মা ও মাতৃত্ব নিয়ে কী ভয়ংকর দ্বিচারিতা আমাদের মধ্যে!

সাদিয়া আফরিন:

“মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু যেন ভাই
ইহার চেয়ে নামটি মধুর তিন ভুবনে নাই।”

কিংবা

“মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।”

উপরিউক্ত পংতিগুলো কমবেশি আমাদের সবারই জানা। শুধু এই পংতিগুলোই না আমাদের চারপাশে এমন হাজারও পংক্তি, উপমা, রূপক, গান, কথা, কবিতা রয়েছে মায়েদেরকে নিয়ে যেসব তুলে ধরতে চায় মা মানেই মধু। মাতৃত্ব মানেই মহান। কিন্তু আসলেই কি তাই?

প্রথাগত মাতৃত্বের ধারণায় নারী মাত্রই এক একজন সম্ভাবনাময়ী মা। অবধারিতভাবেই তাঁরা মাথায় পরবে মাতৃত্বের মুকুট কারণ মাতৃত্বে নারী জনমের পূর্ণতা, সার্থকতা। এই ধারণা মাতৃত্বকে নারীর “ন্যাচারাল ইন্সটিংট” হিসাবে দেখে যেটা নারীর ভিতরে “ইনবিল্ট” এবং এজন্য নারীরা মাতৃত্ব বিষয়টাকে “ওউন” করে।

এরকম ভাবাভাবির পিছনে মূল কারণ প্রাকৃতিক নিয়মে একমাত্র নারীর শরীরই সন্তান ধারণে সক্ষম। নারীর এই শারীরিক সক্ষমতা একদিকে যেমন তাকে অনন্যতা দান করে তেমনি অন্যদিকে এটিই শিশুর লালনপালনের সাথে মায়ের ভূমিকাকে অপরিহার্য করে দেখতে চায়।

মাতৃত্বকে ঘিরে এটি মূলত একটি পিতৃতান্ত্রিক মিথ যা মাতৃত্বকে পুরোপুরি বায়োলজিক্যাল ডিটারমিনেশন হিসাবে দেখে। এ-ভাবনায় মাতৃত্ব ব্যতীত নারীর যেমন উপযুক্ত কোন বিকল্প নেই, তেমনি সন্তানের প্রাথমিক সেবাদানকারী হিসাবেও মা’ই সর্বতোভাবে আকাঙ্ক্ষিত। ফলে মা হওয়া বা মাতৃত্ব যতটা না শারীরিক তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি ব্যবস্থার অনুগামী অর্থাৎ ব্যবস্থা দ্বারা নির্ধারিত এবং নারী তার শারীরিক কারণেই ব্যবস্থার অধস্তন হয়ে পড়ে।

প্রকৃতপক্ষে মাতৃত্ব বা ‘মা হওয়া’ বিষয়টা কতজন নারী বোঝে এবং সেই বোঝাবুঝিকে কাজে লাগিয়ে মা হন? মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা যায় যে বাংলাদেশের ৫০% বিয়ের কনের বয়স ১৮র নীচে এবং দেশের মোট মাতৃত্বের ২৮ ভাগ দখল করে আছেন কিশোরীরা যারা বৈবাহিক জীবন, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং এ-বিষয়ক অধিকার, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে কোনকিছু না জেনেই দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে।

বাংলা অঞ্চলে একসময় গৌরিদান বলে একটা রেওয়াজ চালু ছিলো যা বোঝাতো অষ্টমবর্ষীয় কন্যাসন্তানকে পাত্রস্থ করা। বর্তমান সময়ে গৌরিদান প্রথা হিসাবে চালু না থাকলেও বাংলাদেশ পৃথিবীতে চতুর্থ সর্বোচ্চ শিশুবিবাহের হারের মুকুট মাথায় পরে আছে। মোটামুটিভাবে প্রারম্ভিক কৈশোরকাল (১০ বছর থেকে) থেকেই কন্যাশিশুদেরকে বিয়ে, স্বামী, সন্তান, ঘর-সংসারের জন্য হাতেকলমে শিক্ষা দেয়া শুরু হয়। তাদের মনোজগতে বিবাহকেন্দ্রিক ফ্যান্টাসি এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে একসময় তাঁরা পতঙ্গের মত আলোর লোভে আগুনে ঝাপ দেয়। হ্যাঁ আগুন। কেননা নিবিড় মাতৃত্ব শ্রমঘন, এবং এজন্য মায়ের শ্রম-চিন্তা-সময়ের যে বিনিয়োগ দরকার হয় তা কখনও কোন নারীকে ব্যাখ্যা করে বোঝানো হয় না। মা হওয়ার আগে মেয়েরা জানতেও পারে না তাকে কতখানি দিতে হবে এজন্য। বরং মাতৃত্বের গৌরবকে মহিমান্বিত করে ঢেকে রাখা হয় সেইসব অভিজ্ঞতাকে যা মায়েদেরকে একসময় করে তোলে তিক্ত এবং বিপর্যস্ত।

নারীরা মা হয়ে জন্মায় না, প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা নিযুক্ত করে তাদেরকে মা হয়ে উঠতে হয়। কীভাবে? একটি শিশুর জন্মের সাথে সাথে প্রয়োজন হয় নিবিড় পরিচর্যার। শিশু বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে এই পরিচর্যার ধরন শুধু বদলায় এবং স্বাবলম্বী হয়ে না উঠা পর্যন্ত তা চলতে থাকে। তবে মোটামুটিভাবে খাওয়ানো, গোসল করানো, টয়লেট করানো, কাপড় পড়ানো, খেলাধুলা করানো, পড়ানো, চুল-নখ কাটা, দাঁত ব্রাশ করানো, কী করছে না করছে খোঁজ রাখা, কী শিখছে, বলছে, দেখছে সেদিকে নজরদারি করা অর্থাৎ জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ ইত্যাদি হাজারও কাজে মাকে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকতে হয় এবং তৈরি থাকতে হয় আলাদীনের দৈত্যের মত যেন ডাকিবা মাত্রই সে হাজির থাকতে পারে এবং এভাবেই নারী নিজেকে একটু একটু করে মা হিসাবে গড়ে তোলেন।

এই মাকে আবার শুধু মা হলেই চলে না “ভালো মা” হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কীভাবে একজন “ভালো মা” হয়ে উঠা যায় এজন্য সমাজের সর্বস্তরের মায়েদের জন্য রয়েছে নানারকম অনুশাসন, সংস্কার, রীতিনীতি, গাইডলাইন, যা আবার শ্রেণি, বর্ণ এবং গোত্রভেদে ভিন্ন, যেসব অনুসরণ করতে গিয়ে একজন মা একসময় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যান শিশুর সাথে।

একদিকে শিশুর প্রয়োজন, অন্যদিকে “খারাপ মা” না হওয়ার সামাজিক চাপ, দুইদিক সামলাতে গিয়ে সন্তান জন্মদানের পর নারীদের মধ্যে বেবিব্লু এবং পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন হতে দেখা যায়। মুড সুইং, কান্নার প্রবৃত্তি, শিশুকে আপন ভাবতে না পারা, সঙ্গীর সাথে তিক্ততা এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও তৈরি হয় অনেক নতুন মায়েদের মধ্যে। যদিও নারীর শরীরে হরমোনের পরিবর্তন এর মূল কারণ তবে সন্তান পরিচর্যার ধকল, ঘুমের ঘাটতি, সন্তানপূর্বকালের জীবনের সাথে বর্তমান সময়ের পার্থক্য, সামাজিক দূরত্ব, পাবলিক লাইফ বা কর্মজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কিংবা এ-দুইয়ের সংমিশ্রণ ঘটাতে গিয়ে আশানুরূপ ফলাফল দেখতে না পাওয়া জনিত হতাশা ইত্যাদি সমাজ-সাংস্কৃতিক ইস্যুও এক্ষেত্রে কম ভূমিকা পালন করেনা।

দেখা যাচ্ছে যে, প্রথাগত মাতৃত্ব এক অর্থে তাই শিশুর পরিচর্যাকেন্দ্রিক এবং এ-হিসাবে মায়েরা আসলে ‘শিশুর নিসঙ্গ পরিচর্যাকারী।’ নিসঙ্গ কেননা এ পৃথিবীতে খুব অল্প সংখ্যক মা’ই আছেন যারা শিশুপ্রতিপালনের কাজে সাহায্যকারী পেয়ে থাকেন, আর পেলেও মা-বোন-শ্বাশুরিকে হয়তো পান কিন্তু শিশুর পিতাকে নয়। ফলে একা একা এই কাজটি করতে গিয়ে তারা একাকীত্ব বোধ করেন, হতাশায় ভোগেন আবার কারণে অকারণে নিজেদেরকে দোষী ভাবতে থাকেন, বিশেষ করে যখন তাঁরা বাচ্চাদের ঠিকঠাক যত্ন নিতে ব্যর্থ হন।

আর এই মায়েরা যদি কর্মজীবী হোন তাহলে তাকে প্রতিনিয়ত হোঁচট খেতে হয় শিশু প্রতিপালন ও রুটিরুজির ভারসাম্য আনতে গিয়ে, কারণ এ-দুটোর কোন একটাতেও সামান্য অবহেলা করার অবকাশ নেই। ফলে সন্তান এবং বাইরের কাজ এই দুটোকে সামলাতে গিয়ে “সুপার ওম্যান, সুপার মম” সিন্ড্রোমে ভুগতে থাকেন অনেক কর্মজীবী মা অর্থাৎ তারা দুইক্ষেত্রেই ‘পারফেকশন’ আনতে চান এবং এটা করতে গিয়ে নিজেকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকেন। এই মায়েরা তখন গানের চরণের মতো কতটা মধুর হাসি হাসতে পারেন কিংবা হাসলেও সেই হাসির জন্য তাকে কতটা দাম মেটাতে হয় তা আমরা গান-কবিতায় দেখতে পাই না।

প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় মাতৃত্ব এবং পিতৃত্ব সমার্থক নয়। নারীরা প্রতিনিয়ত যেখানে শিখতে থাকেন অথবা শিখতে বাধ্য হন কিভাবে “ভালো মা” হয়ে উঠতে হয় সেখানে পুরুষ, শ্রেণি, পেশা, ধর্ম নির্বিশেষে, গৃহস্থালীর অন্যান্য কাজের মত পিতৃত্বের দৈনন্দিন দায় থেকেও মুক্ত। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম ধারক বাহক আমাদের পূর্ব প্রজন্মের নারীরা মানে মা-বোন-শাশুড়ি-খালা-চাচী-দাদী-নানীরা পুরুষদের বেড়ে ওঠার যাত্রাপথে, এবং পরবর্তীকালে স্ত্রী-কন্যারা, তাদের সবচেয়ে বড় যে “উপকারটা” করেন তা হলো ঘর-গেরস্থালীর কাজ থেকে তাদেরকে বিযুক্ত করা। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক প্ররোচনায় ঘর-গেরস্থালীর কাজ চিহ্নিত হয় ‘মেয়েলী’ কাজ হিসাবে, যেসবে পুরুষদেরকে যুক্ত না হলেও চলে। সংসারিক কাজে নিষ্ঠা, পারদর্শিতা পরিমাপের জন্য নানারকম সামাজিক সার্ভিল্যান্স নারীর ক্ষেত্রে যতটা জোরালো, পান থেকে চুন খসলে যেভাবে লোকজন চারদিক থেকে হা রে রে করে তেড়ে আসে, পুরুষের ক্ষেত্রে কিন্তু বিষয়টি একেবারেই তা নয়। এক্ষেত্রে তাদের কোন দোষ তো নেই-ই বরং পৌরুষ প্রমাণের জন্য পুরুষদের ‘মেয়েলী’ কাজ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে উৎসাহিত করা হয়।

তবে শিশু প্রতিপালনে পুরুষ অংশগ্রহণ না করলেও কিংবা দায়িত্ব এড়িয়ে গেলেও পুরুষ পিতাই এ-সমাজে শিশুর একমাত্র বৈধ অভিভাবক হিসাবে স্বীকৃতি পান। পিতৃতান্ত্রিক বংশধারাই সন্তানের বংশধারা হিসাবে সামাজিকভাবে অনুমোদিত হয়। মায়েদের নিয়ে এতো এতো গালগপ্পো, কথার ফুলঝুরি, মাতৃত্বের মিথ হাওয়ায় মিলিয়ে যায় যখন কোন মা সন্তানের অভিভাবকত্ব চান। তবে পিতা যখন সন্তানের দায়িত্ব না নিয়ে অন্য কোথাও সংসারী হোন, তখন এই সমাজই মা’কে ধৈর্য ধরে সন্তানকে প্রতিপালন করার দায়িত্ব দেয় এবং বিশেষ করে, তাকে অন্যত্র সংসার গড়তে নিরুৎসাহিত করে, কেননা মা অন্যত্র সংসার গড়লে সন্তানকে কাছে রাখার অধিকারটুকুও তিনি হারান।

প্রশ্ন জাগে নিষ্ঠার সাথে পাহাড় সমান দায়িত্ব নিয়ে সন্তান বড় করার আত্মত্যাগ কি কেবল একলা মায়েদেরই নিয়তি? যে মা অন্যত্র সংসার গড়েন তিনি কি আর মহান থাকেন না? মা ও মাতৃত্ব নিয়ে কী ভয়ংকর দ্বিচারিতা আমাদের মধ্যে!

