মাসিকের কথা কীভাবে বোঝাবো বয়ো:সন্ধিকালের ছেলেমেয়েকে?

নাহিদ দিপা:

মে মাস পালিত হয় আন্তর্জাতিক পিরিয়ড মাস হিসাবে। আর ২৮ মে হলো মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ডে। মেয়েদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই মাসিক/পিরিয়ড নিয়ে লুকোছাপা করতে গিয়ে কেউ আমাদের বুঝিয়ে বলে না যে এটা খুবই স্বাভাবিক একটি শরীরবৃত্তীয় কাজ। তাই মেয়েরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুটিয়ে যাই, শত সমস্যা হলেও ডাক্তারের কাছে যেতে দ্বিধাবোধ করি। আর অসাবধানতায় মাসিকের দাগ কাপড়ে লেগে গেলে বা হরমোনের ওঠা নামায় মেজাজ একটু এদিক-সেদিক হলে ছেলেরা মজা করি, ঠাট্টা করে বলি ‘ওর মনে হয় বিশেষ দিন’।
অথচ ছোটবেলা থেকেই খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিলেই আর সংকোচে ভুগতে হয় না মেয়েদের। আর ছেলেরাও বুঝতে পারে পিরিয়ড কেবলই মেয়েলি লজ্জার ব্যাপার নয়।

নাহিদ দিপা

লকডাউনের এই সময়ে যখন বাসার দুই/তিন রুমের মধ্যেই সবাই কম-বেশি আটকে আছে আর রোজাও চলছিল, তখন অনেক বাড়ির মেয়েরাই এই মাসিক নিয়ে তীব্র সংকোচে ভুগেছেন, সে কথা অনুমান করতে পারি। আমার একটা প্রাইভেট গ্রুপ আছে মাসিক নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির, সেখানেও বিষয়টা নিয়ে আলাপও করেছেন কেউ কেউ। এই লকডাউনে স্যানিটারি প্যাড কিনতে যাওয়া, সেগুলো ফেলা, রোজা না রাখলে বাসার ছোট মেয়ে/ছেলের প্রশ্নের সামনে পড়া…সবই হয়েছে। মহামারীতে সব আটকায়, কিন্তু পিরিয়ড তো থেমে নেই। যে মেয়েটির এই লকডাউনে প্রথম পিরিয়ড হলো, তার কী মনের অবস্থা তা কি ভেবেছি আমরা?

কীভাবে বয়ো:সন্ধিকালের ছেলেমেয়েকে বুঝিয়ে বললে তারা পিরিয়ড/মাসিককে স্বাভাবিক হিসাবে দেখবে তা নিয়ে ভেবেছি অনেকদিন। সহজে বুঝিয়ে বলা যায় কীভাবে? ইউটিউব বা গুগল ঘাঁটলে অনেক কিছু পাওয়া যায়, যার বেশিরভাগই কঠিন কঠিন বায়োলজিক্যাল টার্মে লেখা বা বর্ণনা করা। কিন্তু তা দেখে কি একজন মা খুব সহজে তার ছেলে বা মেয়েকে বা বড়বোন ছোটবোন/ভাইকে বুঝিয়ে বলতে পারে?

সেই উপায় খুঁজতে গিয়ে নিজেও জানলাম অনেক কিছু। আমি জানতাম না পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের শরীরে একটা ছিদ্র বেশি আছে কেবল এই মাসিকের জন্য। পুরুষদের শরীরে ছিদ্র আছে আটটা, যার ছয়টাই মুখমণ্ডলে। চোখ-২, কান-২, নাক-১, মুখ-১। বাকি দুটো শরীরের নিচের দিকে-একটা দিয়ে আমরা পটি করি, আরেকটা দিয়ে ইউরিন। আর মেয়েদের আছে একটা বেশি, যেটা দিয়ে মাসিক হয় আর প্রাপ্তবয়স্ক হলে বাচ্চা হয়- সেটা হলো ভ্যাজাইনা।

যদি সর্দি হয়, কিংবা কান্না পায় তাহলে তা কী দিয়ে বেরিয়ে আসবে? মুখ দিয়ে নয়তো! সর্দি হলে বের হবে নাক দিয়ে। আর কান্না পেলে পানি বের হবে চোখ দিয়ে। শরীরের আর কি কোন অংশ আছে এর বিকল্প? কিংবা পটি বা ইউরিনেরও কি কোন বিকল্প আছে? নেই তো। এটাই তো নিয়ম, তাই না? ঠিক তেমনি বয়ো:সন্ধিতে পৌঁছালে একটা মেয়ের রক্তপাত হবে, মাসের নির্দিষ্ট একটা সময়ে শরীরবৃত্তীয় নিয়ম মেনে। এই রক্তপাতই হলো মাসিক। প্রতি মাসে হয় বলেই একে মাসিক বলে বা পিরিয়ডিক্যালি হয় বলেই একে পিরিয়ড বলে।

