উপলব্ধি

পলি শাহীনা:

অত্যাধুনিক কোন অপারেশন রুম কিংবা হাসপাতালে নয়, আমার জন্ম হয়েছিল জীর্ণ এক আঁতুড়ঘরে। সে সময়ে আমার মত অন্য আরো অনেকের-ই জন্ম হয়েছিল আঁতুড়ঘরে, দাই মা’র হাতে। জন্মের সময় আমার ওজন ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি, যমের সঙ্গে লড়াই করে মা আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। মায়ের সঙ্গে দাই মা আমার নাড়ীর বন্ধন ছিন্ন করার পর, মা আরো বেশী শক্ত করে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আমি নাকি চোখ মেলে কিছু সময় অপলক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়ি। এসব কথা বড় হয়ে মায়ের মুখে শুনেছিলাম।

প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী মায়ের আদর, যত্নে তাঁর আঁচল ছায়ায় আমি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠি। ছোট চারাগাছ থেকে পত্র-পল্লবে সুশোভিত সবুজ বৃক্ষে পরিণত হই। জীবনের সঙ্গে হাত ধরে পরিচয় করিয়ে দেন মা। জীবনকে ভালোবাসতে শেখানও মা। আবাল্য মায়ের ন্যাওটা ছিলাম। বড় হয়েও দিবারাত্রি সবকিছুতে মায়ের চারপাশে ঘুরঘুর করতাম, আর মা মা করতাম। আমার জ্বালাতনে তাঁর কান ধরে এলে মাঝেমধ্যে দুষ্টুমি করে বলতেন, ‘তোর ম্যা ম্যা বন্ধ করে এবার খালাম্মা ডাক। ‘

দিনভর কাজের চেয়ে অকাজ করতাম বেশি। রেললাইন থেকে পাথর কুড়িয়ে এনে রাতের অন্ধকারে জানালায় ছুঁড়ে মারতাম, সবাইকে ভয় লাগানোর জন্য। পাশের বাসার ছাদে শুকাতে দেয়া চালতার আচার থাকতো আমার ঘরের ছাদে। বৈশাখী ঝড়ের চেয়েও আমি এবং আমার দলের তাণ্ডবে, অগণিত কাঁচা আমের অকাল বিচ্ছেদ ঘটতো গাছ থেকে। চড়ুইভাতির জন্য এ ঘর, ও ঘর থেকে চাল, ডাল চুরি করে কি যে অদ্ভুত আনন্দ পেতাম! অন্যদিকে দলনেতার মা হিসেবে সবার মন্দ কথা হজম করতেন আমার মা একাই। দস্যিপনায় মেতে মৌচাকে ঢিল মেরে, মৌমাছির কামড়ে দিশেহারা আমার বন্ধুরা সবাই আমাকে দায়ী করে। সেদিন সবার সামনে মা আমাকে অনেক মারেন। বাড়িতে এসে আমার কান্না থেমে যায়, কিন্তু মায়ের কান্না থামে না আমাকে প্রহারের অনুশোচনায়।

রাতদিন মাকে এতো জ্বালাতাম, কিন্তু কোনদিন তাঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি। তাঁর চাঁদ মুখে হাসি লেগেই থাকতো।

সময় গড়িয়ে যায়। দেশে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে আমি চলে আসি আমেরিকায়। প্রথম যেদিন শুনেছেন আমি বিদেশে চলে যাবো সেদিন মা অনেক কেঁদেছেন। প্রথমে কোনভাবেই রাজি হননি, রাজি হবেন বা কীভাবে? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে, এতো বড় হয়েও এখনো মায়ের হাতে ভাত খাই। ঘুমানোর আগে মা চুলে বিনুনি না কাটলে ঘুম-ই আসে না, মশারি খাটাতে শিখিনি তখনও, ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখলে মা মা বলে চিৎকার করে উঠি, এককথায় পুরোপুরি মায়ের উপর নির্ভরশীল আমি। বাইরের জগতের সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত আমাকে, মা কেমন করে অনুমতি দিবেন দেশের বাইরে যেতে!

পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে যাবো – এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাকে অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে আমি আমেরিকায় চলে আসি।
প্রথম প্রথম মাকে ছাড়া খুব কষ্ট হতো। মাকে ভীষণ মনে পড়তো। মা কে প্রতিদিন ফোন করে কথা বলতাম, দেশের কথা, বন্ধু, স্বজন, পড়শীর কথা জানতে চাইতাম। মা-সহ সবার ভালোমন্দ খোঁজ খবর নিতাম। মায়ের সঙ্গে আমার আলাপ যেন ফুরাতে চাইতো না।

গোটা বিশ্বের রাজধানী খ্যাত আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে আমার ব্যস্ততা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। চিতা বাঘের মত দ্রুতগতি সম্পন্ন পশ্চিমা বিশ্বের জীবন যাপনের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আস্তে আস্তে মা এবং দেশকে ভুলে যেতে থাকি। ব্যস্ততার কাদাজলে নিমজ্জিত আমার মাকে আর ফোন দেয়া হয় না। রঙিন ঝলমলে ক্যারিয়ার নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে মা ফোন করলেও ধরতে পারতাম না, কিংবা ধরার প্রয়োজন বোধ করতাম না। বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়তাম। এভাবেই আমার রাতদিন আবর্তিত হতে থাকে। আমি ডুব দিই একান্তে নিজের মাঝে।

পড়াশোনা শেষে চাকরিতে যোগ দিই। জীবনকে নিপুণভাবে সাজাতে, আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি নিজেকে নিয়ে। নিম্ম মধ্যবিত্ত গোছের অনিশ্চিত পরিবার থেকে উঠে আসা আমি, নিয়নবাতির চোখ ঝলসানো আলোর প্লাবনে অবিরত ভেসে যেতে থাকি। কোথাও থামা তো দূরের কথা, পিছনে ফিরেও তাকাই নি। হন্যে হয়ে শুধু সামনে এগিয়েছি।

চাকরি সূত্রে সহকর্মীর সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব তারপর প্রণয়। আমরা বিয়ে করি। আমার জন্য জীবনভর ঝড়-ঝঞ্ঝা সয়ে যাওয়া মা এর কাছে বিয়ের অনুমতি চাইনি, নামমাত্র জানিয়েছিলাম। ভিনদেশে আমার বিয়ে করার আচমকা সংবাদ শুনে সেদিন হয়তো মা সারারাত লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছেন, আর ঝাপসা চোখে শূন্য বুকে অসহায়ের মতো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। যুগল জীবনে আমি আগের চেয়েও দ্বিগুণ ব্যস্ত হয়ে উঠি। নয়টা- পাঁচটা অফিস করা, সঙ্গীকে সময় দেয়া, সংসারের দায়িত্ব পালন করা – সবদিক মিলিয়ে জীবন বেশ কঠিন হয়ে আসে। এরমধ্যে একদিন দেশ থেকে আমার বাবার মৃত্যুসংবাদ আসে। বাবার মৃত্যু সংবাদে সাময়িক আমি স্তিমিত হয়ে পড়ি। মা খুব অনুরোধ করলেন দেশে যাওয়ার জন্য, আমি যাইনি। বাবার জন্য তিন দিনেরও কম সময় শোক শেষে আমি ফিরে যাই স্বাভাবিক জীবনে।

আবারও ব্যস্ততা, আবারও শুরু জীবনের দৌড় প্রতিযোগিতা। বাবা গত হওয়ার পর, মা আবার আগের মতো সকাল-বিকাল ফোন করা শুরু করেছেন। খুব করে আমার সান্নিধ্য চাইছেন। আমি বুঝতে পারি, মা একাকিত্বে ভুগছেন। বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে মাকে এড়িয়ে গেছি। ছোটবেলায় অল্প সময়ের জন্য মা চোখের আড়াল হলে আমি যেভাবে কান্না করতাম, একইভাবে আমার বিধবা মা-ও আমার জন্য কান্না করতেন। আমার পথ চেয়ে বসে থাকতেন। ঈদের সময় দেশে যাবো শুনে মা নিজ হাতে উল দিয়ে আমার জন্য জামা বুনেছেন, কিন্তু আমি কথা দিয়েও যাইনি। আমার অপেক্ষায় তাঁর বুকের পাঁজরগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে, দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে, তবুও আমি ফিরে যাইনি তাঁর বুকে, সহস্র অজুহাত দেখিয়ে। মায়ের সাহচর্যের চেয়েও আমার কাছে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে আমার সংসার জীবন এবং নিরাপত্তা। আমেরিকায় আসার পর মায়ের একটি অনুরোধও রাখিনি দেখে পরে মা অনুরোধ করা ছেড়ে দিয়েছেন৷

বসন্ত দিনের স্নিগ্ধ সকাল পেরিয়ে রৌদ্রজ্জ্বল এক কোকিল ডাকা দুপুরে আমাদের কোলজুড়ে প্রথম সন্তান আসে। সন্তানের আঙুল ছুঁয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো পৃথিবীতে সব পাওয়া হয়ে গেছে। তাকে দেখি আর ভাবি, সন্তানের মধ্যে স্বর্গীয় সুখ লুকিয়ে থাকে। স্বর্গের সিঁড়ি যেন এই সন্তান।

আলোকিত আকাশ, পাখীদের গান, ভোরের শীতল বাতাস, ভ্রমরের গুঞ্জন, ফুলেদের সুবাস, আর সন্তানের সান্নিধ্যে আমার সময় কাটতে থাকে পরম সুখে। বুক সিন্দুকে জমিয়ে রাখা যত্ন, ভালোবাসায় আমার সন্তান তিরতির করে বাড়তে থাকে।

নির্ধারিত ছুটি শেষে সন্তানকে চাইল্ড কেয়ারে রেখে পুনরায় অফিসে যোগ দিই। সপ্তাহান্তে চাইল্ড কেয়ারের বেতন পরিশোধ করতে গিয়ে আমার টনক নড়ে। পুরো সপ্তাহে যা আয় করি, তার বৃহৎ অংশ চলে যাচ্ছে চাইল্ড কেয়ারে। নিউইয়র্কের মতো ব্যয়বহুল শহরে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম।
ভারাক্রান্ত মনে বিষয়টি নিয়ে একদিন কাছের বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করি। সবকথা শুনে দেশ থেকে মাকে নিয়ে আসার পরামর্শ দিল বন্ধু। প্রায় ভুলতে বসা মাকে আবার আমার প্রয়োজনে মনে পড়ে। বন্ধুর কথা মতো মাকে একবার কোনভাবে রাজি করিয়ে নিউইয়র্কে নিয়ে আসতে পারলেই আমার সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। মা আমার সন্তান লালন-পালন করবেন, বিনিময়ে আমার প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হবে। সংসার চালাতে আর কষ্ট হবে না।

অনেক দিন-মাস-বছর পেরিয়ে মাকে আমি সময় নিয়ে স্থির হয়ে কল দিই।

মায়ের গলার উচ্ছ্বাস শুনে বুঝতে পারি, আমার ফোন পেয়ে তিনি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি আমার মা, যাঁকে ফোন দিলেই জানতে চান- ‘খেয়েছিস? শরীর কেমন আছে? মন ভালো আছে?’ আজো তার বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটলো না! সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে মায়ের যথারীতি একই আব্দার, ‘আমার বুক জ্বলে তোর জন্য, দেশে আয়, তোর মুখখানা দেখি, আমার ভবিষ্যত প্রজন্মের মুখ দেখিয়ে নে আমাকে। তোর জন্যই তো এখনো রুহ খানা আছে।’

আমি চুপ করে থাকি। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে বলি, ‘মা, আপনাকে নিয়ে আসতে চাই আমার কাছে নিউইয়র্কে।’
আমার এমন কথা শোনার জন্য মা একদম প্রস্তুত ছিলেন না, উনি তোতলাতে থাকেন। আমি আবারো অনর্গল বলতে থাকি। আমার সব বুদ্ধি খাটিয়ে মাকে রাজি করানোর চেষ্টা করি। তাঁর সোজা উত্তর ছিল, ‘না রে এই বয়সে ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবো না।’

স্বার্থপরের মতো ‘মা-সন্তানের’ আবেগকে কেন্দ্র করে, নানান রকম কথার বাণে ভুলিয়ে, মাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করে নিউইয়র্কে নিয়ে আসি। আমার খুশীর জন্য তাঁর ঘর-সংসার ছেড়ে, পুরোপুরি অনিচ্ছায় মা আমার সন্তান পালনের জন্য চলে আসেন অবশেষে।
মাকে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে গিয়ে আমি হোঁচট খাই। প্রয়োজনীয় কার্যাদি শেষ করে আরও অনেকের সাথে মা যখন বেরিয়ে আসছিলেন, অনেকের ভীড়ে তাঁকে চিনে নিতে আমার সময় লেগেছে। মায়ের ভাসা ভাসা চোখজোড়া কোটরে ঢুকে পড়েছে, চশমার পুরুত্ব বেড়েছে, তাঁর সবুজ সুখের ছায়াঘেরা মুখখানি ফ্যাকাসে হয়ে পড়েছে, হলুদ বর্ণের চামড়া তামাটে হয়ে গেছে। কাঁচা চুলের সিঁথিপাটি দখল করেছে পাকা চুলে।