মাতৃত্ব নিয়ে মায়েদের বিড়ম্বনারও কি শেষ আছে? অনেক মাকেই চাকরীর সময় চলমান প্রেগন্যান্সির বিষয়টিকে আড়াল করতে হয় কারণ তাঁর গর্ভের বিষয়টি জানলে নিয়োগকর্তা হয়তো তাকে আরে চাকুরীর জন্য বিবেচনাই করবেন না। আবার অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানেই প্রেগন্যান্সি ‘ইনফরমালি ডিসকারেজড’ অথবা প্রেগন্যান্সি মানেই চাকুরীচ্যুতি। কেন এই কর্মী মায়েরা কি বিষাক্ত? তাঁরা মধুর পেয়ালা বহন করেন না হাসিতে?

আমাদের সমাজ মাতৃত্বকে ভীষণভাবে মহিমান্বিত করার পাশাপাশি একে করেছে বিবাহ ব্যবস্থার আজ্ঞাবহ, ফলে মাতৃত্বের সামাজিক স্বীকৃতি ও আইনানুগ বৈধতার জন্য বিবাহব্যবস্থার মধ্যে থাকা একটি অবশ্যপালনীয় শর্ত। তো বিবাহিত নারী মাত্রই প্রতিনিয়ত শুনতে হবে:

“বিয়ে তো হলো এবার একটা বাচ্চা নাও।

আপনি দেরি করছেন কী করছেন না সে সম্পর্কে না জেনেই বলবে:

“দেরি কোরো না। দেরি হয়ে গেলে আর বাচ্চা হবে না।”

আবার আপনি কোনভাবে একটা বাচ্চা নিলে বলবে:

“ওর তো খেলার সাথী দরকার, আরেকটা বাচ্চা নাও। ফ্যামিলি কমপ্লিট করো।”

বললেন বাচ্চা খুব জ্বালায়। এক্ষেত্রেও যুক্তি “বাচ্চা জ্বালাবেই তো একা একা সারাদিন ওর কতই ভালো লাগে। একটা ভাইবোন থাকলে তোমাকে বিরক্ত করতো না।” স্বামী ভালো না তো বাচ্চা নাও। প্রতিকূল শ্বশুরালয় তো বাচ্চা নাও। মাতৃত্ববরণই যেন সকল রোগের মহৌষধ!

অথচ একজন অবিবাহিত নারী যদি মাতৃত্বের গৌরব অর্জন করতে চান এ-সমাজ তাকে স্বাগত জানাবে না। একজন যৌনকর্মী কি সমাজের আর দশটা মায়েদের মত মহৎ মাতৃত্বের ভাগীদার হতে পারেন? পারেন না কারণ তাঁর পেশা এবং পিতৃপরিচয় সংকট; কিংবা একজন ধর্ষিতা অথবা সিঙ্গেল মা যখন ছলনা, চাতুরি বা দূর্ঘটনার কারণে ঘটনাচক্রে মা হয়ে মাতৃত্বের বোঝা বয়ে বেড়ান তাঁরা মাতৃত্বকে কতখানি জীবনের পূর্ণতা ভেবে সুখী হতে পারেন বলা দুরূহ?

অতএব দেখা যাচ্ছে যে, মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা নারীর প্রেক্ষাপটভেদে ভিন্ন ফলে মাতৃত্বের পুর্ণতা, গৌরবের মিথ তাই পৃথিবীর সকল নারীর জন্য সমান অর্থ বহন করে না।

মাতৃত্বকেন্দ্রিক আলোচনায় হালের সংযোজন ‘রিগ্রেটিং মাদারহুড’ মাতৃত্বকে প্রথাগত “ভালো মাতৃত্ব”র ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে বিনির্মাণ করে। কেন বাচ্চা নিলাম? মা হয়ে কী পেলাম? বোকারাই কি বাচ্চা নেয়? মাতৃত্ব কি আমার জন্য একটা ট্র্যাপ? বাচ্চাকাচ্চার ঝুটঝামেলার চাইতে নির্ঝঞ্ঝাট লাইফ ভালো ছিলো? আমি কি মা হতে চেয়েছিলাম? আমি কি এই জীবন চেয়েছিলাম? রিগ্রেটিং মাদারহুড গবেষকরা দেখিয়েছেন অনেক মায়েদের মধ্যে সন্তান লালনপালন ও মা হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে একধরনের অসন্তুষ্টি বা দ্ব্যার্থবোধকতা কাজ করে, বিশেষ করে মাতৃত্বকেন্দ্রিক প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যোগফলে যখন গড়মিল হয়। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এই তাত্ত্বিককরা বলেন, এই মায়েরা বিশেষ জোরারোপ করেন যে আগের জীবনে ফিরতে পারলে তাঁরা কখনও মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন না। ফলে দেখা যাচ্ছে যে মাতৃত্বের ধারণা স্থির বা সার্বজনীন কিছু নয় বরং এটি বৈচিত্র্যকে ধারণ করে।

