শান্তা মারিয়া:
ছোটবেলায় যেসব বাংলা সিনেমা দেখেছি তার মধ্যে একটা ডায়লগ ছিল খুব কমন। ধনী পরিবারের নায়ক বা নায়িকা বিয়ে করেছে বা করতে চায় গরীব পরিবারে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল গলা কাঁপানো সংলাপ, ‘চৌধুরি বাড়ির মান ইজ্জত সব ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিস’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই একই ডায়লগ শুনতে পাচ্ছি আমাদের সহকর্মী সাংবাদিক পারুল তার স্বামী প্লাবনের বিরুদ্ধে ভ্রুণ হত্যা, যৌতুক ও নির্যাতনের মামলা করায়। এতে নাকি সাংবাদিক সমাজের মান সম্মান সব চলে গেছে। ‘ঘরের কথা পরকে জানানো’ নাকি একদম উচিত হয়নি। মামলা যেহেতু হয়েছে তাই সে বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে এখন আর বলার কোন মানে হয় না। কারণ আইন তার নিজের গতিতেই চলবে।
তবে কিছু কথা না বললে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে তাই বলছি। প্রথমত, যৌতুক দাবি, শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন, ভ্রুণহত্যা সবগুলোই ফৌজদারি অপরাধ। এগুলো মোটেই ‘ঘরের কথা’ নয়, বরং ‘আইনের কথা’। আর মিউচুয়াল করার কথা যারা বলছেন, তাদের বলি এগুলো কোনটা নিয়েই ‘মিউচুয়াল’ হয় না। বরং আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হয়। সেক্ষেত্রে পারুল ঠিক কাজটি করেছে। প্লাবনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তার দ্রুত গ্রেপ্তার দাবি করছি। আর বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত হলে শাস্তির বাস্তবায়নও দাবি করছি।
এখন দুটো কথা বলতে চাই চৌধুরি বাড়ির মান সম্মান প্রসঙ্গে। সাংবাদিকতা পেশায় সব সাধু পুরুষরা এবং মহাপুরুষেরা আছেন এই ধারণা কোথা থেকে হলো এবং কবে থেকে হলো সে কথা আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। আমি সাংবাদিকতা পেশায় আছি ১৯৯৭ সাল থেকে। তখন থেকেই দেখে আসছি একেকটা মিডিয়া হাউজ যৌন হয়রানির আখড়া। আর প্রেমে প্রতারণা তো এখানে ডালভাত। সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম, লিভ টুগেদার এবং তারপর তাকে ডিচ করে অন্যত্র বিয়ে মিডিয়া হাউজে আকছার ঘটছে। এখানে অনেকে বলবেন, ‘মেয়েরা প্রেম করে কেন?’‘মেয়েরাও সমান দোষী’। হ্যা, আমি বলতাম এখানে নারী পুরুষ সমান দোষী যদি না সমাজে তাদের অবস্থানে পার্থক্য থাকতো। একটি ছেলে হাজারটা প্রেম করেও যদি বিয়ে না করে তাহলে সমাজে তাকে বরং ‘বাহবা’ দেওয়া হয়। পুরুষ একখান, ব্যাটা একখান। ‘দশটারে ঘুরাইছে, নাচাইছে, কিন্তু বিয়ে করছে ফ্যামিলির পছন্দে’। আর মেয়েরা যদি একাধিক প্রেমের পর বিয়ে না করে এবং পরিবারের পছন্দে কাউকে বিয়ে করে তাহলে যেসব গালি শুনতে হয় তার আর উল্লেখ না করি। তাই সুবিধার পাল্লাটা পুরুষের দিকেই যে ভারি থাকে একথা চরম পুরুষতান্ত্রিক মানুষটিও বুঝতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত চাকরিও হারায় মেয়েটি। ছেলেটির কিছুই হয় না।
আর যৌন হয়রানির যে ঘটনাগুলো ঘটে তার বেশিরভাগই ঘটায় মেয়েটির উচ্চ পদস্থরা। চিফ রিপোর্টার, সিটি এডিটর, নিউজ এডিটর, এডিটর, সিএনই, হেড অফ নিউজ লেভেলে ঘটনাগুলো ঘটে। চাকরি হারাবার ভয়ে, প্রমোশনের লোভে, উচ্চ সামাজিক মর্যাদার লোভে, মান সম্মান হারানোর ভয়ে নারীটি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় রাজি হয়। উচ্চ পদস্থদের ‘প্রেমিকা’, ‘বান্ধবী’ হতে পারলে ক্ষমতায়িত হওয়ার লোভও কাজ করে। যদিও এইসব ‘বান্ধবী বা প্রেমিকার পদ’ বেশিদিন থাকে না। মুখগুলো বদলে যায়।
বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন চেহারায়, বিভিন্ন আকারে, ছোট বড় বিভিন্ন গুরুত্বে যৌন হযরানির সমস্যাটি হাজির হয় মিডিয়ায় কর্মরত নারীদের সামনে। কখনো প্রেমের প্রস্তাব, কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, কখনো যৌনগন্ধী বিদ্রুপ ও কথাবার্তা, কখনো যৌন হুমকি, কখনো কম্পিউটার স্ক্রিনে অশালীন ছবি সেভ করে রাখা, কখনো ফেইসবুকে হয়রানি, আবার কখনো আড়ালে আবডালে তার নামে রসালো আলাপ, কখনো তার চরিত্রে বদনাম আরোপ-এমন কোনো নারী সাংবাদিক নেই যিনি পেশাজীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এগুলোর মুখোমুখি হননি। প্রতিবাদ করতে গেলে হয় তার চাকরি যায় অথবা তাকে উদ্দেশ্য করেই নানা রকম বিরূপ কথাবার্তা চালু হযে যায় অফিসে। অনেক সময় খেতাব জোটে ‘পাগল মহিলা’। কর্মক্ষেত্রে যদি কোনো বিবাহিত নারী অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কোনো বিবাহিত বা অবিবাহিত সহকর্মীর সঙ্গে তাহলে শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয় নারীটিকেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাকরি হারাতে হয় নারীকে এবং নানারকম অবমাননার শিকার হতে হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সিনিয়র পুরুষ সহকর্মী অথবা কর্তৃপক্ষের যৌন হয়রানির শিকার হয়ে নিরবে চাকরি ছেড়েছেন অনেক নারী সংবাদকর্মী কারণ প্রতিবাদ করে বিষয়টি নিয়ে হইচই করলে তারই সামাজিক সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার আশংকা থাকে। তাই কিল খেয়ে কিল হজম করেই অনেকটা চুপিসারে বিদায় নেন তারা। অথবা হয়রানিকারীর কুপ্রস্তাবে অনিচ্ছা সত্তেও সাড়া দিয়ে নিজের চাকরি ও পজিশন ধরে রাখেন্ অনেক নারী।
কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন বৈষম্য রোধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স স্থাপনের বিধান হাইকোর্ট দিলেও এখনও কোনো মিডিয়া হাউজে এ ধরনের অভিযোগ বাক্স চোখে পড়েনি। নারীর প্রতি যৌন হয়রানি রোধে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিনিয়র নারীকর্মীসহ সিনিয়র কর্মীদের নিয়ে একটি কমিটি থাকার বিধানও রয়েছে। কিন্তু কাজীর গরু এখনও কেতাবেই রয়ে গেছে অভিযোগ বাক্স ও হয়রানি প্রতিরোধক কমিটির অস্তিত্ব কোনো মিডিয়া হাউজেই নেই।
সাংবাদিকতায় কর্মরত এমন অনেক ‘মহাপুরুষ’ আছেন যাদের নাম বললে চাকরি থাকবে না। এরা যে কতভাবে নারীদের হয়রানি করেছেন ও করছেন, কত লীলাখেলা করেছেন সে কথা প্রকাশ করলে এই লেখা অশালীনতা দোষে দুষ্ট হবে। ছুচো মেরে নিজের হাত গন্ধ করে কোন লাভ নেই। আবার এরাই এসব কথা প্রকাশ করতে গেলে ‘সাংবাদিকতা পেশার মান সম্মান চলে গেল’ বলে আহাজারি করেন। চৌধুরি বাড়ির পোলা, আশি টাকা তোলা বলে দর হাঁকেন। আর চৌধুরি বাড়ির মেয়েরা চুপ থাকেন দৃশ্য ও অদৃশ্য চাবুকের ভয়ে। আবার আরেকটি চিত্রও আছে। কোন মহাপুরুষ অথবা সেমি-মহাপুরুষ যখনি অভিযুক্ত হয়, কেউ যখন সাহস করে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলে তখন শুরু হয় আরেক নাটক। কিছু ক্ষমতালোভী নারী (যারা অন্তরে পুরুষবাদী বা ক্ষমতাবাদী)তারা সেই পুরুষটির চারপাশে নাচতে থাকেন। অভিযোগকারী মেয়েটিকে গালি দিয়ে বুঝাতে থাকেন, ওই মেয়েটিই খারাপ। ভাবখানা হলো ‘তুমি ওর কাছে গিয়েছিলে কেন? দেখ তো আমি ওর চেয়ে কত সুন্দরী, কত্ত স্মার্ট, তোমাকে কত্ত আদর যত্ন করি। আর তুমি ওই পেত্নীর কাছে যাবে না্ কেমন? আর ক্ষমতার ভাগযোগ, বিয়ে শাদি যা করতে হয় আমাকেই করবে’ । যাদের আর ওই ব্যাটার সঙ্গে প্রেমের বয়স নেই তারা ‘ভাই আমার, যাদু আমার’ বলে ডাকতে থাকে সুবিধা পাওয়ার আশায়। এদের কারণেই মিটু আন্দোলন বাংলাদেশে হালে পানি পায়নি।
কার্পেটের নিচে ময়লা ঢেকে রাখলে কখনও ঘর পরিস্কার হয় না। পরিষ্কার করতে হলে সব ময়লা ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হয়। আর সেসময় ময়লাগুলো চোখে পড়বে, কিছুটা গন্ধও ছড়াবে বটে তবে আলটিমেটলি ঘরটা পরিষ্কার হবে। সাংবাদিকতা পেশার এইসব ময়লাগুলো দূর করার সময় এসেছে বৈকি। দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ। সেজন্যই নীরবতা ভেঙে মুখ খুলতে হবে। বিচার চাইতে হবে।
আজ শুধু সাংবাদিকতা পেশার কথা বললাম। অন্য পেশার মহাপুরুষদের( মহানারীদেরও) মুখোসও উন্মোচন করবো। ধীরে বন্ধু ধীরে।