পরবাসে স্বর্গবাস

সঙ্গীতা ইয়াসমিন:

বহুদিন থেকেই মনের কোণে এক সুক্ষ্ম যাতনা খচখচ করছিল এই বিষয়ে দু’কথা বলার জন্য।সময়ের অভাবে লেখালেখিতে মনোযোগ দিতেই পারিনি। মনোকষ্ট লাঘবে আপাতত তাই আমার ইলেক্ট্রনিক ডায়েরির পাতায় কিছু লিখছি। যখনই তার পাতা উন্মুক্ত করি সে-ই তো প্রথম আমায় জিজ্ঞেস করে, হোয়াটস আপ ইন ইওর মাইন্ড?

বিশেষ করে করোনা শুরু হবার পর থেকে বিষয়টি উপলব্ধ হচ্ছে আরও ঘনীভূত হয়ে। যখন থেকে কোনো এক ‘সাম্বাদিক’ দ্বারা (সাংবাদিক) জাস্টিন ট্রুডোর ভাষণ বাংলায় (অতিরঞ্জন ও অবাঞ্ছিত শব্দচয়নে) অনুদিত হলো আর মুহূর্তেই সেটি ফেসবুকের পাতায় ভাইরাল হয়ে ঝর তুললো,তখন থেকেই দূরের, কাছের, পরিচিত-অপরিচিত অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীরা কথাচ্ছলে একটা সুক্ষ্ম খোঁচা দেন, আর পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। যেনো প্রবাসীদের আঘাত দিয়ে কথা বললেই তাঁদের জীবনের সকল সমস্যার মুশকিল আশান হয়ে যাবে।

ইতিপূর্বেও লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশী বন্ধুগণ কারণে-অকারণে বলে থাকেন, ‘তোমরা তো বিদেশে থাকো’ তোমাদের আর সমস্যা কী? আসলেই, আমাদের কোনো সমস্যা নাই।

কিন্তু আমি একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না, আপনি, আপনারা যারা খুবই সমস্যাক্রান্ত, তাঁরা চলে আসছেন না কেনো বাংলাদেশ ছেড়ে? যখন বিদেশ মানেই স্বর্গ আপনাদের কাছে?

না কি বলবেন, আপনারা দেশকে খুব ভালোবাসেন, তাই আসতে চাইছেন না? আপনাদের দেশপ্রেমে দেশ ভেসে যাচ্ছে উন্নয়নের জোয়ারে! প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে (শ্রমিক ছাড়া) অনেকেরই গাত্রদাহ আছে। একবার কোনো এক বক্তব্যে আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারও প্রবাসীদেরকে তুলোধুনা করেছিলেন। যদিও জানি না তাঁর ক্ষিপ্ত হবার কারণ কী ছিল!

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৈধ অভিবাসনের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (প্রক্রিয়া ভিন্নতর) ছাড়াও কর্মসূত্রে, বিবাহসূত্রে, শিক্ষাসূত্রে এবং সর্বোপরি ব্যবসায়িক সূত্রে বাংলাদেশী বাঙালিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বৈধ অভিবাসনের মধ্যে এই ব্যবসায়ী শ্রেণীরা নিঃসন্দেহে অনেক অর্থকড়ির মালিক। আপনি যখন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত পরিশ্রম করেন, তখন টাকাওয়ালা, গাড়িওয়ালা, কিংবা বাড়িওয়ালার সুখ দেখে আপনার গাত্রদাহ হবে সে-ই স্বাভাবিক।

তবে দুঃখের কথা হলো এই যে, গাত্রদাহ নিবারণের জন্য না সেইসব গাড়ি-বাড়িওয়ালারা, না রাষ্ট্র, না সরকার কেউই আপনার দায়িত্ব নেবে। সুতরাং, যে বা যারা, প্রবাসীরা স্বর্গরাজ্যে আছেন ভেবে আপন ঘরেই বহুল কষ্টে জর্জড়িত হয়ে দিনাতিপাত করিতেছেন, তাঁদেরকে বলি, আসুন, আপনাকে, আপনাদেরকে সুস্বাগতম! কানাডায় চলে আসুন, এখানে আসবার যোগ্যতা অর্জন করুন আগে। আসার পরের যাবতীয় দায় জাস্টিন ট্রুডো নেবেন, সে আপনারা খুব ভালো করেই জানেন। আজই শুরু করুন সেই প্রক্রিয়া।

বস্তুত অভিবাসনের উদ্দেশ্য ব্যক্তিভেদে ভিন্নতর হবে সেটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ভেদে জীবনের অর্জন, সফলতা, কিংবা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যও ভিন্নতরভাবে সংজ্ঞায়িত হয়। এখানে কোনো স্থির সত্য, কিংবা ভুল-ঠিক বলে কিছুই নেই, বরং কিছু পুশ-পুল ফ্যাক্টর রয়েছে, যা মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করে আবার করেও না। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হলো, বৈধ অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সক্ষমতা সকলের থাকে না।

পরবাসীদের জীবন, সাধারণত আমার মতো খেটে খাওয়া প্রবাসীদের জীবনের রঙগুলো অনেকটাই কাছাকাছি। শেকড় ছিঁড়ে আসার বেদনা সকলের একরকম নাও হতে পারে। কেউ কেউ দ্রুতই বৈরি জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠার সক্ষমতা নিয়েই পৃথিবীতে আসেন। তবে যেকোনো হিসেবেই মননশীল মানুষের জন্য অভিবাসন খুব সহজতর ব্যপার নয়। এ বেদনা বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই। ফেসবুকে খাবারের ছবি দেখেন, বেড়ানোর ছবি দেখেন, বাইরের চাকচিক্যের অনেককিছুরই ছবি আপনারা দেখেন; ভেতরের বেদনাটুকুন ঢেকে রাখবার জন্য হতেও পারে ওসব প্রলেপ! কে জানে কার বেদনার পাহাড় কতো সুউচ্চ!

খুব বড় চাকুরে, কিংবা ব্যবসায়ী ছাড়া অভিবাসীরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে পরবাসে দিন গুজরান করেন এমন দৃশ্যও আমার চেনা ছবিতে নেই। বেশিরভাগেরই দেশে পরিবার-পরিজনকে অর্থ সাহায্য পাঠাতে হয়। যাঁদের নিয়মিত পাঠানোর প্রয়োজন নেই, তাঁরা দেশের বিভিন্ন সঙ্কটে; বন্যায়, শীতে, খরায়, মহামারীতে চাঁদা তুলে বাংলাদেশে টাকা পাঠান। সেসব অর্থসাহায্য খুব উল্লেখযোগ্য কি না, কত বড় অঙ্কের তার থেকেও বড় বিষয় হলো সেসব কেবল ব্যক্তিগত পরিচয়ের, আত্মীয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের হাসপাতাল, স্কুলসহ, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। অবশ্য এই তালিকায় ব্যাংক লুটেরার দলেরা যে অন্তর্ভুক্ত নন, সে আপনাদের আগেই বলে দিচ্ছি।

এতোকিছুর পরেও দেশ নিয়ে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করা যায় না কোথাও। কী ফেসবুকে, কী ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়! প্রবাসীরা দেশ ছেড়েই যেনো মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলেছেন। এমন আশ্লেষে ফেটে পড়েন সকলেই, কী বন্ধু, কী স্বজন।সরাসরি না পারলেও আকারে-ইঙ্গিতে সেই ক্ষোভ প্রকাশিত হয়ই। একটা বিষয় খুব সুস্পষ্ট হওয়া দরকার; যারা প্রবাসে আছেন তাঁরা কি বাংলাদেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার করেছেন? যদি সেটা না করে থাকেন, যদি তাঁদের বাংলাদেশের এনআইডিতে নাম-ঠিকানা -নম্বর নথিভুক্ত থাকে তবে আইনত তাঁরাও বাংলাদেশের নাগরিক। আর নাগরিক হিসেবে দেশ নিয়ে উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা, দুঃখ-কষ্ট, ভালোবাসা-বেদনায় ঠিক যতোখানি অংশ আপনার ততোখানি অংশ তাঁদেরও। তাঁরাও মতামত দিতে পারেন, পারেন আলোচনা-সমালোচনায় অংশ নিতে ঠিক আপনারই মতো।

আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, বিশ্বের দরবারে অনেক প্রবাসী বাঙালী এবং তাঁদের প্রজন্মরাই ‘বাংলাদেশের’ পতাকাকে সমুজ্জ্বল করেছেন নানা আঙ্গিকে, স্বমহিমায়, মেধায়, যোগ্যতায় এবং স্বচেষ্টায়। আর সেসব সুনামের সহভাগিতা নিতে আমাদের দেশীয় পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পরিচয়ে।আপনারা যদি তখন বাংলাদেশে এককালে জন্মেছিল যাঁদের পূর্বপুরুষ সেই গৌরবেই গৌরাবান্বিত হতে চান তবে, এখন কেনো প্রবাসীদেরকে ঘৃণা করেন?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপনার রাগ-অভিমান, ক্ষোভ কার-কাদের ওপর? সেইসব জোচ্চর, ব্যাংক লুটেরা, দেশের সম্পদ চুরি করে বিদেশে নিরাপত্তার জন্য পাড়ি দেওয়া প্রবাসীদের ওপর নাকি আমার মত হাজার হাজার খেটে খাওয়া প্রবাসী নর-নারীর ওপর? আপনি বিদেশে নিরাপদ জীবনযাপনের সুযোগ পাচ্ছেন না বলেই আপনার ক্ষোভ, নাকি আপনার দেশে নিরাপত্তা নেই বলে ক্ষোভ? আপনার অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় যাবার মতো দক্ষতা-যোগ্যতা নেই নাকি আপনি দেশকে ভালোবাসেন বলেই দেশ ছাড়তে চাইছেন না? এইসব প্রশ্নের জবাব আপনারই ভালো জানার কথা।

একটা কথা বলে শেষ করতে চাই, আপনারা দেশপ্রেমিক অতি, দেশটাকে নিয়ে ভাবেন বলেই দেশে আছেন। আমরা পালিয়ে এসেছি ভালো থাকার জন্য, সেই ভালোবাসার দেশটাকে ভালো রাখুন! এই করোনাকালে কে কী করলো কিংবা করলো না সেটা নিয়ে অন্যকে কটাক্ষ না করে আপনি ক’জন ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে আছেন সেই হিসেবটা আগে কষুন। অন্যের জানালায় উঁকি দিয়ে নিম্নরুচির বাঙালি না হয়ে নিজের মনের দরজা-জানালাগুলো ঝুলঝার পরিস্কার করে উন্মুক্ত করুন। খোলা বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নিন। আগে তো মনের ভাইরাসটিকে মারুন, তারপর না হয় দেহের ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি অর্জন করবেন!

বিশ্বব্যাপী এই যুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল লড়াকুর জন্য ভালোবাসা অনাবিল। নিজেকে, নিজের পরিবারকে সুস্থ রাখুন সর্বাগ্রে। সুস্থ দেহের মতো মনের সুস্থতাও অতি জরুরী। সারাহ গিলবার্টের প্রচেষ্টায় করোনা একদিন তাড়াবোই আমরা! কিন্তু তারপর…।

যারা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, তাঁরা তো গেলেনই। যারা বেঁচে গেলাম এ যাত্রায়, আমাদের যেতে হবে আরও অনেকটা পথ! আসুন, কূপমণ্ডূকতার বাইরে এসে বিশ্বমানব হয়ে উঠি। সকলে মিলে ভালো রাখি আমাদের ভালোবাসার এই পৃথিবীটাকে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.