মেহেরুন নূর রহমান:
কয়েক মাস আগে ফেইসবুক এর কোন একটি গ্রুপে প্রকাশিত একটি লেখা পড়েছিলাম। লেখক তার জীবনের এক ট্র্যাজেডি বর্ণনা করেছেন কমেডি ধাঁচে। স্ত্রীর কাছে কী এক ভর্তা খেতে গিয়ে তাকে কত নাজেহাল হতে হলো, কতভাবে স্ত্রীকে হাত-পা ধরতে হলো ইত্যাদি সেই লেখাটির বিষয়বস্তু। সেখানে অসংখ্য কমেন্ট ছিল স্বামীকুলের পক্ষ থেকে। তাদের জীবনেও তারা স্ত্রীর কাছে প্রিয় কিছু খেতে চেয়ে কতভাবে হেনস্থা হয়েছেন, কত ব্ল্যাকমেইল এর শিকার হয়েছেন, এসব। যদিও আমার চারপাশে কোন স্ত্রীকে দেখিনি স্বামী কিছু খেতে চেয়েছে, কিন্তু রান্না করে দেয়নি। জব করে এমন ব্যস্ত স্ত্রীকেও দেখেছি স্বামীর চাওয়া খাবার তক্ষুণি রান্না করে দিতে না পারলেও সপ্তাহান্তে রান্না করতে। ঝগড়াঝাঁটি হলে অন্য কথা।

যাই হোক, একটা কথা বলেন, রান্না কি কোন রকেট সায়েন্স যে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ করতে পারে না? এবং অন্য একজনের ইচ্ছার উপর নির্ভর করতে হয়? এই ইউটিউবের যুগে যে কেউ যেকোনো কিছু রান্না করতে পারে যদি ইচ্ছা হয়। সত্যি কথা বলতে কী আমি অনেক পুরুষকেই দেখেছি চমৎকার রান্না করতে, যদিও সেটা মূলত শখে। তাহলে রান্না না জানা স্বামীকুলের এই বিশাল একটা গ্রুপের এই দশা কেন?
এরম দশা এই কারণে যে তারা যে শুধু রাঁধতে পারে না তা নয়, তার মনে প্রাণে বিশ্বাস করে রান্না স্ত্রীদের/মেয়েদের কাজ, তারা কেন করবে? অসংখ্য দম্পতি আছে যেখানে দুজনেই জব করে, কিন্তু রান্নার মূল দায়িত্ব স্ত্রীদের। শখ করে রান্না করা স্বামীদের বেলায়ও একই অবস্থা। স্ত্রীদের নরমাল রান্না তো করতেই হয়, সেই সাথে সপ্তাহান্তে স্বামীদের প্রিয় খাবারের আবদারও মেটাতে হয়। কাজের সহকারি থাকলেও স্ত্রীকেই সব ম্যানেজ করতে হয়। অনেক আহলাদী স্বামী আবার স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো হাতের রান্না খেতে পারে না।
অথচ লজিক্যালি এসব ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী দুজনকেই রান্না এবং ঘরের কাজ সমানভাবে ভাগ করে নেয়া উচিত যেটা আমারদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে অসম্ভব স্বপ্ন মাত্র।
পুরুষদের এই মানসিকতা আমাদের প্যাইট্রিয়াকাল (patriarchal) সমাজ ব্যবস্থারই প্রতিফলন, যেখানে নারীদের মূল দায়িত্ব সন্তান উৎপাদন, ঘরকন্না এবং রান্নাবান্না। নারীদের ঘরকন্নার বা রান্নার কাজকে সবসময়ই ছোট করে দেখা হয় যেহেতু এর সাথে সরাসরি অর্থ আগমনের কোন সম্পর্ক নেই। এখন নারীরা ঘরের বাইরে যাচ্ছে, চাকরি করছে, অর্থ আয় করছে, কিন্তু এখনও পুরুষদের চোখে রান্নাবান্না এবং ঘরের কাজ মেয়েদের কাজ, ছোট কাজ, পুরুষের জন্য অসম্মানকর।
