আফসানা কিশোয়ার লোচন:
দাঁতের ডাক্তার হওয়ার কোন ইচ্ছা রুবাইয়াতের ছিল না। বাসার একজনকে বংশীয় পেশা ধরে রাখতে ডাক্তার হতেই হবে। মেডিক্যাল কলেজে যেন চান্স না হয় রুবাইয়াত সেভাবে এডমিশন টেস্ট দিলো। বিধি বাম, ডেন্টালে চান্স হয়ে গেল। অগত্যা বংশীয় পেশার বাতি না পেয়ে, মোমবাতি হাতে রুবাইয়াত হেঁটে চললো বাবা মা’র মন রক্ষার্থে।
ডাক্তারি পাশ করতে করতে যে বিদেশি মানুষকে মন দিয়ে দিবে একই পেশার দিকে ধাবমান কাউকে, তা বান্ধবীর বিয়েতে যাওয়ার আগে রুবাইয়াত জানতো না। বহু ঝামেলা হলেও বিদেশির ধর্ম এক হওয়াতে শেষ পর্যন্ত পাশাপাশি দু’দেশ মিলিয়ে একসময় রুবাইয়াতের বিয়ে হয়ে যায় ইয়াসিনের সাথে।
নিজের প্রেম, ক্যারিয়ার, চেম্বার ইত্যাদি ঠিক রাখতে গিয়ে রুবাইয়াতের অজান্তেই বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ প্রায় শূন্য হয়ে যায়। প্রথম বাচ্চা যখন হয় তখন রুবাইয়াতের মাথা খারাপ অবস্থা, কারণ ওরা মাত্র মধ্যপ্রাচ্যে এসেছে চাকরি নিয়ে, একদম একা বাচ্চা মানুষ করতে আলসে রুবাইয়াত যারপরনাই হাঁপিয়ে ওঠে।
ইয়াসিন চাকরি করতে থাকে। রুবাইয়াত একসময় নিজেই ডেন্টাল চেম্বার দেয় মধ্যপ্রাচ্যে। পর পর আরও দুটো বাচ্চা হওয়াতে লালন-পালন গা সওয়া হয়ে যায়। ইনকাম বাড়লে বাচ্চাদের জন্য আয়া রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে। রুবাইয়াতের চাপ কিঞ্চিৎ হ্রাস হতেই ইয়াসিনের অন্য শহরে এক হাসপাতালে ছয় মাসের ডেপুটেশনে যেতে হয়।
এর মধ্যে রুবাইয়াত ফেসবুকে একটা একাউন্ট খুলে। বন্ধু-বান্ধবদের খুঁজতে থাকে। এর সাথে তার সাথে আলাপ হতে হতে দেখে ওদের ব্যাচের এক বন্ধুও ওর শহরেই থাকে। স্কুলের বন্ধু শুনেই রুবাইয়াতের মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে।
রুবাইয়াত রহমানকে ঝোঁকের বশে স্কুলের বন্ধু শুধু এই আবেগে নিজের ফোন নাম্বার তো দেয়ই, সেই সাথে ইয়াসিন যে অন্য শহরে আছে সে কথাও বলে ফেলে।
‘একা থাকো, কী খাও না খাও’ বলে রহমান ফোনে নাকি কান্না করে। রুবাইয়াত হাসতে হাসতে বলে, আরে আমার তিন বাচ্চা, সব রান্না পারি, খাওয়া দাওয়ায় কোন অসুবিধা হয় না।
রহমানকে রুবাইয়াত ভদ্রতাবশে একদিন তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। কথায় কথায় রুবাইয়াত বুঝতে পারে রহমান আসলে রুবাইয়াতের দূর সম্পর্কের আত্মীয় মোখলেস কাকার দ্বিতীয় বউ যে কিনা মোখলেস কাকাদের বাসায় গৃহপরিচারিকা ছিল তার বড় মেয়েকে বিয়ে করেছে। কৌতূহল বশেই রুবাইয়াত রিমার কয় বাচ্চা ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে। রহমান নির্লিপ্ত স্বরে বলে রিমাকে তালাক দিয়েছি পাঁচ বছর হলো। ঐ ঘরে আমার তিন মেয়ে, মেয়েরা মায়ের সাথেই থাকে। বিয়ে করেছি ফরিদাকে, এই ঘরে আমার দুই ছেলে। রুবাইয়াত হেসে ফেলে, আরেকটু হলে তো হাফ ডজন হয়ে যেত!
