কোভিড -১৯ : নীরব ঘাতক ‘হাইপোক্সিয়া’

জেবুন্নেছা জোৎস্না:

ষাট বছর বয়সী ব্যক্তিটি এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ফ্লুর মতো লক্ষণ নিয়ে অসুস্থ, তার শ্বাস প্রশ্বাসের হার বেড়ে গেলে তার মেয়ে পার্শ্ববর্তী একটি ক্লিনিকে কল করলে মিসেস মেরী, যিনি ঐ ক্লিনিকে একজন সাধারণ প্র্যাকটিশিনার হিসাবে কাজ করেন, রোগীটিকে দেখতে আসেন এবং অবাক হয়ে যান যে রোগী চেয়ারে বসে হাসছেন। মিসেস মেরীর কাছে রোগীর অবস্থা মোটেই সিরিয়াস মনে হয়নি, যতক্ষণ না মেরী তার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করছিলেন। এরই মধ্যে হঠাৎ রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হারের চেয়ে প্রায় তিনগুণ হলে একটা পার্পল-ব্লুয়ীশ কালার তার ঠোঁট এবং নখে ছড়িয়ে পরেছিল। সাধারণতঃ রক্তে ​​অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ৯৫% থেকে ১০০% এর মধ্যে হয় এবং ৯০% এর নিচে যেকোনও কিছু অস্বাভাবিক হিসাবে বিবেচিত করা হয়। রোগীটির ক্ষেত্রে ৬৬%, মেরী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি ভাবছিলেন হয়তো তিনি ডিভাইসটি সঠিকভাবে ধরেননি, তাই তিনি আবার পরিমাপ করলেন এবং রেজাল্ট একই। তিনি আর অপেক্ষা না করে দ্রুত এ্যামবুলেন্স কল করে রোগীকে হসপিটালাইজের ব্যবস্থা করেন।

করোনা ভাইরাসে আমেরিকায় যখন মৃত্যু সর্বোচ্চ শিখরে, তখন বাংলাদেশে অনেক সংবাদে দেখা গিয়েছে যে রাস্তা-ঘাটে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকছে: কেউ হয়তো ফার্মেসিতে গেছে ঔষধ আনতে, সেখানেই হঠাৎ মারা গেছে; কেউবা বাইক চালিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, পথিমধ্যে বাইক থামিয়ে রাস্তার পাশেই মারা গিয়েছে, অথবা কেউ হসপিটালে যাওয়ার পথেই মারা গিয়েছেন, আর কেউবা ঘুমের মধ্যে। এসব রোগীরা প্রাথমিকভাবে নিজেদের স্বাভাবিক মনে করে কোভিড ১৯’কে উপেক্ষা করেছিল, আসলে ওরা ছিল নীরব ঘাতক হাইপোক্সিয়া’র শিকার। করোনা ভাইরাসের একটি সুপরিচিত লক্ষণ হলো শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, অর্থাৎ, হাইপোক্সিয়া, যা সাধারণত শ্বাসকষ্টের দিকে নিয়ে যায়। আর এমন রোগীরা এটি অনুভব করতে পারেন না যে তাদের অক্সিজেনের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে নিচে নেমে গেছে। এ ধরনের ঘটনাকে “নীরব” বা “হ্যাপি হাইপোক্সিয়া” হিসাবেও উল্লেখ করা হয়।

যেহেতু কোভিড ১৯ একেক জনকে একেকভাবে আক্রমণ করে, এবং কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এটি তীব্র শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত লক্ষণ সৃষ্টি না করে ধীরে ধীরে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে রোগীকে নীরবে মারাত্মক স্ট্রেজের দিকে নিয়ে যায়। সাইলেন্ট হাইপোক্সিয়ায় যখন দেহের অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ৯০% এর নিচে থাকে, তখনও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিটি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারে। সেই সাথে রোগীদের করোনার অন্যান্য লক্ষণও থাকে, যেমন জ্বর বা কাশি। একসময় রোগীটির যখন হঠাৎ শ্বাস-কষ্ট এবং বুকে চাপ অনুভব করে হসপিটালে পৌঁছান, ততক্ষণে আসলে তাদের বাহ্যিক অবস্থার চাইতে তাদের শরীরের প্রকৃত অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে থাকে। আর তাই নীরব হাইপোক্সিয়া চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুলছে, কীভাবে কিছু রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম হবার পরও স্বাভাবিক ভাবে ডাক্তার-নার্সদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, অনলাইনে ব্রাউজিং করছে কোন প্রকার শ্বাসকষ্ট ছাড়া; বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করছেন ঠিক কিভাবে কোভিড ১৯ দেহকে গোপনে অক্সিজেন মাত্রা কমিয়ে সবকিছু বিধ্বস্ত করে হঠাৎ করে একটি মানুষের শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে।