অনেক বছর পর চিরচেনা মায়ের গন্ধ পাই। মায়ের গন্ধ শুঁকে তাঁর কাছে যাই। বুকটা হু হু করে উঠে, মাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসি। কয়েকদিন জমিয়ে মায়ের সঙ্গে গল্প করি। ছোটবেলা থেকে দেখেছি দুনিয়ার কোন বস্তু দিয়ে নয়, মা খুশি হোন সময় পেলে। মা সবসময় বলতেন, ‘বাড়ি -গাড়ি নয়, জীবনে প্রাণখুলে হাসতে পারাটাই সুখ। ‘

মায়ের কাছে শিখেছি, ‘জীবনে কারো হাসির কারণ হতে না পারলেও কারও কষ্টের কারণ যেন না হই। ‘
এতো এতো বছর পর আমাকে কাছে পেয়ে মা তো মহা খুশী। মাকে কাছে পেয়ে ভালোলাগার আনন্দে আমার ছুটির দিনগুলো তাড়াতাড়ি কেটে যায়। আমি ফিরে যাই কাজে। মা ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমার সন্তানের দেখাশোনা ও সংসারের কাজকর্মে। অফিসের কাজের চাপে পুরো সপ্তাহ মাকে একদম সময় দিতে পারতাম না। সপ্তাহ শেষে ছুটির দিন দুটো কেটে যেত নানান সামাজিকতায়, চোখের পলকে। মায়ের প্রতি কোন দায়িত্ব আমি সঠিকভাবে পালন না করলেও, আমার সব কাজ তিনি নিয়মানুযায়ী সময়ের আগে শেষ করে রাখতেন। যেমন, ছুটির দিনে কী পরবো? অফিসে কী পরে যাবো? কাপড়-চোপড়গুলো আলাদাভাবে গুছিয়ে রাখতেন। কখন কী খাবো, পছন্দের সব খাবারগুলো তৈরি করে রাখতেন।

মায়ের কাঁধে সন্তান এবং সংসার দেখাশোনার সকল দায়িত্ব তুলে দিয়ে, আমি নিশ্চিন্তে দিনাতিপাত করছিলাম। আমার সময়গুলো তখন নির্ভার, শিমুল তুলোর মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছিলো।

কয়েকমাস পর দেশে পাঠিয়ে দেব- এই কথা দিয়ে মাকে নিউইয়র্কে এনেছিলাম। মায়ের কাঁধে জোয়াল তুলে দিয়ে অতি সুখে, মাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি যারপরনাই আমি ভুলে যাই। আমার সন্তান স্কুলে যাওয়া শুরু করার পর, মা একদিন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে ক্ষীণস্বরে বলেন,’আমি দেশে যাবো, আমার ভিটায় ফিরে যাবো। আমার স্বামীর কাছে যাবো।’

সেদিন মায়ের কণ্ঠ ভীষণ করুণ স্বরে আমার কানে বাজে, বুকে লাগে। আমার সন্তানের স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটিতে মাকে দেশে পাঠিয়ে দিই। গ্রীষ্মের ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ার আগে মাকে পুনরায় অনেকটা জোর জবরদস্তি করে নিয়ে আসি। কোনভাবেই আবার আসতে রাজি হচ্ছিলেন না।
দেশ ছাড়ার পর সে বছর মাকে আনার জন্য প্রথম আমি নিউইয়র্ক থেকে দেশে যাই। আসলে আমার কথায় রাজি না হয়ে, আমার গরীব মা এর তখন অন্য কোন উপায় ছিল না। আমার মা ততদিনে নানাবিধ রোগ ব্যাধিতে ভুগছিলেন। আমার থেকে অর্থ নিয়ে ওষুধ কিনে খান। আমার উপর নির্ভরশীল, আমার বৃদ্ধা মা অসহায়ের মতো আবারও অনিচ্ছায় চলে আসেন নিউইয়র্কে।

