করোনার দিনগুলোতে সন্তানের যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি

হিমিকা আরজুমান:

সামাজিক দূরত্ব বলতে আক্ষরিক অর্থে শারীরিক দূরত্ব বোঝানো হয়েছে। তাই তিন (০৩) মিটার বা তার বেশি দূরত্বে থেকেও সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো সম্ভব।

একজন স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এর পেশাগত দায়িত্ব কৌশলগতভাবে মানুষের মাঝে সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানো এবং বজায় রাখা তা মৌখিক/ অমৌখিক (ইশারা, ছবি, অঙ্গভঙ্গি) যেকোনো উপায়েই হোক।

ব্যস্ততম সময়ে জীবিকার তাগিদে ছুটে চলার কারণে পরিবারের সদস্যদের সঠিকভাবে সময় দেয়া হয় না আমাদের। অনেকেরই ঘরে বেড়ে ওঠা সন্তানের ভাষাগত উন্নয়ন বা কথা শেখার বিষয়টি নির্ভর করে মোবাইল/টেলিভিশনের স্ক্রিনের ওপরে অথবা বাড়ির পরিচর্যাকারীদের ওপর। এই সময়টা আপনার সন্তানের ভাষাগত উন্নয়ন ও সামাজিক যোগাযোগ এর সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কীভাবে কাজে লাগাবেন তাই নিচে তুলে ধরা হলো:

১-৩ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে:

১। আপনার যে সন্তানটি এক শব্দে কথা বলছে তার শব্দভাণ্ডার আরও বাড়াতে পারেন বিভিন্ন বস্তু চিনিয়ে বা ছবি দেখিয়ে। এরপর যেন দুটো শব্দ একত্রে বলতে পারে তার জন্য ‘ভাত খাব’, ‘বল দাও’ জাতীয় ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করতে পারেন।

২। আপনার যে সন্তানটি ছোট ছোট বাক্য বলছে তাকে বিভিন্ন রঙ যেমন ‘লাল বল’, এবং বিভিন্ন আকার যেমন ‘বড় গাড়ি/ ছোট বল’ ইত্যাদি সম্পর্কে ধারনা দিতে পারেন।

৩। মজা সহকারে ছোট ছোট ছড়াগান শোনাতে পারেন যেটা সময়ের অভাবে আগে করতে পারতেন না।

৪। আপনার সন্তান যাই বলতে বা বুঝাতে চায় তা খুব মনযোগ দিয়ে শুনুন। প্রাসঙ্গিক বা বয়স উপযোগী হলে কথা এগিয়ে নিয়ে যান। সন্তানের মতামতকে গুরুত্ব দিন আবার আপনার মতামতও বিনিময় করুন।

৫। যে সন্তানেরা এখনো কথা বলছেনা তাদের সাথে যোগাযোগ আরো বাড়িয়ে দিন। তারা চোখে চোখে তাকিয়ে কথা বলছে কিনা বা নাম ধরে ডাকলে তাকায় কিনা তা খেয়াল করুন। তাদের সাথে এক শব্দে কথা বলুন, প্রয়োজনে পছন্দের পশু পাখির ডাক বা খেলনার প্রতিকী শব্দ শুনাতে পারেন এতে সে শব্দের প্রতি আরো আগ্রহী হয়ে উঠবে। যেমনঃ বিড়াল ডাকে ‘মিউ’, গাড়ি চলে ‘পিপ পিপ’ ইত্যাদি।

৩-৬ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে:

১। করোনা মধ্যবর্তী এই কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তানদের নিয়ে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে যাওয়া হচ্ছে না। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিয়ে, জন্মদিন এর আনুষ্ঠানিকতাও বন্ধ। এসময় বিভিন্ন মজার খাবারগুলো কীভাবে রান্না করা হয় তা তদেরকে দেখাতে পারেন। একসাথে ঘরোয়া খেলা যেমন দাবা, লুডু বা ক্যারম খেলতে খেলতে কথা বলা যেতে পারে।

২। বিভিন্ন ছোট ছোট গল্প শোনাতে পারেন। একসাথে গল্পের বই পড়তে পারেন। এতে সন্তানের মাঝে গুছিয়ে গল্প বলার দক্ষতা বাড়তে পারে।

৩। দুই বা তিন ধাপ বিশিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন। যেমন: ‘তোমার ঘরে যাও এবং আমার চশমাটা নিয়ে আসো’। এতে করে একাধিক কাজ বা নির্দেশ পালন করার মতো বুদ্ধিগত প্রয়োগ ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।

৪। অভিভাবকত্বের খেলা খেলতে পারেন আপনার সন্তানের সাথে। যেমন আপনার সন্তানকে অভিভাবক সাজিয়ে আর আপনি নিজে আপনার সন্তানের ভূমিকায় অভিনয় করে কিছু মৌলিক বিষয়ে শিক্ষা দিতে পারেন।

৫। আপনার ছেলে বা মেয়েকে একা ছেড়ে না দিয়ে বরং রুটিন করে একসাথে কোন শিক্ষামূলক বা সামাজিক অনুষ্ঠান টিভিতে দেখতে পারেন। যেমন একটি নাটক একসাথে দেখার সময় নাটকে কি বোঝাতে চেয়েছে তা আলোচনা করতে পারেন অথবা নিজেরাও নাটকের কাহিনী নিয়ে একটি নতুন ধারণা তৈরি করতে পারেন।

৬-১২ বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে:

১। আপনার যে সন্তানটি হয়তো মাত্র কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছে সবে একটি রুটিনের সাথে তাদের অভ্যস্ততা গড়ে উঠেছিল। সাময়িক এই বিরতিতে ঘরেই তাদের জন্য স্কুলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রুটিন করে দিন। পড়াশোনার/পরীক্ষার জন্য আপনার সন্তান যেন বাড়িতে কোন মানসিক চাপে না ভোগে সে ব্যাপারে খেয়াল করুন।

২। বাহিরে যাওয়া আপাতত স্থগিত বিধায় এই বয়সেই অনেক সন্তান ইন্টারনেট এ বিনোদন খুঁজতে পারে এক্ষেত্রে তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারে বাঁধা না দিয়ে বরং এটাকে একটি শিক্ষণীয় উপকরণে পরিণত করুন। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে করোনাসহ নানাবিধ আতংকের খবর পড়ে তারা যেন বাড়তি মানসিক চাপে না পড়ে যায় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখুন।

৩। এসময় সন্তানের বিভিন্ন সৃষ্টিশীলতাকে গুরুত্ত দিয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করুন। যেমন ছবি আঁকা, তাদের হাতে তৈরী যেকোন খাবার, হাতে বানানো যেকোন সামগ্রী, গ্রাফিক্সের কোন কাজ ইত্যাদি।

৪। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে চলমান অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাকার্য্যক্রমগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে আপনার সন্তানকে সহযোগিতা করুন। প্রাইভেট টিউটর এর ওপর নির্ভরতা বাদ দিয়ে বাবা-মা নিজেরাও কিছু বিষয় বাসায় পড়াতে পারেন।

আসুন সবাই মিলে নির্দেশনা মোতাবেক ঘরে থাকি। করোনা (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রচারিত সকল পরামর্শ মেনে চলি। পরিবারের প্রবীন সদস্যদের যত্ন নেই। শিশুদের ভাষাগত ও সামাজিক দক্ষতা শিখতে সাহায্য করি। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে পারিবারিক বন্ধন আরো মজবুত করি।

বিভাগীয় প্রধান, স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি এন্ড রিসার্চ ইউনিট
বাংলাদেশ থেরাপি এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফাউন্ডেশন (বি টি আর এফ)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.