সাংবাদিককে নির্যাতন, সাংবাদিকের নির্যাতন

বীথি সপ্তর্ষি:

কয়েকদিন আগে যুগান্তকারের এক সাংবাদিকের (পুরুষ) ওপর প্রতারণা ও নিপীড়নের অভিযোগ এনেছে সমকালের আরেক সাংবাদিক (নারী। মানে জাস্ট উড়িয়ে দেয়ার মতো অভিযোগ না। প্রতারণা করে লুকিয়ে বিয়ে, বিয়ের পরও অন্যত্র একাধিক সম্পর্ক মেনটেইন করা, যৌতুক চাওয়া, যৌতুক চেয়ে মারধোর করা, গ্রামের বাড়ি পালিয়ে যাওয়া, সেখানে গিয়ে আরেকটা বিয়ের পরিকল্পনা করা এবং ভ্রুণ হত্যার মতো অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ সব। দেশের বিদ্যমান আইনে যা রীতিমতো ফৌজদারি অপরাধ।

এই ঘটনা বিভিন্ন মহলে জানাজানি হলো। এবং যেহেতু দুই পক্ষই গণমাধ্যমকর্মী সেহেতু গণমাধ্যমে অবধারিতভাবেই এই তথ্য খবর আকারে প্রকাশ হলো, একাত্তর টিভি টকশোও করলো। তারপর সাংবাদিকদের গ্রুপসহ বিভিন্ন জায়গায় বলাবলি শুরু হলো, এরকম ব্যক্তিগত বিষয় কী করে টক-শো হয়? কারো দাম্পত্য কলহ সাংবাদিকদের পেশাগত দাবি, মর্যাদা ও অধিকারের বিষয় নয় যে গণমাধ্যমকর্মীদের গ্রুপে তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে! কেউ কেউ বললো, এই খবর প্রকাশ করে সাংবাদিকদের পেশাগত সুনাম ক্ষুন্ন করা হয়েছে (?)! পরবর্তীতে গ্রুপে ঘোষণা হলো যে ওই নির্দিষ্ট বিষয়ে আর কোন পোস্ট আসলে তা মুছে দেয়া হবে (বিরোধিতা করায় অ্যাডমিন সে ঘোষণা শিথিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যদিও)।

আলাপগুলো দেখে আমি মোটেই বিস্মিত হইনি। যে জাতির বিবেকেরা প্রকাশ্যে ক্রসফায়ার সমর্থন করে, ধর্ষণের খবর প্রকাশের সময় ধর্ষণের শিকার মেয়েটা কোন এলাকার কোন রোডে, কত নাম্বার বাসার কোন ফ্ল্যাটে থাকে, তার বাবা কোথায় চাকরি করে, তার নানীর বাড়ি কোথায় পর্যন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে তাদের কাছে ব্যক্তিগত (!) বিষয় আর ভায়োলেন্সের পার্থক্য পরিষ্কার থাকবে এটা ভাবাই যায় না। কোন অত্যাচার-নিপীড়ন, যৌতুক চাওয়া, ভ্রুণ হত্যার মতো বিষয় যদি ব্যক্তিগত হয় তাহলে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ব্যাপার কোনগুলো? এগুলো যদি ব্যক্তিগত ব্যাপারই হয় তবে এতোদিন যে সাংবাদিকরা নারী নিগ্রহ, গৃহকর্মী নির্যাতন, যৌতুকের জন্য গৃহবধূকে পুড়িয়ে মারাসহ যতো ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের নিউজ করেছে সবই অবান্তর। অপরাধী যদি ‘এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার’ বলে তাহলে সাংবাদিকদের অফিসে ফেরত আসা উচিত ছিল। তা না করে খবর তৈরি করার দায়ে রীতিমতো মানহানির মামলা খাবার কথা! কিন্তু আমি জানি এই নির্দিষ্ট ঘটনাটা সাংবাদিকরা যে ডিসকোর্স হিসেবে হাজির করছেন তা মূলত ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিকে সেফ গার্ড করার লক্ষ্যেই। চরিত্র উল্টে গেলেই এটাকে তারা রাষ্ট্রীয় ইস্যু করে তুলতেন।

অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যারা নির্যাতনের শিকার হন তারা প্রতিবাদ করেন না। যারা প্রতিবাদ করেন তারা মিথ্যা হয়রানির উদ্দেশ্যে তা করেন। সুতরাং, বিশ্বাস করা কঠিন। এই শঙ্কা সাধারণ মানুষ প্রকাশ করলে কথা ছিল না, তাদের তথ্য যাচাইয়ের অ্যাক্সেস নাই কিন্তু সাংবাদিকদের তা আছে। দুনিয়ার সব ঘটনা তদন্ত করে এসে এখানে এই ধরণের শঙ্কা অবান্তর। কেউ আবার বলেছেন, আমরা যেন বিচার না বসাই। এই বিবৃতি থেকে কি ধরে নিব যে যত অপরাধের খবর প্রকাশ বা আলোচনা করা হয় সব কি তাহলে বিচার বসানো হয়েছে এতদিন?

লাস্ট বাট নট লীস্ট, ‘এই খবর প্রকাশ করে সাংবাদিকদের পেশাগত সুনাম ক্ষুন্ন করেছে’! দাঁড়ান, একটু হাসি আগে হি হি! পেশাগত সুনাম? কে করে এই পেশাগত সুনাম? আমার মতো অনেককে প্রায়ই মাঠেঘাটে বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সেসব ভাঙলে মোটেই মনে হয় না যে তারা আমাদের খুব সম্মান করে! বরং বোন খুন হবার পরের দিন ভাই সংবাদ সম্মেলন ডাকলেও সাংবাদিকরা টাকা চান। আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, নেতা-কর্মীদের সাথে খাতির করে, চাঁদাবাজি করে পেশার যে বারোটা বাজিয়েছেন তাতে এখনো পেশার সুনাম আছে বলে মনে করেন আপনারা? তাও আলোচনার স্বার্থে ধরে নিলাম যে সাংবাদিকরা নির্যাতন করে এমন খবর চাউর হলে পেশার সুনাম নষ্ট হয়, তো যে মেয়েটা নির্যাতনের শিকার হল সেও তো সাংবাদিক। সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হলে আপনাদের সুনাম নষ্ট হয় না? তাকে আপনার ওন করেন না কেন? সে কি সাংবাদিক না? নাকি নারীরা দুর্বল সাংবাদিক? নাকি অন্য কোন কারণ আছে?

মানুষ শুধুমাত্র পেশার কারণে অন্যায় করে না যতক্ষণ না তার সাথে ক্ষমতা, অর্থ, প্রভাব ও সমর্থন না যোগ হয়। পেশাকে পেশা হিসেবে দেখেন, একে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে দরকার নাই। একাত্তর টিভির টক-শো বায়াসড মনে হলে সেটা বলেন, সমালোচনা করেন। কিন্তু ‘ব্যক্তিগত বিষয় কেন টক-শোতে আনা হল’ ধরণের বালখিল্য আপাপ দিয়েন না!

সর্বোপরি অভিযোগ করলেই তা সত্য যেমন হয় না তেমন একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না। অভিযোগের তদন্ত হোক, অপরাধীর বিচার হোক। আর দোয়া করি, আপনাদের পেশাগত দায়বদ্ধতা তৈরি হোক (টু হোম ইট মে কনসার্ন)।

শেয়ার করুন: