তামান্না ইসলাম:
পরিবারের সকল সদস্য মিলে দীর্ঘসময় অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের কাছেই নতুন। জীবিকার প্রয়োজনে, শিক্ষার প্রয়োজনে, চিকিৎসা বা অন্য প্রয়োজনে সাধারণত প্রতিটা বাড়ি থেকেই কেউ না কেউ সপ্তাহের কোন না কোন দিন বাড়ির বাইরে যায়। এখন সেটা হচ্ছে না। এমনকি অন্য কেউও বাড়িতে আসতে পারছে না। যে কারণে দীর্ঘদিন শুধু পরিবারের সদস্যদের নিজেদের সাথেই সময় কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা এর সাথে জড়িয়ে আছে এক বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। কবে এই পরিস্থিতির অবসান হবে কেউ জানে না। পুরোপুরি অবসান হবে না আংশিক, বা সমাধান হলেও তার উপরে কতটা ভরসা রাখা যাবে এই সব বিষয়গুলোই অনিশ্চিত।
মানুষ স্বভাবগতভাবেই অনিশ্চয়তা ভয় পায়। আর পরিবর্তনকে অপছন্দ করে। অভ্যস্ততার নিয়ম থেকে বের হয়ে আসা সহজ নয়। এই দুইয়ের সমন্বয়ে ছোট বড় সবার মনের উপরেই প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। এর সাথে আছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। অনেকেই নানাভাবে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনৈতিক স্থিতি একটি পরিবারে শান্তি রক্ষার একটা অন্যতম স্তম্ভ। সেটা নড়বড়ে হয়ে পড়লেও পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হয়। সন্তানদের ভবিষ্যৎ এবং শিক্ষা ব্যবস্থা যখন কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটাও মা, বাবার দুশ্চিন্তার কারণ ঘটায়। এগুলো হলো বড় আকারে কীভাবে এই লকডাউন বা করোনা কাল আমাদের সবার উপরে মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।
তবে খুঁটিয়ে দেখলে পারিবারিক দ্বন্দ্ব শুধু এই মানসিক চাপের কারণেই হচ্ছে, তা নয়, তবে এই নতুন পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত কিছু বাস্তব সত্য আমাদের সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের পারিবারিক অবকাঠামোগুলো কতখানি দুর্বল এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। আমরা আমাদের পরিবারের সাথে বসবাস করতে, সময় কাটাতে ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড ব্যস্ততার অজুহাতে আমাদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে এমন দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল যে আমরা একে অপরের পছন্দ, অপছন্দ, অভ্যাস এগুলো সবই আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছিলাম। আমাদের একের প্রতি অপরের সহানুভূতি কমে আসছিল। সেইসাথে বেরিয়ে পড়েছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নগ্ন রূপ। আরও প্রকাশ পাচ্ছে আমরা কতটা পরনির্ভরশীল।
বাংলাদেশের শহরগুলোতে বেশিরভাগ বাসায় কোন না কোন সহকারি থাকে ঘরের কাজ করার জন্য। রান্না, ঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া এসব মিলয়ে একটা সংসারে কাজ কম নয়। এক চা বানানো আর দফায় দফায় চায়ের কাপ ধোয়াই তো একটা কাজ। এই যে সহকারির উপরে নির্ভরশীলতা, এর প্রধান কারণ আমাদের মানসিকতা। আজও সংসারের কাজের সব চিন্তা, দায় গৃহকর্ত্রীটির মাথায়। তাই তার এই নির্ভরশীলতা। যদি হাতে হাতে ঘরের কাজ সবাই করে তাহলে কিন্তু আজ আর লকডাউনে বাসায় কে কাজ করবে এই নিয়ে গৃহযুদ্ধ হতো না। স্বামী, সন্তান কেউ কাজ না করে বউ বা মাকে হুকুম করছে, সে হাঁপিয়ে উঠছে, সেই নিয়ে লেগে যাচ্ছে দ্বন্দ্ব। ঘরের কাজ সবাই ভাগ করে নিন, দেখবেন ঝগড়াঝাঁটি অর্ধেক কমে গেছে। অনভ্যাসে হয়তো শুরুতে বাচ্চারা বা তাদের বাবা ভুল করবে। এক্ষেত্রে নারীরা ধৈর্য সহকারে তাদের শিখিয়ে দিন, সমালোচনা না করে উৎসাহ দিন, দেখবেন আপনার কাজের বোঝাই কমে যাবে। ছোট বাচ্চা বাসায় থাকলে তাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব বাবা মাকে ভাগ করে নিতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাচ্চাদের রুটিন থাকাটা খুব জরুরি। একটি নিয়মিত রুটিনের মধ্যে বড় হলে এ সময়ে তারা নিজেরাও ধীরে ধীরে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠবে।
এই সময়টাকে আত্মোন্নতির জন্য পরিবার হিসাবে কাজে লাগানোর একটি শ্রেষ্ঠ সময়। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সময় না দিতে দিতে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এখন সেই দূরত্বটা ঘুচানোর সবচেয়ে বড় সুযোগ। একে অন্যের ভালোলাগার প্রতি খেয়াল রাখুন। আপনার সঙ্গী মানসিকভাবে এখন চাপে আছে, আপনি চেষ্টা করলে তাকে উৎফুল্ল রাখতে পারেন। সে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে। এটি দুজনের জন্যই প্রযোজ্য। একে-অন্যের পছন্দের আইটেম রান্না করলেন, দুকাপ চা বানিয়ে একসাথে একটা মুভি দেখলেন, দেখবেন সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে।
বাসা থেকে অফিস করা বা অনলাইনে ক্লাসে পড়ালেখা করা এই বিষয়গুলো সবার জন্যই নতুন। ছোট বড় সবাই এই নতুন জীবন নিয়ে খানিকটা দিশেহারা। এই সময়ে পরিবারই সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা। পরিবারের ছোট বড় সকল সদস্যকে একে অপরকে সাহস দেওয়াটা খুব জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে একজনের হতাশা বা দুশ্চিন্তা যেন দুর্বল সদস্যের উপরে অত্যাচার হিসাবে প্রকাশ না পায়। এটি একটি বড় কারণ এসময়ে পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির। নারী এবং শিশুদের উপরে সহিংসতা অনেক বেড়ে গেছে। তারমানে পরিবারের পুরুষ সদস্যের উপরে এখন দায়িত্ব নিজেকে শান্ত রাখার। একই ভাবে বাবা, মা দুজনকেই ধৈর্য রাখতে হবে বাচ্চাদের উপরে নিজেদের অন্য রাগ, হতাশা না ঝারার ব্যাপারে।
আরেকটি ব্যাপার হলো একঘেয়েমি। আমরা যদি পরিবারের সদস্যদেরকে অনেক ভালোও বাসি, তারপরেও আমাদের বন্ধু দরকার। একই মানুষের সাথে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কাটালে হাঁপিয়ে উঠতে পারি, একঘেয়ে লাগতে পারে। সেজন্য সবার কিছুটা সময় আলাদা করে বন্ধুবান্ধব, বা নিজেদের ভাইবোন, বাবা, মায়ের সাথে কথা বলে বা নিজের পছন্দমতো কিছু কাজ করে কাটানো দরকার। এতে করে একঘেয়েমি কেটে আবার পরিবারের প্রতি আগ্রহ ফেরত আসে।
এই করোনা কাল আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো পরিবার আমাদের শেষ আশ্রয়। এখানে কোনো দ্বন্দ্ব, কলহের স্থান না দিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থানে আসার জন্য সবাইকেই নিজের বিবেক, বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে হবে এবং সর্বদা সচেষ্ট হতে হবে।