সহকর্মীদের থেকে পাবার অধিকার রাখে না?
এই হলো বাংলাদেশের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বেশিরভাগ এনজিও এর চিত্র।
আর সরকারি পর্যায়ে নারীর মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নানান প্রকল্প নেয়া হয়েছে। স্কুল, কলেজগুলোকে মাসিক স্বাস্থ্য বান্ধব করা হচ্ছে।স্কুল,কলেজে স্যানিটারি প্যাড রাখা হচ্ছে যেনো মেয়েদের স্কুল, কলেজে গিয়ে মাসিক হলে তারা তা ব্যবহার করতে পারে। আবার অনেক বই, পুস্তকেও এই বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু নারীর মাসিক যে একটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, এই ব্যাপারে নারীর হাত নেই। এইটা খুব স্বাভাবিক এক ধরনের পরিবর্তন বয়োঃসন্ধিকালে নারী এবং পুরুষের সকলেরই এক ধরনের পরিবর্তন আসে যা নারীর জন্য মাসিক আর পুরুষদের জন্য ও অন্য কোন হরমোনাল পরিবর্তন। বই পুস্তকে যুক্ত হলেও আসলেই কি ছেলে এবং মেয়ে উভয়কে এই বিষয়ে খুব সহজভাবে বোঝানো হয় কিনা তা আমার বোধগম্য নয়? আবার অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় এই চ্যাপ্টারগুলো শিক্ষকগণ খুব সযতনে এড়িয়ে যান।
এই প্রেক্ষিতে একটা ঘটনা বলি, “কর্মের সুবাদে ৩০ জন কিশোর -কিশোরীর সাথে একটা ট্রেনিং প্রোগ্রামে কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো। যেখানে তাদের মধ্যে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার সময় আমি কোন ধরনের স্বাভাবিকতা দেখিনি তাদের বডি ল্যাংগুয়েজে। বরং তাদের চোখমুখে লজ্জার স্পষ্ট ছাপ দেখতে পেয়েছি।” তাহলে আদৌ পরিবর্তনটা কোথায়?
একজন আন্তর্জাতিক সংস্থায় নারী কর্মী ও যখন মাসিকের ব্যথায় কুঁকড়ে যাবার সময় তার সুপারভাইজার এর কাছে ছুটি চান আর ছুটির কারণ হিসেবে মাসিকের ব্যথা জানাইলে সুপারভাইজার বেটার ব্যঙ্গরসাত্বক চাহনি আপনাকে বলে দেয় আপনি এইটা না বললেও পারতেন। বলতেন স্যার, “আই এম সিক। সো আই ওয়ান্ট টু লিভ”। তাহলে পরিবর্তনটা কোথায়?
এমনকি নারীর মাসিক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রাজনীতিকরণের বড় একটা জায়গা। বলা হয় মাসিক হলে নারী অপবিত্র হয়ে যায়। অশুচি হয়ে যায়। এই সময় নারীকে ছুঁয়ে থাকলে প্রার্থন করা যাবে না। নারীর মাসিক ট্যাবু, এই সময়ে নারী রান্না করতে পারবে না, এই সময়ে নারী গোয়াল ঘরে যেতে পারবে না, এই সময়ে নারী ফসলী মাঠে যেতে পারবে না, এই সময়ে নারী গোরস্থানে যেতে পারবে না, ব্লা ব্লা ব্লা। কিন্তু এই মাসিক-ই নারীর আবার বিশাল ক্ষমতা, যার বলেই নারী ‘মা’ হয়। ৯ মাস পেটে ধারণকৃত সন্তান কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে নারীর এই তথাকথিত, প্রচলিত অপবিত্র রক্ত পান করেই একটু একটু করে বেড়ে ওঠে মায়ের পেটের মধ্যে। আপনারা পুরুষরা সকলেই এই রক্ত পান করেছেন এইটা কি অস্বীকার করতে পারবেন? প্রশ্ন রইলো। তাহলে আজ কেন নারী মাসিকের সময়ে অশূচি, অপবিত্র?
তাহলে কি রাজনীতিকরনের মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর মাসিককে কেবল সন্তান জন্মদানের উপায় হিসেবে চিহ্নিত করে নারীকে ঘরে আটকে রাখতে চায়?
সবশেষে বলবো নারীর মাসিক স্বাস্থ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা নারীর অধিকার, আমি নারী, আমার অধিকার।
এজন্য সকল স্কুল, কলেজ,পাবলিক টয়লেট, সকল বেসরকারি সংস্থা, সকল গার্মেন্টস থেকে শুরু করে নারীর সকল কর্মস্থলই মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। নারীকে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন দিতে হবে।
শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনে বাবা মেয়েকে সেনোরা কিনে দিচ্ছে এইটার মাঝে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ুক এই চিত্র এই উদ্যোগ নেবার সময় চলে এসেছে।
আসুন জোর দাবি তুলি মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আমি নারী আমার অধিকার।
জিন্নাতুন নেছা
উন্নয়ন কর্মী।