আমাদের দেশের ছেলেদের বড় হয় এমন একটা সমাজ ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যেখানে তাদের মা-বাবার তাদের ভেতর পুরুষ মানেই শ্রেষ্ঠ এই মনোভাব তৈরিতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। মায়েরা ধারাবাহিকভাবে এই পুরুষতান্ত্রিক ধারণাকে সমর্থন করে যান, কারণ তারাও এর ভেতর দিতে বড় হতে হতে অজান্তেই এর অংশ হয়ে গেছেন। তারা কখনোই তাদের ছেলে সন্তানকে রান্না বা ঘরের কাজ করতে উৎসাহিত করেন না, কারণ তারাও মনে করে ঘরকন্নার কাজ পুরুষদের জন্য উপযুক্ত নয়।
অসংখ্য মায়েদের আমি গর্ব করে বলতে শুনেছি, আমার ছেলে তো পানিটাও ঢেলে খেতে পারে না। আমি অবাক হয়ে এইসব মায়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি, এইসব বলতে কি তাদের একটুও লজ্জা লাগে না? কী পরিমাণ অপদার্থ করে ছেলেকে বড় করছেন এই বোধটুকও তাদের নেই। মায়েরা ছেলেদের পড়াশুনার ব্যাপারে যতটা প্রেশার দেন, তার কণামাত্র দেন না ঘরের কাজের ব্যাপারে। কন্যাকে বলেন ভাইয়ের কাপড় ধুয়ে দিতে, ঘর গুছিয়ে রাখতে। আর তাদের রান্না করতে বলা তো বলতে গেলে অসম্ভব ব্যপার।
মায়েরা ছেলেদের পড়াশুনার ব্যাপারে খুব সচেতন, কারণ তাদের ব্রেইন প্রোগ্রামড যে ছেলেরা বড় হয়ে জব করবে, আয় করবে তাই ভালো করে পড়াশুনা করা দরকার। ঘরের বা রান্নাবান্নার জন্য তো বর্তমানে তারা আছেনই, আর ভবিষ্যতে পুত্রের সাথে থাকবে স্ত্রী নামের প্রাণীটি।
প্রিয় মায়েরা, সময় হয়েছে নিজেদের বদলাবার। এখন পর্যন্ত সন্তান পালনের মুখ্য ভূমিকাটি যেহেতু আপনি পালন করছেন তাই আপনার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি পৃথিবীকে নারীবান্ধন করে তোলার জন্য। দয়া করে ছেলেকে সোনার টুকরা ভাবা বন্ধ করুন। পুত্র এবং কন্যা দুজনকেই একই রকম করে বড় করুন। কন্যাকে পুত্রের সামনে ছোট করে উপস্থাপন করবেন না।
এটি ছেলের কাজ, এটি মেয়েদের কাজ এ বন্টন বন্ধ করুন। দুজনকেই একইভাবে পড়াশুনা করার এবং রান্নাবান্নাসহ ঘরের কাজে উৎসাহিত করুন। আপনার কন্যা পুত্র দুজনকেই বাইরের এবং ঘরের দু জায়গার কাজ করতে পাঠান। মনে রাখবেন আপনার পুত্র যদি বাজার বা ব্যংকের কাজ করতে পারে, আপনার কন্যাও তা পারবে। আপনার কন্যা যদি সুন্দর করে ঘরের কাজ বা রান্নাবান্না করতে পারে, আপনার পুত্রও তা পারবে।
পুত্রকে বুঝতে সাহায্য করুন সে স্পেশাল না, যাতে সে সারাক্ষণ অন্যের সেবা পাবার জন্য মুখিয়ে না থাকে। বড় করুন আপনার পুত্রকে আত্মনির্ভরশীল সঠিক মানুষ হিসেবে যেন সে নারী এবিং নারীর কাজকে শ্রদ্ধা করতে শেখে। রান্নাবান্নাসহ ঘরের সকল কাজ স্ত্রীর সাথে সমানভাবে করে এবং প্রয়োজনে নিজের প্রিয় খাবারটা নিজেই রান্না করে খেতে পারে।