আমার সন্তানকে স্কুলে আনা নেওয়া, ঘুম পাড়ানো, খাওয়ানো, সব কাজ মা সুচারুভাবে করলেও তার মুখে কোন হাসি নেই। প্রয়োজন ছাড়া আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। প্রায়শই তাঁকে দেখতাম, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকতে। বিষয়টা আমাকে কিঞ্চিৎ ভাবিয়ে তোলে।

এর মধ্যে আমার কাছে হোম কেয়ার সার্ভিস হতে লোভনীয় একটি ফোনকল আসে। তাঁদের দেয়া তথ্যানুসারে আমার মা এখন আমার কাছে খুব দামী। ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক শহরের বাঙালি সমাজে হোম কেয়ার সার্ভিস খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্ভবত গত পাঁচ-ছয় বছর আগেও এখানকার বাঙালিরা হোম কেয়ার সার্ভিস সম্পর্কে জানতো না। জানলে তো আমিও জানতাম!

মাকে কোনদিন খুশি করতে না পারলেও, মাকে দেখিয়ে হোম কেয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সপ্তাহে কমপক্ষে ৪০ ঘন্টার একটি বাড়তি আয়ের সন্ধান পেয়ে খুশিতে আমার মন নাচছে। অফিস থেকে ফিরে কখনও মায়ের রুমে না গেলেও সেদিন যাই। আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরি। অন্য সময়ের মতো মা উল্টো আমাকে জড়িয়ে না ধরে নিশ্চুপ পাথর চোখে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মধ্যে কোন উচ্ছ্বাস, প্রতিক্রিয়া নেই। হাসি নেই মুখে।

মাকে দেখিয়ে আমেরিকা সরকার থেকে বাড়তি অর্থ পকেটে ঢুকিয়ে আমি হ্যাজাক বাতির মতো জ্বলে উঠলেও আমার মা কেরোসিনের শুকিয়ে যাওয়া প্রদীপের মতো নিভে আসছিলো।

মায়ের কপালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, শরীর খারাপ লাগছে? জবাবে বললেন, ‘আমাকে দেশে পাঠিয়ে দে। কতদিন পায়ে মাটি লাগেনি। সূর্যের আলো গায়ে মাখিনি। এখানে আমি গৃহবন্দি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, হাসফাঁস লাগে। তোর সন্তান এখন স্কুল বাসে যায়। তাই বাইরে যাওয়া হয় না একদম। ‘

আমি মাকে বুঝিয়ে বলি, ‘দেশে কার কাছে যাবেন? দেশে তো কেউ নেই।’ মা বলেন, ‘দেশে পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয় -স্বজন আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলবো। কাদামাটিতে পা রাখবো। এখানে সারাদিন একা ঘরে থাকি। কেউ কথা বলার নেই। কথা বলতে না পারার কষ্টে শূন্য শূন্য লাগে। খোলা আকাশের নিচে আলো-বাতাসে হাঁটতে পারি না। বাইরে যেতে পারি না। আলো-বাতাসহীন এই বদ্ধ ঘরে আমার কষ্ট লাগে। ‘

আমাদের মা-সন্তানের বিতর্ক দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। আমার স্বর চড়ে যেতে শুনে এক সময় অসুস্থ মা আমার স্বেচ্ছায় চুপ হয়ে যান। চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া তো তাঁর অন্য উপায়ও ছিল না।

রোগে, শোকে ভুগতে থাকা মা গত হয়েছেন দুই বছর আগে। জীবিতকালে তাঁর দেশে যাওয়ার ইচ্ছা পূরণ না করলেও মৃত্যুর পর দেশে পাঠিয়েছি। বাবার পাশে মাকে দাফন করেছি।

পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষগুলো এখন অদৃশ্য এক অনুজীব করোনা ভাইরাসের আধিপত্যে কাঁপছে। অসহায় মানুষ প্রজাতি এই মারণ পোকার ভয়ে আশ্রয় নিয়েছে চার দেয়ালের মাঝে। সব বন্ধ ভাইরাস আতঙ্কে। চরাচরে মহাকালের মতো মস্ত এক তালা ঝুলছে। কার্যত, গোটা বিশ্ব অচল হয়ে পড়েছে। গৃহবন্দি আমি এবং সবাই। গত তিন মাস ধরে অফিস বন্ধ। রাতদিন আমার ঘরে কাটছে। তিন মাস গৃহবন্দি থেকেই আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। সবকিছু অসহ্য ঠেকছে। ইচ্ছে করছে সকল বিধিনিষেধের দেয়াল ভেঙে, খোলা আকাশের নিচে মুক্তো বাতাসে বেরিয়ে পড়ি, শ্বাস নিই প্রাণভরে। সূর্যের আলোয় স্নান করে আত্মীয় -স্বজন, বন্ধুদের সঙ্গে মেতে উঠি প্রাণের কোলাহলে।
আমার ইচ্ছেগুলো পূর্ণতা পায় না। মহামারী করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে চার দেয়ালের বাইরে আমি যেতে পারি না।

আমার এখন অফুরন্ত অবসর। সন্তান ব্যস্ত থাকে নিজের কক্ষে, পড়াশোনা, ল্যাপটপে। মাঝে-মধ্যে দরজায় কড়া নেড়ে রুমে ঢুকতে গেলে বলে, ‘ব্যস্ত আছি। দয়া করে পরে এসো।’
আমি ক্লান্ত পায়ে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ফিরে আসি নিজের রুমে।

আজ আমার মায়ের জন্মদিন। আকাশ অঝোরে কাঁদছে। পুরনো ফটো এলবামে ঝাপ্সা চোখে মায়ের ছবি দেখছি। মায়ের হাসি মুখের ছবিটিতে চোখ আটকে থাকে।

মায়ের কাছে জীবনে সুখী হবার সংজ্ঞা ছিল, হাসতে পারা। মায়ের মুখের সে হাসি কেড়ে নিয়েছিলাম আমি। চাইল্ড কেয়ারের অর্থ বাঁচানো, হোম কেয়ার সার্ভিস থেকে বাড়তি অর্থের লোভে, মাকে আমি গৃহবন্দি করে রেখেছিলাম বছরের পর বছর। মায়ের শেষ জীবনের ফ্যাকাসে মুখখানি আমাকে ভয়ংকরভাবে তাড়া করে ফিরছে। নিজের ভুল বুঝতে পারি আজ, তবে খুব দেরিতে। এই ভুল সংশোধন করার আর কোন উপায় নেই এই জীবনে।

সন্ধ্যা নামে। অন্ধকার আরো গাঢ় হয়। গভীর অন্ধকারে আমি ডুবে যেতে থাকি। বর্শার ফলার মত মায়ের দেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি আমার বুকে এসে বিঁধে। মা কে সুখ দিতে পারিনি, শুধু দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেজেছি, কান্না হয়ে ঝরেছি তাঁর চোখে।
আজ আমার বাড়ি-গাড়ি, অর্থ-বিত্ত সব থাকার পরেও দশদিক আলো করে মায়ের মতো হাসতে পারি না।

ছোটবেলায় মা ঘুম পাড়ানী গান শুনাতেন, গল্প বলে ঘুম পাড়াতেন। একদিন মা বলেছিলেন, ‘মানুষ মরে গেলে ওই দূর আকাশের তারা হয়ে যায়। ‘
আমি বিছানা ছেড়ে জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াই। মেঘ কেটে ততক্ষণে ফর্সা আকাশের বুকে তারা ঝিকঝিক করছে। নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে, দূর আকাশ হতে একখন্ড রুপালি আলো এসে পড়ে আমার মুখে। আমি হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে অদৃশ্য হয়ে যায়। অনড় অবস্থায় দূর আকাশের নক্ষত্রের পানে অপলক তাকিয়ে থাকি। মা কে খুঁজতে থাকি।

দুর্বল লাগে। মেঝেতে বসে পড়ি। ছোটবেলার মতো মা মা বলে কাঁদতে থাকি। খুব কষ্ট হয়। আপনমনে বিড়বিড় করি,
— মা আমার দু’হাত আপনার পায়ের উপরে। আমাকে মাপ করে দেন। আমার মাথায় একটু হাত রাখেন, আদর করেন। মা-ই তো প্রকৃতি। আমি এবং আমরা সকলে আজ কঠিন সঙ্কটে আছি। আমাদেরকে ক্ষমা করেন মা।

শেয়ার করুন: