ডা. নুসরাত সুলতানা ঊর্মি:
বয়োঃসন্ধির সময় থেকেই সাধারণত আমাদের সবার মনের ভেতর নিজের গোপন কোঠরে একজন স্বপ্নপুরুষ বা স্বপ্নের নারী থাকে। আমরা কি আসলে সেই স্বপ্নের মানুষ বাস্তবে পাই?
কেন একটা সময় গিয়ে আমরা আমাদের দাম্পত্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি! মনে হয় যেন, কী নেই কী নেই! দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক বোঝাপড়া, বিশ্বাস, আস্থা এগুলো যেমন অতি বড় নিয়ামক, তার চেয়ে ভীষণ জরুরি নিয়ামক হলো “প্রেম”। দাম্পত্যে “প্রেম” থাকাটাই বেশি জরুরি। প্রেমহীন দাম্পত্য কেবল যাপন করা সম্ভব, সে দাম্পত্যকে ধারণ করা, তাতে প্রাণ এর অস্তিত্ব রাখা কিন্তু কষ্টের।
সম্পর্ককে ধারণ করতে হয় নিজের মাঝে। যদি সম্পর্কের খোরাকগুলো মেটানো না হয়, নিত্য তাতে রং ছড়ানো না হয়, তবে সে সম্পর্কের মানুষ টাকে কিন্তু বেশিদিন পুষে রাখা যায় না। আর প্রেমহীন দাম্পত্য হলো পোষ না মানা পাখির মতোই, কখন যে আপনার আকাশ থেকে ঘুরে গিয়ে অন্যের আকাশে উড়ে বেড়াবে আপনি বুঝতেও পারবেন না।

অনেককেই বলতে শুনি আমার হাজব্যান্ড/ওয়াইফ আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। বন্ধুত্ব থাকা ভালো, কিন্তু আর দশজন বন্ধুর মতো হয়ে গেলে সেই মানুষই কিন্তু প্রেম সংকটে পড়বে এবং সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে বুক ভরে শ্বাস নিতে অন্য কারো প্রেমে স্বর্গ খুঁজে পাবে। প্রেম সেই অনুভূতি যা নিঃসন্দেহে আপনাকে স্বর্গসুখ এনে দেয়। আর কে না চায় উথালপাথাল প্রেমে লেপ্টে থাকতে!
বন্ধুত্বে আর যাই কিছু হোক না কেনো, সেই উন্মত্ত প্রেমের ভাঁজ খোলা যায় না। আর সত্যি বলতে কী, দাম্পত্যে অবনতি বা বিচ্ছেদ মানেই কিন্তু মানুষটা ভালো বা খারাপের বিষয় না। বিষয়টা হলো, অসামঞ্জস্যতা বা গ্যাপ। যাকে বলা হয়, ডিসহারমনি।
কেউ যদি ভাবে, দাম্পত্য মানেই বিশ্বাস, আস্থা আর শুধু দায়িত্বের পাট মাত্র, সে আসলে বিশাল ভুলের মাঝে আছে। এটা দাম্পত্য নয়, স্রেফ সংসার!
এমন একঘেঁয়ে সংসার কারই বা কাম্য?
