সুপ্রীতি ধর:
এক এক করে সাতটি বছর পেরিয়ে গেল উইমেন চ্যাপ্টার প্রতিষ্ঠার পর। ২০ মে সপ্তম বর্ষপূর্তি পোর্টালটির।
একটু ফিরে দেখা যাক, কেমন ছিল সেই দিনগুলি?
২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন, আমরা সবাই তখন একেকজন জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। একাত্তর না দেখা প্রজন্ম জ্বলে উঠেছে আবারও। কী এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত তখন। আমিও এক সহযোদ্ধা সেই আন্দোলনের, রাতদিন পড়ে থাকি শাহবাগে। রক্তে পরিবর্তনের নাচন।
মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টে যেতে থাকে পরিবেশ। কে কাকে মন্ত্রণা দেয়, কুমন্ত্রণাও দিয়ে যায়, বুঝে উঠার আগেই ভাঙনের শব্দ শুনি। ফিসফাস, ফিসফাস, ধর ধর, মার মার, জ্বালিয়ে দে, পুড়িয়ে দে এর পাশাপাশি আবারও একতাবদ্ধ হই আমরা। পরিবর্তন হতেই হবে একটা। না, দৃশ্যনীয় কোন পরিবর্তন আসে না। বরং হেফাজতে ইসলামের উত্থান ঘটে। আমরা প্রমাদ গুণি। ওরা হুংকার ছুঁড়ে, তালিকার পর তালিকা হতে থাকে, বিরোধী পত্রিকায় কলামের পর কলাম লেখা হয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। মৃত্যুদুতেরা সব ঘাড়ের ওপর নি:শ্বাস ফেলতে থাকে একেকজনের। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম ভয় পায় না। তারাও বুক চিতিয়ে থাকে। অত:পর আঘাতটা আসে একজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরদিন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা হয় শাহবাগে, সব ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে অংশ নেয় সেই জানাযায়। বীরবন্ধুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানায়।
আমাদের রক্ত তখন গরম। নারায়ণগঞ্জে আমাদেরই এক সংগঠক বন্ধুর ছোট্ট ছেলেকে ত্বকীকে মেরে ফেলা হয়। হেফাজত প্রধান শফী হুজুর নারীদেরকে ‘তেঁতুল’ বলে সম্বোধন করে চরম অসম্মান জানায় এবং নারীবিরোধী দাবি-দাওয়া পেশ করে সরকারের কাছে। যেখানে আবারও নারীকে হেঁশেলে ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি পড়ালেখা থেকে বাদ দেয়ার বিশাল পরিকল্পনার কথা থাকে। নারী সংগঠনগুলো ফুঁসে ওঠে এসবের প্রেক্ষিতে। এসময়ই ঘটে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা। এর মাঝেও বিশাল সমাবেশ করে নারী সংগঠনগুলো। তখন সেই সমাবেশের মিডিয়ার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার দীর্ঘদিনের ভারসেটাইল সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা দিয়েই উপলব্ধি করি, মাঠের আন্দোলনে হয়তো আমি নাও থাকতে পারি, কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে আমরা লেখালেখির মাধ্যমেই শামিল হতে পারি। কিন্তু কোথায় লিখবো?
মেয়েদের লেখালেখির জন্য একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম খুব জোরালোভাবে অনুভূত হচ্ছিল তখন। আর তারই ফলশ্রুতিতে ২০ মে আত্মপ্রকাশ করে উইমেন চ্যাপ্টার, যাকে আমি কেবলমাত্র অনলাইন পোর্টাল বলি না, বরং বলি যে এটা একটা মুভমেন্ট বা আন্দোলন – যা কীনা সমাজে পরিবর্তন আনবে। A Movement -Towards a Change । তাছাড়া সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আমার স্বপ্নও ছিল মেয়েদের জন্য মেয়েদেরকে নিয়েই কিছু একটা করবো। কিন্তু আর্থিক কারণে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার এই স্বপ্নের কথা অনেকের সাথেই শেয়ার করতাম, কিন্তু কেউ কোনো পথ দেখাতে পারেনি। বলেছে, পাশে থাকবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাও হয়ে উঠেনি তাদের পক্ষে। স্পন্সরের কথা অনেকে বললেও নিতে চাইনি। কারণ আমি মানুষ হিসেবে কারও নিয়ন্ত্রণে থাকা একদম পছন্দ করি না। কেউ আমাকে বলে দেবে কী করতে হবে, আর আমি সেইভাবে চলবো, এ আমার একদম চরিত্র-বিরুদ্ধ।
