রুমানা জামান:
বেখেয়ালে একজন ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলো মেয়েটা। তারপর কবিতার প্রতিটা শব্দের মতো জীবনটা গুছিয়ে নেয়ার আগেই হৃদয়ের রক্তক্ষরণে প্রতিদান দিতে হলো তাকে। আচঁড় তো কেবল ক্ষতই তৈরি করে না, চিহ্নও রেখে যায়। গাঢ় এক নিখাদ চিহ্ন। এমনই প্রতিনিয়ত এক গাঢ় ক্ষতের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন পারুল আপা। কারণ অনুভব, স্পর্শ, কাছে আসা এসবের আবদার মিটে গেলে হৃদয়ের ফিল্টারে বিতৃষ্ণা জমাট বাঁধে। ভালোবাসা পুরনো হয়ে গেলে বুঝি এমনই হয়!
বলছিলাম সমকালের স্টাফ রিপোর্টার সাজিদা ইসলাম পারুলের কথা। সদা হাসিমুখের এই সরল মেয়েটার ভালবাসার নিষ্ঠুর পরিণতির গল্প এখন সবারই জানা। তাই সেই গল্পে আর না যাই। পারুল আপার সঙ্গে আমার পরিচয় বছর পাঁচ ছাড়িয়েছে। দেখা হলেই আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরে। কতো কথা, হয় সুখ-দু:খের বিলি বণ্টন। ভীষণ অভিমানী একটা মেয়ে। কারো বিপদ শুনলে আগ পাঁচ চিন্তা না করেই দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
সবকিছু ছাপিয়ে ভেতরে ভেতরে আপা ছিলেন ভীষণ একা। একটা সংসারের জন্য খুব কাতর থাকতেন সব সময়। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, রুমানা, আমার একটা বাচ্চা যদি থাকতো জীবনে আর কিছুই লাগতো না রে! আমি হাসতে হাসতে বলতাম, আপা বিয়ে করো তো, দাঁড়াও ছেলে দেখতেছি। ঠিক তখনই যেনো চমকে উঠতো পারুল আপা। বলতো, কই পাবো সেই মানুষ যে আমাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে? চারপাশে দেখো না মেয়েদের জীবন! সমাজে মেয়ে মানুষরে গোণায় ধরে কেউ! সত্যিকারের ভালোবাসা নাই রে দুনিয়াতে।
একদিন দুম করেই রেজাউল করিম প্লাবনের কথা আমাকে বললেন। ছেলেটা তাকে বোঝে, অনেক কেয়ার করে, ভালোও নাকি বাসে! এমনকি প্লাবনকেই সে জীবনসঙ্গী করবে বলে ঠিক করেছে। শোনার পরেই কেমন খটকা লাগলো। পরিচয়টা খুব বেশি দিনের না। এটা শুনেই আমি বললাম, আপা, বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সময় নাও, আরেকটু বুঝো তাকে। তোমার তো এমনি কতো ভয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এই তিন মাসের ভেতরেই পারুল আপা বহুদিন আমাকে ফোন করে কান্নাকাটি করেছেন। কারণটা হলো-প্লাবন তার সঙ্গে বাজে আচরণ করেছে। তখনও বলেছিলাম, আপা সরে আসো, তোমার মতো সহজ মানুষের জন্য সে না হয়তো। পরক্ষণেই আপা আবার প্লাবনের পক্ষ নিয়ে আমাকে শুধরাতো। বলতো, মায়া কাটাতে পারি না যে রুমানা। আহারে মায়া! এই মায়াই যে কাল হবে, পাগলীটা হয়তো তখনও বোঝেনি।
পারুল আপার অনুরোধেই এদিনে প্লাবনের সঙ্গে কথা বললাম। আপার প্রতি ভালোবাসার লিমিটটা বুঝে নিতেই ফেইসবুকের ম্যাসেঞ্জারে তাকে লিখলাম, আচ্ছা আমার বোনটাকে কেনো এতো কষ্ট দেন আপনি? তার উত্তরগুলো আমার ভালো লাগেনি। সেদিনও ফের সতর্ক করলাম পারুল আপাকে। কিন্তু আপা আমাকে উল্টো বোঝালো, ও একটু এমনই। আমাকে ভালোবাসে, প্রকাশ কম তো, এজন্য তোমাকে বুঝতে দেয়নি। সেদিন সত্যি একটু বিরক্ত হয়েছিলাম পারুল আপার উপর। রাগ করে বলেছিলাম, যাও ওর গলায় ঝুলে পড়ে মরো তুমি। দেখো এই ছেলে তোমায় একদিন ডুবাবে। স্পষ্ট মনে আছে এই কথাটা শুনে পারুল আপা হো হো করে হেসে উঠে বলেছিলো, এভাবে বলিস নারে পাগলী। দোয়া কর আমার জন্যে।
এপ্রিলের ২ তারিখ তারা বিয়ে করলেন। এর দুদিন পরে পারুল আপা আমাকে ফোনে বললেন, বিয়ে করেছেন এবং এটা আমাকে গোপন রাখতে। আমিও কথা দিলাম হ্যাঁ রাখবো। সেদিনের পর দু’এক দিন পরপরই কথা হতো পারুল আপার সঙ্গে। এক সময়ে জানালো সে প্লাবনের বাসায় চলে এসেছে। এপ্রিলটা পেরোলেই তারা নতুন একটা বাসা নেবেন। তবে এই বাসায় আসার পর থেকে ফোনে কখনও কান্না ছাড়া আপাকে কথা বলতে শুনিনি। প্লাবনের পক্ষ থেকে মানসিক এবং শারীরিক নানা ধরনের অত্যাচারের কথা সে আমাকে জানাতো। একাধিক মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক। কী জানি কী বলতে না পারা কথাও বুকের ভেতর চেপে ছটফট করতো। আমি আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চাইলে বলতো, সব বলবো, শুধু দোয়া করো আমার সংসারটা যেনো টিকে থাকে। প্লাবন যত খারাপই হোক আমি ভালোবাসা দিয়ে সব ভুলিয়ে দেবো। দেখো আমি পারবো। কী ভীষণ বিশ্বাস ছিলো তার নিজের ভালোবাসার উপর!

অথচ সেই ভলোবাসা নিজের হাতে হত্যা করলো মানুষ নামে ওই অমানুষটা। পারুল আপার জীবনটা আজ একটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বামী নামের সেই মানুষটা যে তার গর্ভের সন্তানটিকেও হত্যা করে একেবারে নি:স্ব করে দিয়েছে তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছে। যেই মেয়েটা ভালোবাসা দিয়ে স্বামীকে ধরে রাখতে চেয়েছিলো, কতোটা সহ্যের বাঁধ পেরুলে তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারে সেটা যে কেউই অন্তর থেকে অনুভব করতে পারবে।
এতোকিছুর পরেও হাতের মুঠোয় ধরা দেয়া অসময়ের ভুলেরা নিহত হবেই। তুমি এগিয়ে যাও পারুল আপা। ভেঙ্গে-চুড়ে নতুন করে গড়ে নাও নিজেকে। আমার এবং আমাদের বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা তোমার সঙ্গে আছেন। তিনি কখনোই তোমায় বঞ্চিত করবেন না।