আদর্শ মা সমাচার!

মৌমিতা নওশীন সাথী:

এইতো কিছুদিন আগেই পেরিয়ে গেল মা দিবস। তবে আমার মতে বছরের সবদিনই আসলে একেকটা মা দিবস। তাই সব মাকে জানাই মা দিবসের শুভেচ্ছা। অনেকেই আদর্শ মা হিসেবে এই বিশেষ দিবস ছাড়াও আমাকে ট্যাগ দেয়!

কিন্তু সমাজের চোখে আদর্শ মায়ের সংজ্ঞা কী!
আমি কী আদৌ আদর্শ মা?

একের পর এক ডিগ্রী অর্জন বা প্রশিক্ষণের পেছনে দৌড়াচ্ছি … এর মধ্যেই তিনটি বাচ্চার জন্ম দিয়েছি এবং আজ ১১ বছর যাবৎ এদের লালন-পালন করতে গিয়ে রাতে কবে ঠিকমতো ঘুমিয়েছি জানি না, তাতে কী! যেই মা ক্যারিয়ার উচ্চশিক্ষার পেছনে দৌড়ায় সে তো আদর্শ নয়!

বড় বাচ্চার জন্মের ছয় মাস পর মাস্টার্স পরীক্ষা চলছিল, ওই সময় বাচ্চার খুব জ্বর ও ডায়রিয়া থাকায় খুব কষ্ট করে পড়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে।
রেজাল্ট- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর মধ্যে আমার বিষয়ে (marketing) প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন, আমি তো আদর্শ মা নই! ফেইল করলে ‘আদর্শ মা’ শব্দটি মানাতো।
রেজাল্ট এর পনেরো দিন পরেই তেজগাঁও মহিলা কলেজে প্রভাষক পদে পরীক্ষা দিয়ে জব পাই, এরপর মিরপুর কলেজ এ জব, স্থায়ী না হওয়ায় একই সময়ে দুইটা জব করতাম।

হাজব্যান্ড কৃষিবিদ হওয়ায় ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে তার ঢাকার বাইরে পোস্টিং দিয়ে, এমনও হয়েছে যে কোনো সহকারি নেই বাসায়, আমার আব্বা-আম্মা দুজনেই জব করায় তাদের কাছেও বাচ্চা রাখার সুযোগ ছিল না, তখন বাচ্চাকে ডে কেয়ার সেন্টারেও রেখেছি। ডে কেয়ার সেন্টারও এক সময় বন্ধ হয়ে গেলো। প্রতিবেশী, নিজ ছাত্রীর কাছে বাচ্চা রেখেছি, মনে সাহস রেখেছি একটা উপায় হবেই। এর মধ্যে LLB admission নেয়া ছিল, মেজো বাচ্চার জন্মের ২০ দিন আগে এলএলবি পরীক্ষা শেষ হয়।

LLB এর রেজাল্ট এর সাথে সাথেই MBA ভর্তি হই। মেজো বাচ্চার বয়স চারমাস তখন, মেটারনিটি লিভ শেষে সকালে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসতাম মেয়েকে কোলে নিয়ে। এরপর গৃহকর্মী বা প্রতিবেশী বা ছাত্রীর কাছে মেয়েকে রেখে নিজ কর্মস্থলে যেতাম। এরপর সেখান থেকে এমবিএ ক্লাসে যেতাম۔۔ যেহেতু তখন স্কুটার চালাতাম না, তাই বার বার বাসায় আসা ভার্সিটি যাওয়া সম্ভব ছিল না। এই সময়টা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। কত কথা শুনতে হয়েছে এগিয়ে চলার পথে।

আমার হাসব্যান্ড এরই মধ্যে ঢাকায় পোস্টিং হলেও বিন্দুমাত্র সহযোগিতা না করে স্টাডি বন্ধ করতে এমন কোন বাধা নাই যে না দিয়েছে ۔۔ (যদিও নিজ স্ত্রীর সফলতার গল্প বুক ফুলিয়েই বলে অন্যের কাছে!)

আমাকে সবসময় ট্রিট করেছে নিষ্ঠুর মা, কঠিন হৃদয় নারী হিসেবে!
কখনও কখনও শিক্ষিত সহকর্মী আত্মীয় বন্ধুমহলও কটু কথা বলেছে, এতো ক্যারিয়ার গড়ে কী হবে!
না আমি থামিনি। একজন নিষ্ঠুর মা ও অবাধ্য স্ত্রীর লেবেল নিয়েই এগিয়ে চললাম।

HR এ MBA এর ইন্টার্নী চলছিল তখন। এর মধ্যেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ Mphil/ Phd admission এর খোঁজ নিতে গেলাম। শুনলাম কিছুদিন আগেই এডমিশন ডেট শেষ হয়ে গিয়েছে। মানে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমি বসে থাকার মানুষ নই, এই একবছরে তৃতীয় বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ইন্টার্নি শেষ করে রেজাল্ট হতেই সাথে সাথে double major হিসেবে accounting এ MBA করে ফেললাম এক্সট্রা দুই সেমিস্টার নিয়ে۔۔

