‘করোনা, ওকেশনাল আউটিং এবং টোনাটুনির সংসার’

কাজী তামান্না কেয়া:

আজ অনেক দিন পর বাসা থেকে বের হলাম এত্তগুলা কাজ জমিয়ে৷ সাউথ ক্যারোলিনার যে শহরে আমি থাকি সেটি লকডাউনে আছে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে৷ বাজার সদাই সেই থেকে ঘরে ডেলিভারি নেই, ঘরে বসে অফিসের কাজকর্ম ডেলিভারি দেই৷ বের হবার প্রয়োজন পড়ে না বললেই চলে৷ বাসায় থাকি আমি, আমার হাজবেন্ড–এরিক এবং আমাদের দুই ডগ হক আর রেভেন৷

ঘর থেকে বের না হতে হতে হাতে জমে গেছে বেশ কিছু জরুরি কাজ৷ প্রথমে গেলাম ডিপার্ট্মেন্ট অফ মোটর ভিহাইকেলে৷ গাড়ির টেম্পোরারি নাম্বার প্লেট চেঞ্জ করে মেটাল প্লেট নিতে হবে ৷ গিয়ে দেখি দুই জন এমপ্লয়ি সোস্যাল ডিস্টেন্স মেইন্টেন করে গ্রাহকদের ভেতরে ঢুকাচ্ছে৷ ভেতরে কাউন্টারগুলোতে স্নিজগার্ড দেয়া আছে দেখে ভালো লাগলো৷ যদিও কাউন্টারে যারা সার্ভ করছে, তারা কেউ মাস্ক পরা ছিল না৷

এরপর গেলাম ফার্মেসিতে৷ এখানে সোস্যাল ডিস্টেন্সিং মেইন্টেইন করার কেউ না থাকলেও ভেতরে মানুষজন একদম কম–সপ্তাহের মাঝখানে এবং করোনা দুটো মিলিয়েই সম্ভবত৷ বেশিরভাগ লোকই মাস্ক পরে এসেছে এবং কাউন্টারে কাউন্টারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা৷ সব মিলে ভাল প্রেপ নিয়েছে৷ প্রেপ হচ্ছে প্রিপারেশনের সংক্ষিপ্ত রুপ৷ এইদেশে সব কিছু সংক্ষেপে বলার এক অদ্ভুত বদঅভ্যাস আছে, আমিও তার কিছুটা রপ্ত করে ফেলেছি৷

এরপর ঢুকলাম গ্রোসারিতে৷ ওয়াল্মার্টে ঢুকে দেখি কার্টগুলো সব স্যানিটাইজার দিয়ে মুছে রাখা হচ্ছে৷ লোকজন স্যানিটাইজড কার্ট নিয়ে ভেতরে ঢুকছে৷ ক্রেতা বিক্রেতার অধিকাংশই মাস্ক পরা৷ এছাড়া গেইটে ঢুকতে এবং বের হবার পথে স্যানিটারি ওয়াইপ রাখা৷ সবাই সেগুলি দিয়ে হাত মুছে ঢুকছে এবং বের হবার সময়ে হাত মুছতে মুছতে বের হচ্ছে৷ এখানেও ভালো প্রটেকশন নিয়েছে দেখে ভালো লেগেছে৷

পোস্ট অফিস, রেস্টুরেন্ট, হার্ডওয়ারের দোকান, লিকার স্টোর এই সব জায়গাতেও আজ ঢুঁ মেরেছিলাম৷ তবে এই গুলিতে এরিক একাই ভেতরে ঢুকেছে আর আমি গাড়িতে অপেক্ষা করেছি৷ যত কম মানুষের সান্নিধ্যে আসা যায়, ততই ভালো৷ বেশিরভাগ জায়গায় অনলাইনে অর্ডার করা ছিল বা ফোন করে গিয়েছিলাম৷ তাই কোন কিছুই পিক করতে সময় লাগেনি বেশি৷

ঘরে থেকে যতটা ভয় লাগে, বাইরে সবাই কাজ করছে সাবধানতা মেনে– এটা দেখার পর মনে হলো ভয়টা কমানো উচিত৷ এই মানুষগুলি কাজ না করলে আমরা বিপদে পড়তাম৷ আমাদের তো তাহলে বাড়ির বাইরে কাজ করার সময় হয়ে আসছে৷ এমেরিকায় একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে৷ ভয়টা তাই যতই উড়িয়ে দিতে চাই, আসলে পারছিও না৷