লেখালেখির মধ্য দিয়েও যে পরিবর্তন আনা সম্ভব, তা আমরা প্রমাণ করে ছেড়েছি। যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল উইমেন চ্যাপ্টার, অর্থাৎ মেয়েদের লেখার ক্ষেত্র বা স্পেস তৈরি করা, মেয়েরাও যে লিখতে পারে গণহারে সেটা প্রমাণ করা, আজ সাত বছর পরে দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি যে, সেটা আমরা অর্জন করেছি।
এর আগে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে মেয়েরা এমন মন খুলে, হাত খুলে লিখতেই পারতো না। মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার নারী পাতাগুলো যারা চালাতো তারাও কখনও ভাবতে পারেনি মেয়েরা এতো সিরিয়াসলি কোনো ইস্যু নিয়ে লিখতে পারে এবং তাদের সেই লেখা জনপ্রিয় হয়ে উঠে! এমনকি সমালোচিতও হয়! সমালোচনাকে এখানে আমরা জনপ্রিয়তার কারণে ‘ঈর্ষা’ বা ‘নিরাপত্তাহীনতা’ বলেই ধরে নিচ্ছি। আমরা মেয়েরা সেইসব সমালোচনার মুখে এতোটুকু দমে যাইনি। বরং আরও ব্যাপক উদ্যমে এগিয়ে গেছি। সবাই মিলে ধরাশায়ী করেছি সমালোচকদের। মেয়েদের এই সাহসগুলো তৈরি করার কৃতিত্ব কম না। মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলোতেও এখন মেয়েদের পদচারণা, দুহাতে লিখছে তারা। মেয়েদের লেখার জন্যেই নতুন নতুন উইনডো তৈরি করতে হয়েছে তাদের। কিন্তু এই সুযোগটুকু তৈরি করা এতো সহজ ছিল না উইমেন চ্যাপ্টারের। মিডিয়া ব্যবসায়ীরা বুঝতে পেরেছে, এটাই এখন ট্রেন্ড, কাজেই তাদেরও শামিল হতে হয়েছে এই যাত্রায়।
উইমেন চ্যাপ্টারের ঈর্ষণীয় সাফল্যে অন্য পোর্টালগুলোও তখন মেয়েদের লেখা ছাপার প্রয়োজন অনুভব করে। ফলে মেয়েদের জন্য দিগন্ত খুলে যায়। আর এখন তো শুধুমাত্র মেয়েদের পোর্টালের সংখ্যাও অনেক। এটা অবশ্যই উইমেন চ্যাপ্টারের অবদান এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে আমি এই উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানাই। যতবেশি জানালা খোলা হবে, ততবেশি নি:শ্বাস ফেলার অবকাশ তৈরি হবে মেয়েদের জন্য। এভিনিউ বাড়বে চিন্তার। যত বেশি মত, তত বেশি পথ, তত বেশি সম্ভাবনা।
অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েই উইমেন চ্যাপ্টারের যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখনও সীমাবদ্ধতা পিছু ছাড়েনি। আর্থিক সীমাবদ্ধতা একটা বড় কারণ, আর আছে জনবলের অভাব। শুরুতে নক্ষত্র, যে ওয়েবসাইটের ডিজাইন করে দিয়েছিল প্রায় বিনামূল্যে, আর ছিল মিজানুর রহমান। মিজান আর নক্ষত্র দুজনে মিলে ওয়েবসাইটটি সাজিয়ে দেয়। তারপর আমি ধীরে ধীরে শিখে নিই কলাকৌশল। আর এরপর থেকেই এই একা হাতেই চলছে পোর্টালটির কাজ। কখনও কখনও ক্লান্তিতে পেয়ে বসলেও নিজের মস্তিষ্কজাত সন্তান বলেই হয়তো একে ছেড়ে যাওয়া হয় না আমার। যাবোই বা কোথায়, সন্তান তো সন্তানই! ভালো হলেও সন্তান, খারাপ হলেও সন্তান!