ফাইনাল পরীক্ষার পাঁচদিন পর আমার তৃতীয় বাচ্চার জন্ম হয়। আর হাসপাতাল এ যাওয়ার আগেই এমফিল এ এপ্লাই করার জন্যে প্রয়োজনীয় ছবি সার্টিফিকেট রেডি করে রাখি যেন প্রসবকালীন বা পরবর্তী সময়ে অসুস্থতার জন্যে এপ্লাই করতে সমস্যা না হয়।

বাচ্চার জন্মের আগের দিন mphil/phd admission এর সার্কুলার হয়।
বাচ্চার বয়স যখন এক মাস তখন ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে এডমিশন নেই। চলার পথে বেশি বেশি বাধা পেয়েছি বলেই উচ্চশিক্ষার টপিক নেই ‘ট্যুরিজম’! এই সময়ে একটি স্কুটারও কিনি দৌড়াদৌড়ির জন্যে।

ছোটবেলা হতে এখন পর্যন্ত পড়াশোনার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ নিচ্ছি ও দিচ্ছি। শেখার কোন শেষ নেই। অনেক হাসি তামাশা খোঁচা মারা কথা শুনলেও প্রতিটা প্রশিক্ষণই জীবনে কখনো না কখনো কাজে লেগেছে বা লাগবে।
প্রশিক্ষণ নিয়েছি সেলাই, কম্পিউটার, হস্তশিল্প, বিউটিফিকেশন, গান, আবৃত্তি, সংবাদ উপস্থাপনা ও রিপোর্টিং, spoken English, IELTS, মার্চেন্ডাইজিং ইত্যাদি বিষয়ে।
নেতৃত্ব দিয়েছি বিভিন্ন স্কুল ও কলেজভিত্তিক সংগঠনে।
অর্জন করেছি খেলাধুলায় চ্যাম্পিয়ন পুরস্কারসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দুশরও বেশি পুরস্কার, ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট।
পড়ালেখায় প্রথম স্থান অর্জন ছিল আমার নেশা।

তিনটা বাচ্চার দেখাশোনা, স্কুল, জব, উচ্চশিক্ষা, ট্রাভেল বিজনেস ও মেয়েদের এগিয়ে চলা নিয়ে কাজ করছি এখন।

যেই সময় কিছু মায়েরা স্কুল কোচিং এর সামনে অলস সময় কাটায় সে সময় আমি বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে নিজ কলেজ কর্মস্থলে পড়াতে যাই, ফেরার সময় বাচ্চা নিয়ে আবার বাসায় এসে ওদের নাস্তা দিয়ে নিজেরও মন চায় একটু বিশ্রাম নেই। হয় না বিশ্রাম। বড় দুইজনকে হোমওয়ার্ক করানো ও পড়া সমন্বয় করতে হয়। একজন গৃহশিক্ষক রাখলেই ওই সময়টা অনায়াসেই আমি বিশ্রাম নিতে পারি, বা টিভি দেখে বা মোবাইলে সময় কাটাতে পারি। এরপর রান্না করাসহ ঘরের অন্যান্য কাজ তো আছেই ۔۔ এরপরেও আমি আদর্শ মা বা বৌ নই!

আমার বড় ছেলেটা শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুলে ক্লাস ফাইভ এ পড়ে। তাকে নিজ উদ্যোগে বাফা হতে গান, আর্ট, আবৃত্তি, গিটার প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করেছি (এই বছর সমাপনী পরীক্ষা উপলক্ষে সব বন্ধ রেখেছি) ছেলেটা সপ্তায় তিনদিন স্কুল টিচার এর কাছে ব্যাচ এ কোচিং করে, এছাড়া সব সময় আমিই পড়াই, সে চারবার কোরান শরীফ খতম দিয়ে পঞ্চমবারের মতো খতমের উদ্দেশে পড়ছে।
এরপরও আমি ভালো মা নই!

মেজো সন্তান মেয়েটা পড়িয়ে শিখিয়ে শহীদ আনোয়ার গার্লস এ প্রাথমিক নির্বাচনীতে উত্তীর্ণ করাই এবং এরপর পরবর্তী ধাপ লটারিতেও হয়ে যায়। সে এখন ওই স্কুলে কেজিতে ইংলিশ ভার্সন এ পড়ছে। তাকে আমিই পড়াই। আমি তবুও উদাসী মা!
ছোট বাচ্চাটার বয়স আর কিছুদিনের মধ্যেই তিন হবে, তার দুষ্টামিতে মাথা নষ্ট! তাও বাচ্চাদের মোবাইল ধরিয়ে দেই না, ছোটবেলায় যেভাবে আমি বড় হয়েছি সেই খেলাগুলো ওদের সাথে খেলি যতটা সম্ভব।
এদের নিয়েই ট্রাভেল করি, একা একা না পারলে ঘুরতে যাই না ওদের ছাড়া, তাও আমি নিষ্ঠুর মা!