দিনের পর দিন কলুর বলদের মতো উপার্জন করলাম, বাচ্চা লালন পালন করলাম, বছরে একটা বিদেশ ভ্রমণ, নিজের একটা ফ্ল্যাট, গাড়ি করলাম, আর দিন শেষে জৈবিক চাহিদা মিটিয়ে নিলাম, বন্ধুর মতো নিজেদের ভালমন্দ, আয়, চাকরী আর আটপৌরে দু চারটা কথা শেয়ার করলাম! এই মানেই যদি সুখী সংসার হয়, তাহলে আপনি বড্ড সস্তা মস্তিস্কের, সস্তা বুদ্ধিবৃত্তির মানুষ।
অন্ততঃ এই একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে আমাদের হাতের কাছেই আমাদের সমস্ত চাহিদার সমাধান, তদুপরি আমরা সবাই-ই এখন মনের চাহিদা ও খোরাকের জন্যই বেশি উদগ্রীব, তখন আসলে শুধু দায়িত্বের নটবর হয়ে দাম্পত্য জীবন সফলভাবে ইতি টানা কতটুকু সম্ভব, ভাবনার বিষয়! আর এ খোরাকের ঘাটতিই বর্তমান সময়ের ডিভোর্সের হার, পরকীয়ার হার বৃদ্ধির কারণ কিনা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
একটা মেয়ে যখন পুরোপুরি নিজেকে তার স্বামীর কাছে সমর্পণ করে সে তাকে দেয় তার জীবনের প্রত্যেকটা সত্যি, তার পরিশ্রম, তার বিশ্বস্ততা, তার আনুগত্য, তার প্রেমপূর্ণ ভালোবাসা, এমনকি তার একান্ত গোপনীয়তাও! জীবনের এমন পর্যায়ের উপর নির্ভর করে তার বাকি জীবনের সংসারের ভিত্তি।
তাই স্বামীকুল, যথাযোগ্য মর্যাদা দিন আপনার হাতের উপর নেমে আসা মানুষটিকে। তাকে আজ তার রান্না কেমন ভালো হয়েছে বলুন, প্রতি অকেশনে সারপ্রাইজ না দিন, অন্ততঃ তার জন্মদিনে তাকে স্পেশাল ফিল করান। সবার সামনে মন খুলে প্রশংসা না করুন, বাড়ির মানুষের সামনে তার নামে দুটো ভালো কথা না বলুন, অন্তত রাতে শোবার সময় তাকে বলুন, আজ সারাদিন সে বাচ্চা, সংসার, পেশা সব কিভাবে সুন্দর সামলেছে! বাসা ভর্তি অতিথিদের জন্য সকাল থেকে রান্না করে খাইয়ে যখন রাতে বিছানায় শুতে যায়, অন্তত জিজ্ঞেস করুন,সে ক্লান্ত কিনা!
চুল ছেড়ে রাখলে ভালো লাগছে, নাকি বেঁধে রাখলে, মাঝে মাঝে বলুন। সে যখন শাড়ি পরে, আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের সাজ দেখে, তার দিকে মাঝে মাঝে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলুন, কী অপূর্ব লাগছে তাকে!
তাকে ভরসা দিন। তার দুই বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে শরীরের যে সৌন্দর্য হানি ঘটেছে বলে তার হীনমন্যতা, সেটা আপনার এক কথায় উড়িয়ে দিতে পারেন এই বলে যে, “তুমি বিয়ের প্রথম দিন যেমন ছিলে, আজও আমার কাছে তেমন”।
তার বাড়তি মেদ ঝরানোর জন্য তাকে ব্লেম না দিয়ে উৎসাহ যোগান।
স্ত্রীকুলও স্বামীকে শুধু উপার্জনের মেশিন মনে না করে, তার ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তার বন্ধু, অফিস কলিগের সাথে ব্যক্তিত্বের সাথে বন্ধু হয়ে মেশার চেষ্টা করুন। তাকে বলুন, তার উপস্থিতিতে আপনি ও সন্তানরা নিজেদের কতটা নিরাপদ মনে করেন! তার দেয়া উপহার বা সারপ্রাইজ আপনার কতটা ভাল লেগেছে, তার আদর বা ভালবাসার প্রকাশ আপনি কতোটা পছন্দ করেন, তা তাকে বুঝতে দিন। আপনিও বিশেষ দিনগুলোতে তাকে উপহার বা সারপ্রাইজ দিন। তার সাফল্য উদযাপন করুন।
দেখবেন, কী আত্মবিশ্বাস আর সুখের হাসি আপনার পার্টনারের মুখে! এই হাসি আপনাকে যে প্রশান্তি এনে দেবে, তার তুলনা কি আর কিছু হয়?
আপনার কাছে হয়তো মনে হতে পারে, এসব ন্যাকামি রিয়েল লাইফে হয় না।
আপনি তাহলে ভুল জানেন৷ আমাদের রাসূল (সাঃ) ই পালন করতেন তার স্ত্রীদের সাথে এমন সুমধুর আচরণ। তাঁদের প্রশংসা করতেন। আদরের নামে ডাকতেন। দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করতেন। সংসার কারো একার ঘানি না, যে একা বয়ে যাবে। সেখানে দুজনেরই আচরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার দায়িত্ববোধ প্রকাশের অবকাশ আছে।
আপনি হয়তো এসব প্রকাশের ধার না ধেরে দিব্যি সুখী সংসারী মনে করতে পারেন নিজেকে! আপনার পার্টনারও হয়তো এসব নিয়ে খুব একটা অভিযোগ করেনি, বা করলেও আপনি আমলে নেন নি।
কিন্তু এই এক একটা ছোট্ট ছোট্ট ঘটনায় তার মনের কাছ থেকে আপনি এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে সরতে আথাকবেন! সম্পর্কের পঞ্চম বর্ষে এসে দেখবেন, সবই হয়তো আছে আপনার। সন্তান, গাড়ি, বাড়ি, বিত্ত, সাফল্য! কিন্তু তবু কী যেন নেই!
