জেবুন্নেছা জোৎস্না:
টুং-টাং দরজায় শব্দ হতে রাহেলা দরজা খুলতেই এক বিশালদেহী পার্পল লোমশ কিছু তাকে হাল্কা পালকের ন্যায় ধরে উড়িয়ে নিয়ে চললো। পেছনে পড়ে রইলো তার সাজানো ড্রইংরুম, চুলায় চাপানো রান্না, ছোট বাচ্চাটা তখনও খেলছে, কাউকে বলে যাওয়া হলো না যে সে চলে যাচ্ছে জীবন থেকে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে মধ্য আকাশে ওর বন্ধন থেকে মুক্ত হতে, কিন্তু চর্তুদিকে সাদা মেঘে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে, সমস্ত শরীর ঘাম দিয়ে জেগে উঠলো রাহেলা। ধীরে ধীরে ঝাপসা চোখে সিলিংটার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখটাকে ধাতস্থ করে নিল। তার গলা শুকিয়ে আসছে। অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলো সে এখনও বেঁচে আছে। ভাগ্যিস এটা স্বপ্ন ছিল।
আজ তিন সপ্তাহ সে অসুস্থ, মাঝে শ্বাস কষ্ট হলে একসপ্তাহ হসপিটালে থেকে এসেছে। হঠাৎ তার অক্সিজেন লেভেল চুরাশি হয়ে গেলে তাকে ভেন্টিলেটরে দেবার সব প্রস্তুতি যখন শেষ তখন সে তার সর্বশক্তি দিয়ে বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজেই বেশ নাড়াচাড়া করলো। নার্সরা ভয়ে তেড়ে-মেরে আসলেও সে নিজেকে স্টিমুলেট করতে লাগলো যাতে তার শরীরে ঝিম মেরে থাকা হিমেগ্লোবিনরা একটু সচল হয়ে ছোটাছুটি করে তাকে ভেন্টিলেটরে যাওয়া থেকে রোধ করতে পারে। কারণ সে জানে, যদি সে একবার ভেন্টিলেটরে যায়, তো হয়তো তার আর এ জীবনে ফিরে আসা হবে না। আজরাইল আঃ ইদানীং মাঝে মধ্যেই ঘুমের ঘোরে তার ঘরে নক করে রক্ত শীতল করা অনুভুতি নিয়ে দেখা করে। ডাক্তার-নার্সদের অবাক করে দিয়ে রাহেলার অক্সিজেন লেভেল তখন চুরাশী থেকে চুরানব্বই’তে উঠে যায়। তারপর সংকট কেটে গেলে ইদ উপলক্ষে তার বাসায় আসার অনুমতি হয়।
এ বছরের ইদ’টা করোনা ইদ নামেই সকলের মনে থাকবে। ইদ নিয়ে তার কোনকালেই তেমন অতিরিক্ত কেনাকাটা অথবা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ কখনই ছিল না। ছোটবেলায় ইদ বলতে ছিল কাপড় কিনে লুকিয়ে রাখা, তারপর ইদের দিন সুন্দর সাজগোজ করে বাইরে ঘোরা। একটু বড় হবার পর ইদে অনেক কাপড় হতো ঠিকই, কিন্তু পরতে ইচ্ছে হতো না, মা’র বকা খেয়ে অতঃপর পরা। আর এখন নিজের সংসারে ইদ মানে তো আরো ল্যাবড়া-ছ্যাবড়া। কিছু তৈরি করার ভয়ে কনডেসড মিল্ক চুষে সেমাইয়ের স্বাদ নেয়া। তারপর একটু বেলা হতেই পুরো পরিবার নিয়ে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনের বাসায় যাওয়া, তারপরও সবার দাওয়াত রক্ষা করা সম্ভব হয় না।
বিয়ের পর প্রথম ইদ’টার কথা তার খুব মনে আছে। থাকবে না কেন, তখন তো আবেগী মন অল্পতেই কেঁদে-কেটে সূর্যাস্তের নিলীমার সাথে দিগন্তে মিলে যেত নিমিষে, যাতে কেউ বুঝতে না পারে তার কষ্টের কথা। এটাকে ঠিক কষ্টও বলা যায় কিনা জানে না সে, তবে অবশ্যই বাস্তবতা।
বিয়ের প্রথম বছর যখন সব মেয়েই চায় স্বামী পাশে থাকবে, ইচ্ছেমতো ইদের শপিং করে তার সাথে ঘুরবে, তখন তার প্রবাসী স্বামী দেশে আসতে পারেনি। সে ইদ উপলক্ষে তার মা’র কাছে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে সবার জন্য শপিং করতে। শাশুড়ী তার বড় মেয়েকে টাকা দিয়েছে সবার জন্য কেনাকাটা করতে। সবার জন্য সুন্দর সুন্দর শাড়ি এবং সোনা-গয়না কেনা হলেও রাহেলার জন্য কেনা হলো হাজার দুয়েক টাকার ক্রিম কালারের চেক একটা শাড়ি। রাহেলার পছন্দ না হলেও তাকে সেই শাড়ি হাসিমুখে পরতে হয়েছে তাদেরকে খুশি করতে। শুধু তাই নয়, শাড়িটা যে খুব সুন্দর এবং তার খুব পছন্দ হয়েছে হাসিমুখে এটাও বলতে হয়েছে অকপটে, আর অঝোর ধারায় কেঁদেছে যখন একলা হয়েছে। সে নিজেই অবাক হয়ে গেছে নিজের এ পরিবর্তনে: একটা অতি আদুরে জেদী মেয়েটাও কখন যে সংসারের নিয়মে ময়দার দলার মতো নমনীয় হয়ে যায়, সত্যি সে এক অপার রহস্য।
রাহেলা এখন দশ হাজার টাকার নিচে শাড়ি কিনে না; তার স্বামী কিনে দিলে তো আরো কয়েকগুণ দামি, কিন্তু সেই যে অতি নগণ্য একটা অপূর্ণতা সারা জীবনের মতো সত্য তারা হয়ে গেল। তবে এবার সে ঠিক করেছে, যদি বেঁচে যায় এ যাত্রায় তবে একদম অযথা টাকা অপচয় করবে না আর; সেই টাকা দিয়ে কারো জীবনের প্রয়োজন মেটাবে। আজ ইদ, করোনা’র কারণে বাইরে যেয়ে নামাজ পড়তে না পারলেও তারা ঘরে বসে পরিবারের সকলকে নিয়ে ইদের নামাজ পড়েছে; হোক না ইদ সাদা-মাঠা, কনডেসড মিল্কের এক চুমুকে তবু সব পাওয়া! জীবন বেঁচে থাকুক এই সুন্দর পৃথিবী, আকাশ, ঘাসফুল, পাখির কিচির-মিচির আর পরিবারের ভালবাসার বন্ধনে।