এখন বোঝা দরকার, কেন মেয়েদের মাসিক হয়! মেয়েদের মাসিক হয়, কারণ এই পৃথিবীতে সে যেন আরেকটা প্রাণ পৃথিবীতে আনতে পারে সেজন্য। প্রক্রিয়াটা সহজ করে বললে বোঝা যাবে, মেয়েদের পিরিয়ড হওয়াটা আসলে কতটা জরুরি। ছেলে/মেয়ে, দেশ/সমাজভেদে সব জায়গায় কমবেশি সবাইকে বোঝানো হয়, মাসিক বা পিরিয়ডের সময় যে রক্ত বের হয় তা হলো দুষিত রক্ত। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক এর উল্টো। একটা মেয়ে যখন জন্মগ্রহণ করে তখনই সে ৩০-৪০ লাখ ডিম্বাণু (অতিক্ষুদ্র বলেই ডিম না বলে ডিম্বাণু বলে) নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। তার বয়স যত বাড়ে, তার শরীর থেকে তা বের হয়ে যেতে শুরু করে। তখন কিন্তু তার রক্তপাত হয় না। প্রথম পিরিয়ডের আগেই তার শরীর থেকে প্রতি মাসে প্রায় ১১ হাজার করে ডিম বেরিয়ে যায়। সে যখন বয়ো:সন্ধিতে পৌঁছায় এবং প্রথম পিরিয়ড হয় তখন তার শরীরে থাকে কেবল ৩-৪ লাখ ডিম্বাণু।

তাহলে কখন ডিম বেরিয়ে গেলে তাকে আমরা মাসিক/পিরিয়ড বলবো? ৯-১৩ বছর বয়সের মধ্যে একটা মেয়ের যখন প্রথম পিরিয়ড হয় তখন তার শরীরের সবচেয়ে ভালো ডিম্বাণুটা বেরিয়ে যায়। অসংখ্য ডিমের মধ্য থেকে একটা ডিম্বাণুই জরায়ুতে ভ্রুণ হবার অপেক্ষায় থাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরও যখন সে ভ্রুণ হতে না পারে তখন সে শরীর থেকে বের হয়ে আসতে চায়। ওদিকে আমাদের শরীরের সবচেয়ে বিশুদ্ধ আর পুষ্টিকর রক্ত জরায়ুতে গিয়ে তার ভেতরে একটা আবরণ তৈরি করতে থাকে। যদি ভ্রুণ হয় তাহলে সে যেন তাকে আগলে রাখতে পারে, তাকে পুষ্টি দিতে পারে। যদি ভ্রুণ তৈরি না হয় তাহলে সেই আবরণ ভেঙেই ডিমটা বেরিয়ে আসে বলে রক্তপাত হয়। সেই রক্তই হলো মাসিক। যেহেতু রক্তের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসছে ডিম্বাণু, রক্তপাত তো হবেই, তাই না? মাসিকের রক্তে কিন্তু কেবল ডিমই থাকে না, থাকে সেই রক্তের দেয়ালও। আর রক্ত কিন্তু আমাদের পটি বা ইউরিনের মতো একবারে বেরিয়ে আসে না, ৫/৬ দিন ধরে একটু একটু করে বেরিয়ে আসে। আমি একজনের ভিডিওতে দেখেছি, তিনি বলছেন, আমাদের শরীরের সবচেয়ে বিশুদ্ধ রক্তটা বের হয়ে যায় পিরিয়ডের সময়। কারণ এই দেয়াল কিন্তু কেবল বাচ্চা ধরেই রাখে না, রক্তের এই দেয়াল থেকেই বাচ্চা পুষ্টি পায় নয় মাস ধরে। একটু একটু করে বড় হয়। গর্ভকালীন নয় মাস তো মেয়েদের পিরিয়ড হয় না। কেন হয় না? কারণ এই নয় মাসে পরিপুষ্ট রক্ত আস্তে আস্তে দেয়ালটাকে আরও মজবুত করে, যাতে বাচ্চাটা মায়ের পেটে সাঁতার কাটতে পারে, খেলতে পারে, হাত-পা ছুঁড়তে পারে।

ছোটদের কীভাবে মাসিক বা পিরিয়ড সম্পর্কে বলা যায় সেটা শিখতে গিয়ে আমি জানলাম অনেক কিছু। তেমনি আরেকটা জিনিসও জেনেছি, প্রতিটা মানুষের চেহারা, হাত-পা, চুল যেমন আলাদা আলাদা দেখতে, তেমনি প্রতিটা মেয়ের প্রজনন অঙ্গের কাঠামো এক এক রকম। আমরা মেয়েরা আমাদের মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য বা শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে যতটা সচেতন, ঠিক ততটুকুই অসচেতন এবং অজ্ঞ আমাদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে।

এবারের ‘মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ডে’ তে আসুন আমরা মেয়েরা আমাদের এই অঙ্গ সম্পর্কে জানি। ‘মাসিক/পিরিয়ড’ কেন হয়, সেটা জানি। আর করোনা ভাইরাস দূর করতে ‘স্বাস্থ্যসুরক্ষা’ শেখার পাশাপাশি শিখি কীভাবে ঠিকঠাক নিরাপদ মাসিক ব্যবস্থাপনা করতে হয়।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.