এর মধ্যে রুবাইয়াত স্কুলের ফেসবুক গ্রুপেই রিমার বোন ডালিয়াকে পেয়ে যায়। জিজ্ঞেসও করে বসে রিমার কথা। ডালিয়া বলে, আপুকে আপনাদের ব্যাচমেট রহমান জ্বালানোর চূড়ান্ত করে বিয়ে করলো, তারপর কথা নাই বার্তা নাই তিনটা বাচ্চাসহ তালাক দিয়ে দিলো। কারণ আপুর ছেলে হয় না। রুবাইয়াতের মনটা বিষিয়ে ওঠে, এই যুগে কেউ এমন অজুহাতে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারে জেনে। ডালিয়া বলে চলে, হাড় বজ্জাত একটা ছেলে আপু এই রহমান, বিয়ে করেছে আবার, বাচ্চা হয়েছে, কিন্তু আপনাদের স্কুলের নার্গিস ছিল যে তাকে এখনও জ্বালাচ্ছে। দেশে এসে তার শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত গিয়ে উঠেছে, তাকে নাকি একবার না দেখলে মরে যাবে।
রুবাইয়াত মনে মনে সতর্ক হয়ে ওঠে।
বুঝতে পারে স্কুল ছাড়ার পঁচিশ বছর পর কেউ আর সেই স্কুলের কিশোর-কিশোরী বন্ধু-বান্ধবী নেই।
রুবাইয়াত তিন বাচ্চাসহ গ্রোসারিতে যাবে, সে মুহূর্তে রহমান ফোন করে, রুবাইয়াত বাইরে যাচ্ছে শুনে সেও সেই সুপার শপে আসবে জানায়। উবার নিয়ে রুবাইয়াত পৌঁছায় বাচ্চাদেরসহ। রহমানকে দেখে রুবাইয়াত বেশ ধাক্কা খায়। রুবাইয়াত যাই কেনার জন্য ট্রলিতে তুলে রহমান তাই বলে অন্য জায়গা থেকে কিনে আনবে। এখানে দাম বেশি ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে রুবাইয়াতের, বলে ফেলে আমি বাচ্চাদের নিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুই কোথা থেকে সস্তায় কী কিনবি কিনে আন। রহমান বলে, তুমি হাঁস পছন্দ করো? রুবাইয়াত বলে, হ্যাঁ করি তো।
একঘণ্টা পর রহমান কোথা থেকে যেন অল্পকিছু সব্জি নিয়ে ফেরে, রুবাইয়াত বিনা বাক্যব্যয়ে উবার ডাকে, গাড়ির ডিকিতে জিনিস তুলতে গিয়ে দেখে রহমান একটা বাক্স উঠাচ্ছে ডিকিতে।
-এটা কী?
-তোমার জন্য হাঁস এনেছি।
-মানে কী?
-জ্যান্ত নিয়ে এলাম।
রুবাইয়াত অনেক চেষ্টায় নিজের মেজাজ আটকে বাচ্চাদের সামলে উবারে উঠে, রহমান সামনে বসে।
বাসার সামনের কম্পাউন্ডে গিয়ে উবার ভাড়া দেবার পর রহমান হাঁসের বাক্স নিয়ে রুবাইয়াতের বাসার দিকে হাঁটা দিলে রুবাইয়াত বলে বসে, কই যাস তুই?
-বাসায় মাল সামাল পৌঁছে দেই। আর হাঁস কেটেকুটে রান্না করে তোমাকে খাওয়াবো। একা একা কী খাও না খাও।
রহমান, তুই আমাকে কেন ‘তুমি’ বলিস আমি জানি না। এটা মিডলইস্ট, আমার জামাই ঘরে শহরে নাই,’গায়ের মহররাম’ ছাড়া তোকে তো আমি বাসায় ঢুকাতে পারবো না।
রহমানের কালো রং বেগুনী হয়ে যায়। রুবাইয়াত রহমানকে উবার করে দেয়, ভাড়া দিয়ে দেয় নিজেই।
পরেরদিন থেকে শুরু হয় ফোনে উৎপাত, হাঁস কীভাবে রান্না করতে হবে, রান্না করেছে কিনা, খেয়েছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্নবাণ।
তৃতীয় দিন রুবাইয়াত ফোন ধরে বলে, হাঁস মরে গেছে।
রহমান জানে না হাঁসের সাথে ‘স্কুলের বন্ধু’ এই আবেগটাও রুবাইয়াতের মরে গেছে।