মা দিবস, ছোট্টবেলার পিটুনি এবং আমাদের শিশুরা

হৃদিমা হক:

প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা একটি মা দিবস পার করলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা অনেকেই মায়ের সাথে ছবি আর আবেগঘন নানা স্মৃতি আর অনুভূতি শেয়ার করলাম। একইসাথে মায়ের শাসন-পিটুনির গল্প ছবিও শেয়ার করলাম। মা ছোটবেলায় ঝাড়ু, স্যান্ডেল, চামচ দিয়ে যেই পিটুনিটা দিতো! কিংবা, পড়াশোনা না করার জন্য কঠিন কান মলা! অর্থাৎ মা শাস্তি দিতো, পিট্টি দিতো, কড়া বকুনি দিতো সেইসব গল্প।

মা মানেই তো আবেগের জায়গা। তার সবকিছুই আমাদের কাছে মিষ্টি। তাই মায়ের শাস্তিগুলো বড়বেলায় আমাদের কাছে কখনও মজার, আবার কখনও মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার হাতিয়ার।

এইখানে একটু থামতে চাচ্ছি। আরেকবার ভাবি, কথাগুলো কি ঠিক বলছি? বিষয়গুলোর মধ্যে নেতিবাচক কোন দিক কি চোখে পড়ছে?

না পড়াটাই স্বাভাবিক। কারণ আমাদের সমাজ সংস্কৃতিতে মা-বাবা, শিক্ষকের উত্তম-মধ্যমকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখে এসেছি। বিষয়টা আদতে কিন্তু সেরকম নয়। সত্যিকার অর্থে অন্যায়। হ্যাঁ, অন্যায় এবং অনুচিত। এখানে কিছু অপ্রিয় কথা বলার দরকার বোধ করছি।
আচ্ছা, ভেঙ্গে বোঝানোর চেষ্টা করি।

প্রথমত ‘মা মারতো’ বলার মাধ্যমে আমরা মাকে অপমান করছি, কারণ মা যা করেছে সেটা না জেনে বুঝে অনুচিত কাজটি করেছে। সেটিকে মজা করে দেখানো কিংবা ঠাট্টা করে শেয়ার করার সুযোগ নেই। আর মা দিবসে ‘কুল’ হওয়ার জন্য সেটাকে নিয়ে ঠাট্টা না করাই মনে হয় ভালো।

দ্বিতীয়ত এই কাজটির মাধ্যমে আমরা হয়তো অজান্তেই ‘মায়ের শাসন’কে উৎসাহিত করছি, কিংবা নিজেরাও না জেনেই একই ধরনের ভুল চর্চা করার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি।

তৃতীয়ত শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। সে যদি দ্যাখে, মা বাবা তাকে মার দিচ্ছে, অপমান করছে- বিষয়টা কিন্তু সেও শিখে যাচ্ছে। নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কিংবা অন্যের ভালো করার জন্য প্রহার করতে হয় কিংবা অপমান করতে হয়; এই শিক্ষাটাই কিন্তু সে পাচ্ছে। শিশুদের জন্য এই ভায়োলেন্স শিখে যাওয়াটা যে ভালো না এখানে তো একমত না হয়ে উপায় নেই।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিশুর মানসিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আর বিকাশে বাধা। শিশুর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার মা-বাবা। বাবা মায়ের কাছে যেটা শাসন, শিশুর কাছে তো সেটা নির্যাতন, অবিচার আর কষ্ট! আর সবচেয়ে প্রিয় মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পাওয়ার যন্ত্রণাটা নিশ্চয়ই সহজ হিসেব নয়!

সত্যি কথা বলতে শিশুদের শাসনের নামে যা করা হচ্ছে তা যে উচিত না- সেটা একটু ভেবে দেখার সময় এসেছে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে আর্টিকেল ৪ এ স্পষ্টত শিশু সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে আর আর্টিকেল ১৯ এ আরো সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে বাবা মায়ের করণীয় নিয়ে। মানে, বাবা মা যদি শিশুকে নির্যাতন করে সেটাও আইনানুগ নয় এবং অনুচিত। আর ঐ যে! আমরা আমাদের সমাজ সংস্কৃতিতে দেখে আসছি- শিশুকে মার দেয়াই স্বাভাবিক! সংসারের সব রাগ অভিমান এর শিকার করে ফেলছি নিজের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা- নিজের সন্তানকে! বুঝে বা না বুঝে নিজেরাই নিজেদের সন্তানদের প্রতি করে যাচ্ছি অন্যায়!

বাংলাদেশেও শিশু আইন ২০১৩ তে কিছু নির্দেশনা আছে, যদিও অনেক দেশের মতো এখনও আমাদের দেশে নিজের সন্তানকে প্রহার, অপমান মারধরের জন্য তেমন শাস্তির ব্যবস্থা নেই কিন্তু, বিষয়টা অনুচিত এই বোধটা আমাদের মধ্যে উদয় হবার সময় মনে হয় চলে এসেছে।

ভালো থাকুক পৃথিবীর সব মা, ভালো থাকুক পৃথিবীর সব শিশু। নিশ্চিত হোক তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা…

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও সংবাদ উপস্থাপক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.