কী নেই জানেন?
আপনার মন হরণ করা সেই প্রেম! সেই প্রেমিক বা প্রেমিকা! সে এক পাহাড় সমান দ্বিধা আর অভিমান নিয়ে আপনার কাছ থেকে এক পৃথিবী দূরে সরে গেছে! পাশে যে আছে এখন, সে আপনার জায়া বা পতি কেবল! পাশেই থাকবে, ভালও বাসবে। দাম্পত্য চলছে ঠিক ঠাক! কিন্তু প্রেম আর নেই!
একটা সুন্দর দাম্পত্যজীবন এভাবেই অজান্তে, অবহেলায় শেষ হয়ে যায়, আমরা বুঝতেও বা জানতেও পারিনা।
স্বামী বা স্ত্রী, দুজনেরই উচিৎ দাম্পত্যে প্রেম বাঁচিয়ে রাখা।
ভালবাসুন। সেটা প্রকাশ করুন। আঁকড়ে ধরুন। তাকে বুঝিয়ে দিন, তার দায়িত্ব শুধু সন্তান, সংসারের কাজ বা উপার্জনের নয়। আপনার কাছে ব্যক্তি তার গুরুত্বও অনেক।
কাবিন করে বিয়ের পর পার্টনারকে সম্পত্তি মনে না করে তাকে কষ্টার্জিত বিজয় ট্রফির মতো আগলে রাখুন, বুকে ঠিক সেই অনুভূতি নিয়ে।
দেখবেন, এ যাবতকাল অতিবাহিত ভুল দাম্পত্য কেমন অন্য রং এ সেজে উঠছে!
আর যদি মনে করেন, সবই তো আছে, সবই তো করছি, কী বাদ রেখেছি তার অধিকারের, যা চায় তাই তো দিয়েছি, আলাদা করে প্রেম দেখানোর কী আছে? এসব কি প্রেম ভালবাসা না থাকলে হয়?!
তাহলে আপনার ঘুমের ভেতরই আপনার প্রাণ পাখি ফুড়ুত করে উড়ে যাবে!
আপনি যদি ভাবেন, প্রেম অন্তরে আছে, দেখানোর কিছু নেই, যে বোঝার সে বুঝবে! তাহলে সেটা প্রেম না, সেটা ভালবাসা। যা আমাদের কাছের সব মানুষ, বাবা মা সন্তান সবার জন্য থাকে। সত্যিই এটা দেখানোর কিছু নেই।
আমি বলছি “প্রেম” এর কথা। প্রেম ভিন্ন। এই প্রেম শুধু দু জনের জন্য হয়। প্রথমত যার জন্য, সেটা হলো আমার সৃষ্টিকর্তা।
আর হয় প্রেমিক প্রেমিকার জন্য। এই প্রেম ভেতরে লুকিয়ে রাখার জন্য না। এটা যত প্রকাশ করবেন, তত এর সুবাস ছড়াবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শো অফ নয়, নয় বেহায়াপনাও। প্রকাশ করুন আপনার মানুষ টার কাছে। উঠতে, বসতে, শুতে, খেতে, ঝগড়া করতে, অভিমান করতে, দিনের কোন না কোন কাজে, প্রেম প্রকাশ পাক। কখনো উথাল পাথাল প্রেম। কখনো হাল্কা দুষ্টু মিষ্টি প্রেম। কিন্তু প্রেম থাকা চাই!
নইলে একদিন আপনি ফাঁকা মস্তিস্ক নিয়ে পড়ে থাকবেন আর ভাবতে ভাবতে প্রাণবায়ু ত্যাগ করবেন যে, আপনার ভুল টা কোথায় ছিলো??!!!
লেখক: ক্লিনিক্যাল এন্ড কসমেটিক ডার্মাটোলজিস্ট।