এবার নিজের মায়ের কথা বলি۔۔ মা ব্যাংকার ছিলেন এবং তার অল্প বয়সে আমার নানা-নানী মারা যাওয়ায় এবং বড় সন্তান হওয়ায় তাকে টিকে থাকতে যুদ্ধ করতে হয়েছে, সেই যুদ্ধে সঙ্গী ছিলেন আমার বাবা। আমি তাদেরই সন্তান। আর দশটি পরিবারের তুলনায় মেয়ে হয়েও আমি পেয়েছি অবাধ স্বাধীনতা ও সহযোগিতা। স্বপ্ন দেখতে বাধা পাইনি কখনো, তাই অন্য পরিবারে নিজ পছন্দে বিয়ে হলেও নিজ স্বপ্নকে মরে যেতে দেইনি সমাজের আর দশটি মেয়ের মতো। হাসব্যান্ড এর অসহযোগিতায়, বাধায় আর কটু কথায় যখন অন্য মেয়েরা ডিপ্রেশনে ভুগে নির্ঘুম রাত কেঁদে ভাসায়, সেখানে আমি চোখের পানি মুছে এইচএসসি, বিবিএ এবং এমবিএ পর্যায়ের বিভিন্ন কোর্সের উপর রাত জেগে আটটি বই ও হ্যান্ডনোট লিখেছি। সবকিছু পেরেছি সাবলম্বী ছিলাম বলেই। অর্থ আর মানসিক জোর দুইটাই জরুরি জীবনে উন্নতির জন্যে, আর আমি এমন একটা মানুষ, থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে আরও বেশি এগিয়ে যাই। এটাই আমি!

মাতৃত্ব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু সবকিছু নয়।
মাতৃত্বে জীবনের সব পূর্ণতা খোঁজে যে নারী, বার্ধক্য জীবনে সে একা। সন্তানের বিয়ে, উচ্চশিক্ষা বা দূরত্বের কারণে সেই মা ভোগে হতাশায় বা আর্থিক ও মানসিক অনিশ্চয়তায়। কখনও ছেলেমেয়ের সংসারে নাক গলিয়ে বা ষ্টার জলসার চর্চা করে হয় খারাপ শাশুড়ি অথবা উল্টা ছেলে বৌ বা মেয়ে জামাইয়ের কাছে হয় অপমানিত।

তাই নিজস্বতায় আমি আপোস করিনি। তার মানে এই না যে আমি আমার সন্তানদের ভালোবাসি না। হয়তো তথাকথিত আদর্শ মা নই!
নিজেকে সন্তানের উপর নির্ভরশীল দেখতে চাই না। তাদের বিবাহিত জীবন বা দূরে যাওয়া নিয়ে হতাশায় ভুগতে চাই না। বার্ধক্য বা বাকি জীবন নিজ ক্যারিয়ার, ব্যবসা, সমাজ সেবা আর ঘুরে ফিরে ফুর্তি করে কাটাতে চাই। নিজ জগতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে চাই, ঘরে ঘরে আমার মতো নিষ্ঠুর মা তৈরি হয় যেন সেই উৎসাহ দিতে চাই! পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখাতে চাই।

পরিশেষে সকল গৃহিনী ও কর্মজীবী মাকে মা দিবসের শুভেচ্ছা আবারও জানাতে চাই।

আর আমাকে best mom tag দিলে তা রিমুভ করে দেই! কারণ আদর্শ মা বা বৌয়ের শখ আহ্লাদ থাকতে নেই! শাড়ি না পরে ফতুয়া জিন্স পরি বলে আমার মায়াভরা আঁচলও নেই! তাই আঁচলতলে জায়গা হয় না বাচ্চাদের! বাচ্চার সাথে সাথে আমিও পছন্দের চকলেট আইসক্রিম খাই। নিজের যত্ন নেই, তারুণ্য ধরে রাখার চেষ্টা করি। তাই আমি নিষ্ঠুর মা!

নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিন তিনটা বাচ্চা সিজার অপারেশন এর মাধ্যমে জন্ম দিয়েও আমি নিষ্ঠুর মা! আদর্শ মা এর সংজ্ঞা বদলালে আমি হয়তো আদর্শ মা হতে পারবো! জীবনে অনেক সার্টিফিকেট অর্জন করলেও নিজেকে মনে করি কিছুই জানি না, শেখার আছে অনেক বাকি, অহংকার আমার মধ্যে স্থান পায় না। সর্বোপরি সততা ও বিনয় দিয়ে সব জয় করতে চাই। নিজ সন্তান ও ছাত্রছাত্রী বা সমাজকেও সেই শিক্ষাই দিতে চাই, যা অর্জন করেছি অনেক বাধা এসেছে… শুধু সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখেছি।

জীবনটা অল্প দিনের, মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই۔۔

লেখক: প্রভাষক-মিরপুর কলেজ
সি ই ও -Tourism Addiction

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.