আজ যেসব প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল এর সবগুলিই অত্যাবশ্যকীয় ক্যাটাগরিতে খোলা ছিল৷ রেস্টুরেন্টগুলি এখনও জোড়াতালি দিয়ে চলছে৷ মানে টেইক আউট অপশন চালু আছে, আর বসে খেতে চাইলে বাইরে টেরাসে খেতে দিচ্ছে৷ ভেতরে বসে খাবার খাওয়ার অনুমতি এখনও নেই৷

ওহ! আজ লিকার স্টোরেও ঢুকেছিলাম৷ বাকি সব ইমার্জেন্সি হলেও, লিকার স্টোর কোন ক্যাটাগড়িতে খোলা সেই ব্যাখ্যা আমার জানা নেই৷ ওয়াইনের ভেতর রোজে স্পার্ক্লিং আমার প্রিয়৷ আর দিন দশেক পর আমাদের ওয়েডিং এনিভার্সারি৷ সে উপলক্ষ্যে এক বোতল স্পার্ক্লিং রোজে নেবো বলতেই এরিক এখন নিতে না করলো ৷ বুঝলাম এনিভার্সারির আগে আরেকবার তিনি ওই মুখী হবেন৷ তখন রোজে নিয়ে আসবো ভেবে আর কিছু বললাম না৷

সে নিজের পছন্দের লিকার নিয়েছে, সাথে আমাদের দুজনারই পছন্দ এমন দুই বোতল ওয়াইনও নিয়েছে৷ সকাল থেকে এতো জায়গায় ঘুরাঘুরি করে, ঘরে এসে গ্রোসারি গুছাতে গুছাতে আমি ক্লান্ত৷ দুপুরে একটু ঘুমাবো বলে ঠিক করলাম৷ ওদিকে তিনি ব্যাকইয়ার্ডে ঢুকে গ্রিল মেশিনে চিকেন আর সিজনিং দিয়ে ঘরে এসে ডাকাডাকি করছে৷ আজ এত্তোগুলি বাইরের কাজ সারা হয়েছে, টোস্ট না করলে চলে? নিজেই দুটো গ্লাস এনে সাজিয়ে বসলো৷ দুজনে ওয়াইন খেতে খেতে গল্প করছিলাম৷ এর মধ্যে তিনি গ্রিল তৈরি করা শেষ করেছেন আর আমি পোলাও রান্না করা শেষ করেছি৷ তিনি বাংলাদেশি খাবারের ভেতর পরোটা আর তার পছন্দসই মশলা দিয়ে রান্না করা পোলাউ খুব পছন্দ করেন৷ বাংলা কুইজিনের আর কোন কিছুতেই তার কোন আগ্রহ নেই৷ আদা, এলাচ, ধনিয়া, দারুচিনি, লবংগ এইসবের কোনটার গন্ধ সে সহ্য করতে পারে না, সম্ভবত সে কারণে৷ আমার এমেরিকান কলিগরা কিন্তু আমাদের স্পাইসি বাংলা কুইজিন পছন্দ করে৷

আর দু’তিন দিন পরেই ঈদ৷ ঈদ উপলক্ষ্যে আমাদের কোন প্ল্যান নেই, নতুন জামা কাপড় কেনাকাটাও নেই৷ দেশে গিয়েছিলাম ক’মাস আগে৷ বোন এত্তগুলি শাড়ি আর ড্রেস উপহার দিয়েছে৷ আমি অতিরিক্ত জামা কাপড়, জুতো, ব্যাগ, কস্মেটিকস কেনার বিপক্ষে৷ তাই ক্লজেটে যা আছে তা দিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দিব অনেক দিন৷ ঈদে হালকা রান্নাবান্না করতে পারি৷ মা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে কী রান্না করলি, তাকে নিরাশ করতে চাই না৷ আর আমি নিজে ভুরিভোজ করতে পছন্দ করি৷ রান্না খাওয়া তাই চলতেই পারে৷

সকলকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা! ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.