বাসন্তি সাহা:
আমার মেয়ে শ্রমণা। হঠাৎ ঘুমানোর সময় ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম নিয়ে এলো। কী করবে এটা দিয়ে? সে বললো, এ দুটো ডিম সে হ্যাচ করবে। তারপর চিক হবে। চিক দুটো তার ‘পেট’ হবে। কারণ মা কুকুর বা বিড়াল বাসায় এ্যালাও করে না। কিন্তু তার স্কুলে আপুরা ‘পেট’ নিয়ে লিখতে বলে। তখন তাকে ইম্যাজিন করে লিখতে হয়। সে আর মিথ্যে কথা লিখতে চায় না। তাই অনেক ভেবে সে ডিম হ্যাচ করার কথা ভেবেছে। আর সে ইউটিউবে দেখেছে মুরগি ছাড়াও ডিম থেকে চিক হতে পারে।
আমি প্রায় বাকরুদ্ধ! কোনটা বোঝাবো? ডিম হ্যাচ করা? নাকি ইম্যাজিন করা আর মিথ্যে বলা এক নয়? আর সে পড়ে ‘নালন্দা’য়। এই অদ্ভুত ভাষাই সে কোথায় পেলো? বাসায় আমি বা তাপস পরিস্কার বাংলায় কথা বলি। তারপর মনে হলো ও তো সবকিছু ইউটিউবে দেখেছে। এর বাইরের জগতটা তার কাছে নেই।
আমাদের সময় শৈশবটা অবারিত ছিল। তিনতলার খোলা ছাদে দাঁড়ালে মস্ত আকাশ। মনে হতো বাড়ির সামনে যে বড় রাস্তা তারপরে হাসপাতাল, তারপরে কুমোর পাড়ার শেষে বুঝি ঝুপ করে আকাশটা শেষ হয়ে গেছে। আকাশের শেষটা দেখতে আমি আর খুকু একদিন কুমোড় পাড়া ছাড়িয়ে গুরুধাম ব্রিজ হয়ে কবিরাজ বাড়ি পর্যন্ত গেলাম। না ওখানেও আকাশ শেষ হয়নি। আরও অনেকটা দূরে গিয়ে আমি আর খুকু ফিরে এসেছিলাম। হারিয়ে যাবার ভয়ে। কিন্তু আর একটু বড় হয়ে খুকু সত্যি হারিয়ে গেলো। ও এখন আর কোথাও নেই। কুমোড় পাড়া ছাড়িয়ে কাশবন পর্যন্ত গেলেও ওকে আর আমি খুঁজে পাবো না।
আজ শ্রমণা, বর্ণমালা ওর সব বন্ধুরা জানে আকাশের কোনো শেষ নেই। পৃথিবী মহাশূণ্যে ঝুলছে। বর্ণমালা ওর বাবাকে বলেছে, ‘বেঁধেছে এমনও ঘর শূন্যের উপর পোস্তা করে’ এটা নাকি লালন সাঁই পৃথিবী যে মহাশূণ্যে ঝুলছে সেটা নিয়ে লিখেছে। এমন মহাজ্ঞানী আমাদের সব সন্তানেরা। শ্রমণা এও জানে উট মরুভূমিতে প্রায় একমাস পানি না খেয়ে বাঁচতে পারে।
আমরা ছোটবেলায় পৃথিবীর সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের এতোবড় ব্যাখ্যা জানতাম না। আমাদের একটা কল্পনার জগৎ ছিল। আমাদের মন্দিরের চূড়োর বিরাট গরুর পাখি, ছাদের চিলেকোঠা, ঝোপানো ডাকুর ফুলের গাছ, পুরনো ঝাড়বাতি, পুকুর পারে মাছ রাঙার হঠাৎ মাছ তুলে নেয়া সবকিছু আমাদের ভাবনা জুড়ে থাকতো। আমরা বড়দের প্রশ্নও করতে পারতাম না। বিরক্ত হতেন বেশির ভাগ। একটু বড়রা আবার পড়া ধরে বিশেষ করে টেনস এর গঠন, ও বিভিন্নরকম জটিল ট্রান্সলেশন ধরে বিব্রত করার চেষ্টা করতেন। স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে চলতাম এদের।
আমাদের ছোটবেলা বারশ/বা একহাজার স্কয়ার ফিটের মধ্যে বদ্ধ ছিল না।। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা ছিল। বাবা-মা ও চোখে হারাতো না। ঘুরতে ঘুরতেই দেখেছি কুমোর কীভাবে চাকা ঘুরিয়ে মসৃণ হাঁড়ি তৈরি করে। হাঁপড় টেনে কামার কীভাবে দা-কাঁচি তৈরি করে। ধোপা কীভাবে কাপড় কাঁচে। কাঠুরে কীভাবে কাঠ কাটে। বৃষ্টি শেষে মাটির সোঁদা গন্ধ কেমন। বৃষ্টিস্নাত কদম কেমন। ঘাসবনে ফড়িং, প্রজাপতি কেমন করে উড়ে বেড়ায়, এই পাঠ আমরা প্রকৃতি থেকেই পেয়েছিলাম। কাউকে ধরে বোঝাতে হয়নি।
খুব সাধারণ অথচ কল্পনার জগৎ সবার ছিল। তাই সব বাঙালী ছেলেরা গোঁফ গজালেই বা প্রেমে পড়ে চাইলেই কবিতা লিখতে পারতো। অভিজ্ঞতা থেকে জানি তার মধ্যে দু’একটা ভালোও হতো। তাই আমরা ছোটবেলায় কোনটা মিথ্যে, কোনটা ইম্যাজিনেশন তা আলাদা করতে পারতাম। কিন্তু শ্রমণাদের চোখে যেটা ইউটিউবে নেই সেটা ইম্যাজিনেশন। আর সেটা মিথ্যেও। হয়তো বড় হয়ে বুঝতে পারবে।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী
[email protected]