পরিশেষে বলতে চাই, মাতৃত্বকে নারীর শরীরের সাথে অপরিহার্যভাবে দেখতে চাওয়া মূলত একটি খণ্ডিত ভাবনা। আবার মাতৃত্ব মানেই মহান, নারীকে এনে দেয় গৌরবের জয়মাল্য এমন ভাবাভাবিও মাতৃত্বকেন্দ্রিক পিতৃতান্ত্রিক মিথ ছাড়া কিছু নয়। বরং যে সমাজ-সাংস্কৃতিক চাপে পড়ে নারীকে মা হয়ে উঠতে হয় বা “আত্মত্যাগে” বাধ্য করা হয় সেই প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন করা জরুরী। তবে মাতৃত্ব ও ‘আত্মত্যাগ’কেন্দ্রিক দৃষ্টভঙ্গির সীমাবদ্ধতা হলো এটি সন্তানকে মায়ের জীবনে অহেতুক অনাসৃষ্টিকারী উপাদান হিসাবে দেখা হয় সন্তানের সাথে মায়ের আনন্দের পর্বগুলোকে আমলে না নিয়ে।

কিন্তু বিষয়টি এতো সরল নাও হতে পারে। কোন নারী শিশু পছন্দ করতে পারেন কিন্তু শিশু প্রতিপালনের চাপ একা একা বহন করতে রাজি নাই থাকতে পারেন। শিশু প্রতিপালনের মা’কেন্দ্রিক সামাজিক নির্মিত দায়দায়িত্বকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। এজন্য আমি মনে করি পরিবারের সকল সদস্যদের মধ্যে শিশু প্রতিপালনের দায়িত্ব বিভাজিত হওয়া জরুরী।

মাতৃত্বকে আমি বরং শিশুদেরকে ঘিরে তৈরি হওয়া একটি অনুভুতি বা আত্মিক বন্ধন হিসাবে পাঠ করতে চাই। এই অনুভূতি বায়োলজিকাল ডিটারমিনেশনের উর্ধে। একজন বাবা, যিনি কিনা শারীরিকভাবে পুরুষ, একজন অবিবাহিত নারী বা পুরুষ, একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি মাতৃত্বের অনুভূতি বয়ে বেড়াতে পারেন। শিশুর সাথে যেকোন নিবিড় সম্পর্কই মাতৃত্বকে ধারণ করতে পারে সেক্ষেত্রে শিশুর পরিচর্যাকারী যেই হোক না কেন। আমাদের সমাজেই বহু দম্পতি সন্তানকে মা, শাশুড়ি কিংবা বোনের কাছে রেখে বড় করেন।

সন্তান দত্তক নেয়ার ঘটনাও আজকাল অহরহ। সুতরাং মাতৃত্বকে মায়ের একার অর্জন, আত্মত্যাগের গল্পগাঁথা অথবা মাথার উপর চাপিয়ে দেয়া বোঝা না বানিয়ে একে শেয়ারড রেসপনসিবিলিটি হিসাবে দেখা জরুরি। মোদ্দা কথা হলো, শুধু নারী একা নয়, শিশুর সাথে জড়িত সবাই যদি শিশু প্রতিপালনের দায়-দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়, তাহলে মাতৃত্ব কেবল আর মায়ের আত্মত্যাগের ন্যারেটিভ হিসাবে বিদ্যমান থাকে না, বরং একটি পরিবারে শিশু থাকার যে আনন্দ সেটা সকলে মিলে উপভোগ করতে পারে। এই ভাবাভাবির সবচেয়ে বড় সুফল হলো মাতৃত্ব সম্পর্কিত সকল প্রতিষ্ঠিত মিথকে উড়িয়ে দিয়ে যে কেউ (বিবাহিত-অবিবাহিত, নারী-পুরুষ, এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি অথবা সিঙ্গেল মাদার) মাতৃত্বকে চয়েস হিসাবে বেছে নিতে সক্ষম হবে।

নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.