জেবুন্নেছা জোৎস্না

চিকিৎসকরা অনুমান করেন যে, কোভিড -১৯ কিছু লোকের ফুসফুসকে এমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে যা তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান নয়। রোগীরা যখন জ্বর এবং ডায়রিয়ার মতো লক্ষণগুলির সাথে লড়াই করে, তখন শরীর একই সাথে অক্সিজেনের স্বল্পতার বিরুদ্ধেও লড়াই করে এবং শারিরীক ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য দ্রুত শ্বাস নিতে থাকে।

আমেরিকার লাং অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র এবং রিভারসাইড ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী ক্লিনিক্যাল অধ্যাপক ডক্টর সিড্রিক রুটল্যান্ড বলেন, “ধরুন আপনার এক গ্লাস পূর্ণ বায়ু আছে; সেটা অর্ধেক খালি হয়ে গেলে আপনি স্বাভাবিকভাবে কী করবেন? আপনি অর্ধেক হারানোর কারণে এটি দ্রুত গতিতে পূরণ করার চেষ্টা করবেন”।

অধ্যাপক রুটল্যান্ড আরও বলেন, “রোগীরা যখন তাদের দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের হার সম্পর্কে সচেতন না, এবং তারা ডাক্তারের শরণাপন্নও হন না, তখন কিন্তু রক্তে ​​অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমাগত কমতে থাকে; এবং দেহ আস্তে আস্তে অক্সিজেনের এই নিম্ন স্তরের সাথে কিছুটা সামঞ্জস্য করে নেয়, ঠিক যেমন যখন কোন ব্যক্তি উচুঁ স্থানে ভ্রমণ করেন তেমনি”। রুটল্যান্ড বলেন, যখন রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস এবং নিম্ন অক্সিজেন মাত্রা নিয়ে হসপিটালে আসে তখন তাদের বডি অনেকটা এ অবস্থার সাথে এডজাস্ট করে নেয়। তবে যা ক্ষতি হবার ততক্ষণে হয়ে যায়, কেবলমাত্র ফুসফুস নয, অক্সিজেন স্বল্পতায় সমান ভাবে লিভার, হার্ট এবং মস্তিস্ককও ক্ষতিগ্রস্ত হয়”।

কোভিড ১৯ দ্বারা আক্রান্ত তরুণ পেশেন্টরা, যাদের পূর্ববর্তী অন্য কোনরকম স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা নেই, তারা কেন হঠাৎ গুরুতর কোনও শ্বাসকষ্টের লক্ষণ ছাড়াই মারা যাচ্ছে? এর উত্তর সাইলেন্ট হাইপোক্সিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, আপনার যদি করোনা ভাইরাস থাকে, এবং হাই রিস্ক গ্রুপের মধ্যে থাকেন; অথবা আগে থেকেই অক্সিজেনের পরিমাণ কম, এবং এখনও কোন উন্নতি বোধ করছেন না, তবে আপনার ডাক্তার সাথে আলাপ করে পালস্ অক্সিমিটার ডিভাইসের মাধ্যমে ঘরে বসেই আপনি আপনার শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করতে পারেন। ডিভাইসটি আঙুলের ডগায় সংযুক্ত করলেই এটি বলে দিবে লোহিত রক্তকণিকা বাহিত অক্সিজেনের পরিমাপ। তবে অবশ্যই ডিভাইসটি ব্যবহার-বিধি সম্পর্কেও ভালোভাবে জেনে নিতে হবে, নয়তো ভুল রিডিংয়ের আশংকা থাকবে।

সর্বশেষ এটা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই যে কোভিড-১৯ এ নীরব হাইপোক্সিয়াই একমাত্র কারণ যেটা কোনরকম লক্ষণ ছাড়াই আপনার শরীরের ক্ষতি করবে। তবে এটি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.