২০১৩ সালের প্রতিষ্ঠার ঠিক এক বছর পর ২০১৪ সালের মে মাসেই উইমেন চ্যাপ্টার অনলাইন পাঠকদের ভোটে জিতে নেয় জার্মানির ডয়চে ভেলের দ্য ববস ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার, ব্লগ ক্যাটাগরিতে। তখনকার সময়ের জনপ্রিয় ইউক্রেনের একটি সাইটকে পিছনে ফেলে উইমেন চ্যাপ্টারের ওই জয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল।খুবই উল্লেখ করার মতোন ছিল সেইসব দিনগুলি।
এরপর ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পায় পোর্টালটি। ২০১৫ সালে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে যখন পোর্টালটি, তখন এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি পাই অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার। এটাও বিশেষ প্রাপ্তি পোর্টালটির জন্যই। আমি সেটা সব লেখকদের উৎসর্গ করেছিলাম।
কারণ এসবই সম্ভব হয়েছে পাঠক এবং লেখকদের জন্য। এমন অনেকেই ছিল যারা কখনই লিখতে পারবে বলে সাহস পাচ্ছিল না। সেই তারাই একসময় বইও প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে উইমেন চ্যাপ্টারে লিখে লিখেই। এখানে লিখেই অনেকে তাদের একটা পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছে, পরবর্তিতে যখন বই ছাপিয়েছে, তখন সেই পাঠকগোষ্ঠীই কাজে লেগেছে। সুতরাং আমি বলবো, এখানে প্রাপ্তি মূলত বহুমুখী।
অপ্রাপ্তিও কম নয়। সমালোচনা, গালিগালাজ, হুমকি, সাইটটা ডাউন করার প্রচেষ্টা, হ্যাক করার পাঁয়তারা, সবই মিলেছে এই সাত বছরের জীবনে। ব্যক্তি আমাকে আর উইমেন চ্যাপ্টারের আমাকে গুলিয়ে ফেলে বার বার আমাকে অপদস্থ করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। সমালোচক বা হুমকিদাতারা যে কেবল মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীই ছিল বা আছে, তা নয়, আশেপাশের বহু প্রগতিশীল মানুষজনও উইমেন চ্যাপ্টারের সমালোচনায় মুখর।
আমি তাদের দোষ দিই না। একটা আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও ধর্মীয় ব্যবস্থায় জন্ম নেয়া এবং বেড়ে উঠা যে কারও পক্ষেই নারীদের এমন ট্যাবু ভাঙার গান সহ্য না হবারই কথা। শুধু তো ট্যাবু ভাঙাই নয়, ধর্মীয় যেসব বিধিনিষেধ নারীর স্বাধীনতা বা অধিকারের পরিপন্থি, সেখানেই আমরা কথা বলেছি। ফলে বিরাগভাজন হয়েছি স্বাভাবিকভাবেই।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমালোচকেরা নিজেরাও এটা বুঝতে অক্ষম যে, তারাও পুরুষতন্ত্রের ভয়াবহতারই শিকার। তাদের যে চারিত্রিক খামতিগুলো, তা এই সমাজব্যবস্থার কারণেই। এটা তারা বুঝতে পারে না বলেই মুখে গালির তুবড়ি ছোটানো তাদের পক্ষে সহজ। অথচ জীবনটাই তাদের পাল্টে যেতে পারতো যদি ন্যুনতম হলেও স্বীকার করে নিতো সমস্যাগুলো। আমরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরও তাদের অন্ধত্ব কাটেনি। আর তাইতো তারা এখনও অনায়াসেই আমাদের নারীদের বিরুদ্ধে সমাজের সবচেয়ে কুরুচিপূর্ণ গালিটি দিতেও বিবেকে বাধে না তাদের।
অনেক চড়াই-উৎরাই, খানাখন্দ পেরিয়ে এই যে যাত্রা উইমেন চ্যাপ্টারের, সেখানে নানাসময়ে বন্ধু হিসেবে যারাই পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদেরকে আজ স্মরণ করছি। সব বন্ধুকে ধন্যবাদ। তারা ছিল বলেই আমি কাজটা করতে পেরেছিলাম। তাদের উদ্দেশ্যেই বলছি, আমাদের লক্ষ্য এক, হয়তো রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন, কিন্তু তাতেও যেন বাধাগ্রস্ত না হয় আমাদের যাত্রাপথ, এটা আমাদের সম্মিলিতভাবেই মোকাবিলা করতে হবে।
পরিশেষে আরও একটি কথা, পথে নেমে কখনও ভাবিনি এ পথ মসৃণ হবে, তবে এতোটা বৈপরীত্য, এতোটা বিরোধিতা, এতো শত্রুতা যে পাবো, তাও ভাবিনি। একটি উদ্যোগ পুরো জীবনব্যবস্থাকেই পাল্টে দিল। আর তো পিছু হটা যায় না।
নতুন বছরে শুধু এটুকু বলি, অচিরেই উইমেন চ্যাপ্টার একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। আপনাদের, তোমাদের পাশে চাই, বন্ধু হিসেবে, সুহৃদ, শুভাকাঙ্খী হিসেবে।
শুভ জন্মদিন উইমেন_চ্যাপ্টার।