প্রশ্নহীন মাতৃত্ব এক অন্ধবিশ্বাস: দৃষ্টিভঙ্গি বদলান

সাদিয়া আফরিন:

১. মা-খালাদের মুখে প্রায়ই একটা শব্দ শুনি “ঢ্যাডঢ্যাড়ি”, যা বোঝায় গৃহকাজে অপটু, অলস, আনাড়ি এক নারী। যার সবকিছুই আধাখেঁচড়া। যে কোন তাল সামলাতে পারে না, একটা করতে যায় তো আরেকটা পড়ে থাকে। যদিও “ঢ্যাডঢ্যাড়ি”র সমরূপ কোন পুরুষবাচক শব্দ এখনও পর্যন্ত আমার কানে আসেনি। তো ২০১৭’র মে মাসের নয় তারিখের পর (পুত্রের জন্মের পর)থেকে আমার নিজেকে কেবলই একটা “ঢ্যাডঢ্যাড়ি” মনে হতে থাকে। মনে হয় কিছুই পারি না আমি। এটা করতে চাই তো ওটা ভুলে যাই। একটা করি তো আরেকটা ঝুলে থাকে। একটা ধরি তো ফেলে রেখে আরেকটা করি। কোন কাজকর্মই সিস্টেমের মধ্যে হয় না। দিনের পর দিন একটা কাজই কেবল আমাকে দিয়ে হয় – বেলা করে ঘুমানো (নিন্দার্থে)।

কিন্তু বেলা করে না ঘুমিয়ে উপায় কী? আমার পুত্র যেহেতু ভোররাত পর্যন্ত জেগে থাকে এবং বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে সেহেতু আমাকে ওর রুটিন ফলো করেই চলতে হয়। সে যতক্ষণ জেগে থাকে একটু পরপর খায়, নিয়মিত বিরতিতে ঘুমায়, টয়লেট করে, কৌতুহলি দৃষ্টিতে এই মহাবিশ্ব দেখে, স্বর্গীয় হাসি হাসে, এবং সামান্য অসুবিধা হলে চিৎকার করে জানান দেয়, সর্বোপরি মা’কে অহর্নিশি ব্যস্ত রাখে। এদিকে আমার ব্যক্তিগত সকল কাজ পড়ে থাকে। আমার খাওয়া-গোসলের ঠিক নেই, ঘুমানোর সুযোগ নেই, চাকরি দরকার চাকরি খোঁজার সময় নেই, যে আমি সপ্তাহে কমপক্ষে দুই-তিনটা সিনেমা দেখি, সে সিনেমা দেখা অথবা বই পড়ার ফুরসত নেই, শরীরের আকৃতি বদলে গেছে পোষাক কিনতে হবে, সেটা কিনতে যাওয়ার সুযোগ নেই, ছেলেকে কিছু সময়ের জন্য রেখে বাইরে যাবো সেও অসম্ভব কারণ ছেলে বুকের দুধ খায়।

সাদিয়া আফরিন

এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমার খুব হাঁসফাঁস লাগতে থাকে। কান্না পেতে থাকে। ভাবতে থাকি কী করবো আমি! এভাবেই কি দিন কাটবে আমার? এটাই কি মা হওয়া? আমাকে দিয়ে কি আর কিছু হবে না? এখানেই শেষ? আমি কি এভাবেই কল্পনা করেছিলাম আমার মাতৃত্বকে? একটা হতাশা বাসা বাঁধতে শুরু করে ভিতরে ভিতরে। সত্যি বলছি এই হতাশা বাচ্চার জন্য না বরং বাচ্চাকে ঘিরে আমার উপর যে ভূমিকা ও দায়িত্ব আরোপিত হয় সেজন্য।

২. এই মহাবিশ্বে “মা হওয়া” এক অন্তহীন পরীক্ষা, যার নির্দিষ্ট কোন সিলেবাস নেই, তবে এ-এক কঠিন পরীক্ষা এবং এর পরীক্ষক অগণিত। আপনি কিভাবে একজন “ভালো মা” হবেন এ-ব্যাপারে সকলেই অগাধ জ্ঞান রাখেন কেবল আপনি ছাড়া। আশেপাশের ছেলে, বুড়ো, নারী, পুরুষসহ সকলে সারাক্ষণ আপনাকে “আদর্শ মা” হওয়ার লেসন দিবে। বাচ্চা কাঁদে তো মা কী করে? বাচ্চা খায় না তো মা কী পারে? বাচ্চা ব্যথা পায় তো মা’র মনোযোগ কোথায়? মা কেয়ারলেস, কারণ বাচ্চার গায়ের জামা ময়লা, হাতের নখ বড়, দাঁত হলুদ, কানের পিছনে ময়লা, ট্যাব-মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। বাচ্চার মা এমন হবে ক্যান? বাচ্চার মা অসতর্ক ক্যান? বাচ্চার মায়ের এই করতে নেই, সেই করতে নেই।

মা এই দোজাহানের এক বিশেষ প্রজাতি যাকে যখন তখন, যার যা খুশি বলার অধিকার আছে। কেবল অধিকার নেই মায়েদের, না বলার, পারবনা বলার, ভাল লাগছেনা বলার বরং দুই হাতে মা দূর্গার মতো দশ হাতের কাজ একা করে দিলে এই জগৎবাসী সুখী হয় এবং তারা সুখী হয়ে মা’দের কিছু মুখরোচক কথামালা উপহার দেয় যা আদতে মায়েদের কোন কাজে আসে না, তাঁদের অবস্থারও কোন পরিবর্তন করেনা।

৩. মা’দের নিয়ে অনেক ফ্লাওয়ারি কথাবার্তার মধ্যে কয়েকটা এরকম, “মা স্বর্গ”, “মা পৃথিবী”, “খোদার পরে মা”, “মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত” তো এসব শুনতে শুনতে কারও কারও মনে হতে পারে যে মায়েদের সম্মান জানানোর জন্য এই বিশ্ববাসী বড়ই ব্যাকুল, এইসব ফুলেল, বায়বীয় কথামালা দিয়ে তারা কিছুটা হলেও মাতৃদায় শোধ করছে যেন! কিন্তু হায়! সন্তান জন্মদান এবং লালনপালন এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাথে একজন মায়ের চিরচেনা পৃথিবী আমূল বদলে যায়।

ধরা যাক কেউ ৩৫ বছর বয়সে সন্তান জন্ম দিলো, তার মানে তাকে ৩৫ বছর ধরে গড়ে ওঠা অভ্যাস, চর্চা, জীবন যাপন, ফিলোসফি সন্তানসহ পরবর্তি জীবনের সাথে খাপ খাওয়াতে হয়। আর এই ঘটনাটিকে এতোটাই স্বাভাবিক আর বাচ্চাপালাকে এতোটাই মা-কেন্দ্রিক করে তোলা হয়েছে যে মানুষ ধরেই নেয় মা আর বাচ্চা, বাচ্চা আর মা এর বাইরে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই বরং যে মা এর বাইরে ভাববে সে আসলে “বদ মা”, “বেয়াদব মেয়েমানুষ” অথবা “নারীবাদী”। অথচ বাচ্চাপালা যে স্ট্রেসফুল এবং এই স্ট্রেস কমানোর জন্য যে মায়ের সাহায্য প্রয়োজন অথবা এই দায়িত্ব যে মায়ের একার না, এটা বেশিরভাগ মানুষই চিন্তা করে না। যেজন্য একা একা বাচ্চা লালনপালন করা মায়ের পক্ষে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এবং এই বোঝা সামলাতে গিয়ে অনেক মা’ই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকেন।

৪. অন্যদিকে যে সকল মা’কে জীবিকার জন্য বাইরে কাজ করতে হয় মাতৃত্ব তাদের জন্য বিরাট এক বোঝা। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ এবং বাচ্চা দেখাশোনা এতোগুলো দায়িত্ব একসাথে সামলানো তাঁদের জন্য ভয়ংকর কঠিন ব্যাপার বৈকি! এরকম পরিস্থিতিতে অনেক মা’ই চাকুরি ছেড়ে ঘরে থিতু হতে বাধ্য হন। সমাজ যেহেতু নারীর ঘরে বসে সন্তান লালনপালনকে “সাধারণ ঘটনা” হিসাবে দেখে, সেহেতু স্বামী স্ত্রীর চেয়ে কম অর্থ আয় করলেও (বেশি আয় করলে তো কথাই নেই) স্বামীই বাইরের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কারণ ঘরে বসে বাচ্চাপালা ঠিক “পুরুষোচিত” কাজ নয়, ফলে সমাজ একে স্বাগত জানায় না, উপরন্তু নেতিবাচকভাবে দেখে। অথচ মা হতে গিয়ে নারীরা দিনের পর দিন নিজের শিক্ষা, সার্টিফিকেট, অর্জন, আয়ের রাস্তা বন্ধ করে স্বামীর মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হন। যেসকল নারীরা একসময় সাংস্কৃতিক চর্চার সাথে যুক্ত থাকেন তাঁরা সেইসব সুকুমার বৃত্তি বুড়িগঙ্গায় জলাঞ্জলি দিয়ে মন দেন “আদর্শ সন্তান” তৈরির কাজে কেননা সন্তান বখে যাওয়ার দায়ও শেষমেশ মায়ের ঘাড়ে এসেই চাপে। ফলে একদিন মায়েরা ভুলে যান যে তাঁরা ভালো গাইতে পারতেন, নাচতে পারতেন, আঁকতে পারতেন অথবা লিখতে পারতেন।

৫. সন্তান জন্মদানের সাথে সাথে নারীর স্ট্যাটাসও নির্ধারিত হয়। সামাজিক নিক্তিতে পুত্র সন্তানের মা এবং কণ্যা সন্তানের মা সমান ওজনের নন (তৃতীয় লিঙ্গের মায়েদের সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণা থাকায় বিষয়টি নিয়ে এখানে কিছু লিখছিনা)। পুত্র সন্তানের মা এই সমাজে ভীষণ দাপুটে। কন্যা সন্তানের মায়েদের থেকে সোশাল স্ট্যাটাসে একসারি উপরে তাদের অবস্থান। সংসারে তাদের গুরুত্ব বেশি কন্যা সন্তানের মায়েদের চাইতে।

কেন? পুত্র সন্তানের মায়েদের কি আলাদা শিং থাকে? দুইটা মাথা থাকে কিংবা চারটা চোখ? নাকি তাদের পাঁচটা আঙুল বেশি? যে সমাজে সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয়ের ভিত্তিতে দু’রকমের মায়েদের উঁচুনিচু ভেদাভেদ তৈরি করে সে সমাজই আবার মা দিবসে মায়েদের নিয়ে কথার ফুলঝুরি ফোটায়। যে মা’কে কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য গ্লানি সইতে হয় অথবা কাউকে কাউকে সন্তানের পিতৃপরিচয় আদায় করতে গলায় দড়ি দিতে হয় অথবা ভ্রুণ হত্যা করতে হয়, যে সমাজের আইন ও রাষ্ট্র সন্তানের অভিভাবক হিসাবে মা’কে স্বীকৃতিই দেয় না সে সমাজে নারীর প্রচলিত মা পরিচয় এবং তাদের নিয়ে কথার ফুলঝুরি দুটোই আমাকে ভীত করে। ভীত করে এজন্য যে সন্তান জন্মদাত্রী সকল নারী এই বিশ্বসংসারে “মা” হিসাবে স্বীকৃত নয়। তথাকথিত মাতৃত্ব সকল নারীর জন্য সমান অর্থ বহন করে না, অথবা একইরকম সম্মান/মর্যাদা বহন করে না। সেই হিসাবে মেইনস্ট্রিম মাতৃত্বের ধারণা ও মাতৃবন্দনা আসলে নারীর সাথে একধরনের পিতৃতান্ত্রিক প্রবঞ্চনা, কারণ এতে মায়েদের সামাজিক অবস্থানের কোন বদল ঘটে না।

৬. মেইনস্ট্রিম মাতৃত্বের যে রূপ পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তার ভিত্তিতে মায়েরা ব্যবস্থার আজ্ঞাবহ সেবাদাসী মাত্র। যে শরীরী প্রক্রিয়ায় নারী সন্তান জন্ম দেয় সেই প্রক্রিয়াটিকেই “মাতৃত্ব” মনে করে। মাতৃত্বে নারীর জন্মের সার্থকতা/পূর্ণতা খোঁজা শরীর নির্ধারণবাদী ভাবনা মাত্র। অথচ মাতৃত্বের যৎসামান্যই শারিরীক এবং প্রায় সবটাই এক সামাজিক নির্মাণ। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মা হয়ে ওঠার সামাজিক আরোপন এতোই সুক্ষ্ম ও সিস্টেম্যাটিক যে যারা মা হন (স্বেচ্ছায় না কী অনিচ্ছায় সে অন্য বিতর্ক), ঘর-বাহির সব সামলিয়ে বাচ্চা লালনপালন করতে গিয়ে হিমশিম খান তাঁরাও মুখ ফুটে কখনও বলতে চান না যে মা হওয়া এক বিরাট শারীরিক ও মানসিক চাপ, কিংবা সন্তানের দায়দায়িত্ব মায়ের একার নয়, বরং “কষ্ট সহ্য করেই মা হতে হয়” এই ধারণাকে ওহীবাক্য মেনে নিয়ে মাতৃত্বের ধর্ম পালন করতে থাকেন বেশিরভাগ মায়েরা এবং “কত কষ্ট সহ্য করে সন্তান বড় করেছেন” সে গল্প করে বাহবাও পেতে চান অনেকে।

মাতৃত্ব এক অর্থে তাই অন্ধবিশ্বাস। কেউ এ-বিষয়ে প্রশ্ন করতে ও শুনতে নারাজ। কেউ ভাবতে চান না যে সন্তান জন্মদান এবং সন্তানের দেখাশোনা ও লালনপালন ভিন্ন দুইটি প্রক্রিয়া। দুটোকে এক করে দেখা ব্যবস্থার কূটকৌশল। কেউ প্রশ্ন করতে চান না যে কেন মায়েরা একাই সন্তান দেখাশোনা ও লালনপালনের গুরুদায়িত্ব মাথায় নিবেন?

বিষয়টি এমন যে এটা নিয়ে প্রশ্ন করলে পাছে তাঁদের বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়, পাপ হয়ে যায়। প্রকৃতই মাতৃত্বকে ধর্মজ্ঞান করার কিছু আছে কি? বিনাপ্রশ্নে মাতৃত্বের প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে মেনে না নিয়ে বরং প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত মা “হয়ে ওঠা”কে। প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত সঙ্গীর ভূমিকাকে। প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত সেই ব্যবস্থাকে যেটি সন্তান দেখাশোনা ও লালনপালনের দায়দায়িত্বকে লিঙ্গনির্দিষ্ট করে। ভাবতে শেখা উচিত মা হওয়ার সাথে শরীরের সংযোগ স্বল্পমেয়াদের, কিন্তু “ভালো ও আদর্শ মা হওয়ার” দীর্ঘমেয়াদী বোঝা নারীর উপর চাপিয়ে দেয়া এক জগদ্দল পাথর। ঠিক আজ থেকেই বোধসম্পন্ন মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করুক প্রথাগত মাতৃত্বকে, ভাবতে শিখুক মাতৃত্বের দায়দায়িত্ব ভাগাভাগির, চর্চা করতে শিখুক শিশুর দেখাশোনা করা লিঙ্গনির্দিষ্ট বিষয় নয়। করোনাকালে যাদের সুযোগ রয়েছে ঘরে থাকার চেষ্টা করুন। একদিন ঘুরে যাবে এই পৃথিবী এবং এর সুফল ভোগ করতে পারবে আগামী প্রজন্ম নয়ত যুগেযুগে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে শুধু। ভেবে দেখুন ইতিহাস বদলের সঙ্গী হবেন নাকি পুনরাবৃত্তির। সিদ্ধান্ত আপনার।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.