মুশফিকা লাইজু:
মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও ক্ষমতাবান, আশার চেয়েও বড়। সেই ক্ষমতা বা আশার কারণেই আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি পৃথিবীর এই মহা ক্রান্তিকাল কেটে যাবে একদিন। রাত্রির আঁধার যত গভীর, ভোর তত সন্নিকটে। সেই নতুন ভোর আমরা কীভাবে নির্মাণ করবো? করোনা ভাইরাস মহামারীতে পুরো পৃথিবীই যেখানে দিশেহারা, সেখানে এই হতদরিদ্র বাংলাদেশে আমরা টিকেই বা থাকবো কীভাবে? কীভাবে করবো স্বপ্নচয়ন, কীভাবে পাল তুলে ধরবো আগামী পৃথিবীতে? এমনি সব প্রশ্নে হাবুডুবু খাই সাম্প্রতিক সময়ে।
বাংলাদেশে করোনা মহামারীর গ্রাফটা এখন ঊর্ধ্বমুখী। আর এই উড্ডয়ন কোথায় গিয়ে থামবে তা আমরা অনুমান করতে পারলেও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। ভয়কে জয় করে যদিও ধরে নিই যে জনসংখ্যার মোট ৫% ভাগকে পৃথিবী ছাড়তে হতে পারে! তার মধ্যে ৩% ভাগ দুর্ভাগা হতভাগ্য মানুষেরা হবে বা এরই মধ্যে হয়ে গেছে।
মাঝবয়সী কর্মক্ষম পরিবারের প্রধান শহুরে পুরুষ। যেহেতু ঢাকা শহর ও বিভিন্ন জেলা শহরের মানুষই বেশী আক্রান্ত হচ্ছে এখন পর্যন্ত। এরই মধ্যে সাধারণের পাশাপাশি জনসেবা প্রদানকারী কিছু পেশাজীবী ভাইদের আমরা হারিয়েছি। তার মধ্যে ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক শ্রেণির লোকেরা আছেন। যে সকল পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ করোনা ভাইরাসে কারণে প্রাণ হারিয়েছেন, সেই পরিবারগুলো রাতারাতি নারীপ্রধান পরিবারে পরিণত হয়েছে। এতোদিন তাদের স্বামীরা, বাবারা বা ভাইয়েরা যে পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, এক রাতের ব্যবধানে তা শূন্যে পরিণত হয়েছে। আর ঐ পরিবারসমূহের নারীকেই স্বেচ্ছায় হোক বা নিরুপায় হয়েই হোক, পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে বা হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
আমরা জানি না এ যাবতকালে যাদের হারিয়েছি তাদের স্ত্রীরা বা মায়েরা চাকরী কিংবা ব্যবসা করেন কি না? বা উপার্জনের সাথে যুক্ত আছেন কি না, আমাদের কাছে কোন পরিসংখ্যান নেই। আমরা শুধু লাশেরই হিসাব রাখি। মৃতদেহের পরিসংখ্যান আমাদের মস্তিষ্ক জুড়ে। কিন্তু যিনি চলে গিয়ে পরিবারের মধ্যে জীবন্ত কিছু লাশ রেখে গেলেন, সেইসব জীবন্ত লাশেদের কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে থাকে না। যেনো থাকতে নেই, সেটাই বাস্তবতা। কিন্তু করোনা ভাইরাস বিপর্যয়টা অন্য আর দশটা দুর্যোগ থেকে বেশ আলাদা। এটা বৈশ্বিক বির্পযয়। এর প্রস্তুতি, প্রতিকার পুনর্বাসন এবং প্রতিরক্ষার নিরিখ বৈশ্বিক মাপকাঠিতেই হওয়া উচিৎ।

আমরা বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় ধরেই নিচ্ছি, করোনা ভাইরাসে প্রাণ হারানো পরিবারগুলির এক-তৃতীয়াংশ নারীই উপার্জনের সাথে যুক্ত নয়। তাহলে কী হবে সেই পরিবারগুলির লালন-পালনের? পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষটি করোনায় যখন প্রাণ হারালেন, তার পরের দিন থেকেই ঐ সদ্য একলা হওয়া নারী কীভাবে পরিবারের সামগ্রিক ব্যয়ভার বহন করবেন? স্বাভাবিক মৃত্যুর সাথে কোনভাবেই এই করোনা-আক্রান্ত মৃত্যুকে মেলানো যাবে না, ঠিকও হবে না।
স্বাভাবিক সময়ে পরিবার প্রধানকে হারানো একটি পরিবার তাদের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সহমর্মিতা, সহযোগিতা এবং সাহায্য পেয়ে থাকেন। আমাদের সামাজিক রীতি অনুযায়ী আত্মীয়-প্রতিবেশীরা কয়েকদিনের খাবার পর্যন্ত রান্না করে সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু করোনা-আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে, এমন সদস্যদের পরিবারগুলি রাষ্ট্রিয়ভাবে এবং সামাজিকভাবে বন্দি, পরিত্যক্ত ও পরিত্যাজ্য জীবনযাপন করতে শুরু করেন। এবং এই বিসর্জিত জীবন মেয়াদহীন। পরিচিত কিছু মানুষের মানবিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা কাছে যেতে পারে না। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার জন্য সাহায্যের আকারও সীমিত হয়ে যায়। সুতরাং করোনায় না মারা গেলেও বিভিন্ন বিপর্যস্ত অবস্থায় তারা মরণাপন্ন হয়ে বাঁচে। যাকে মানুষের মতো বাঁচা বলা যাবে না।
তাই রাষ্ট্র, সাহায্য সংস্থা ও সুশীল এবং মানবিক সমাজকে এই বিপন্ন জনগোষ্ঠিকে নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। করতে হবে আগামীতে এই নারী প্রধান পরিবারগুলিকে টিকিয়ে রাখার এবং টিকে থাকার টেকসই পুনর্বাসনমূলক সহযোগী পরিকল্পনা।
করোনাকালিন এবং করোনা-উত্তর সময়ের মূল বাজেট থেকে এদের পুনর্বাসনের জন্য কার্যকরি বাজেট ও পরিকল্পনা করতে হবে। তাদের জন্য আলাদ করে প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রকল্পবাস্তবায়ন করতে হবে। এবং এই দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে প্রধানত। করোনা পরর্বতীতে এই বিপন্ন নিঃস্ব পরিবারের সংখ্যা নেহায়েত কম হবে না। নারী প্রধান এই পরিবারগুলির পুনর্বাসন কার্যক্রম আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের অর্ন্তভুক্ত হিসেবেই গণ্য হবে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি।