“পাখি, আমার একলা পাখি”

মহুয়া ভট্টাচার্য:

আমার মা কোন ভণিতা জানতেন না। তাই পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনেরা বলতেন- ‘বোকা’। আমার মা যদিও শহরে বড় হওয়া মেয়ে, কিন্তু আমার সুদর্শন বাবার পাশে একেবারে বেমানান ছিলেন। পাড়ার কাকিমা – জেঠিমারা দুঃখ করতেন – আমার বাবার ভাগ্যে  কী করে এমন বউ জুটলো!

আমার মায়ের কোনো ছেলে সন্তান ছিলোনা। তাই আমার ঠাম্মা রাতদিন আমার বাবা মায়ের বিয়ের ঘটককে অভিসম্পাত দিতেন – এমন বউ গছানোর দোষে।

আমার মা খুব সুন্দর গান গাইতেন। আচার বানাতেন। কাপড় কেটে উড়ন্ত বকের এপ্লিক করতেন টেবিলক্লথের কোণায়। আমার মা ‘সোভিয়েত নারী’ পড়তেন। আমার দাদু এসব দেখে বলতেন – “পঁচা আদার ঝাঁঝ বেশি!”

আমার মা গৃহকর্মে বরাবরই ধীর ছিলেন। চটপট করে কোন কাজ সেরে ফেলবেন – এমনটা পটু ছিলেন না কখনো। ফলে সারাদিনই ঘরের কাজ করতে হতো তাকে। তাতেই হয়তো নিজেকে পরিপাটি, সুন্দর রাখার সময় পেতেন না তেমন করে। বাবা তাঁর বন্ধুদের করিৎকর্মা বউদের দেখিয়ে বলতেন – “তোমাকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল ছিলো।”

বর্ষার দিনে গায়ের রাস্তার কাদা মাড়িয়ে আমরা যখন মামাবাড়ি বেড়াতে আসতাম শহরে, কাদা মাড়িয়ে আমি আর বাবা কেমন তড়তড় করে মাকে ডিঙিয়ে চলে যেতাম শহরের বাস ধরতে। পেছন ফিরে দেখতাম পা পিছলে পরে গিয়ে মায়ের শাড়ি কাদায় মাখামাখি! বাবা খুব বিরক্ত হয়ে বলতেন – “তোমাকে বিয়ে কারাটাই আমার ভুল ছিলো।”

বছরে একটা কী দুটো শাড়ি পেতেন পূজোয়। আর ছিলো একটি মাত্র কালো ব্লাউজ, যা সব অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার জন্য তুলে রাখা। মা বলতেন – ” কালো রং সব শাড়ির সাথে মানায়!” আমি বলতাম – “তুমি এতো বোকা কেন মা?” মা হেসে দেয়ালে ঝোলানো একটা ক্যালেন্ডার দেখাতেন। বলতেন – ” তোমার বাবা এই কোম্পানিটার মস্ত বড় অফিসার।” তারপর দামি শাড়ির সাথে পরার মতো তাঁর একমাত্র কালো ব্লাউজটার ছিঁড়ে যাওয়া বর্ডারটা সেলাই করতে বসে যেতেন।

মা খেতে বসতেন সবার শেষে। ঘুম থেকে উঠতেন সবার আগে। বাবা তবুও বলতেন, “তোমাকে দিয়ে কোন একটি কাজ হয় না ঠিকমতো।” বাবার বিছানায় আমাদের কারও শোয়া তো দূর, বসারও পারমিশন ছিলো না। আমি আর মা ঘুমাতাম আলাদা কামরায়। অথচ কতদিন, কতদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আমি আমার বিছানায় পাশে মাকে না পেয়ে ভয়ে মা! মা! চিৎকার করে উঠেছি! তখন বাবার কামরা থেকে জড়ানো কণ্ঠে বাবা আমাকে আশ্বস্ত করতেন – “ঘুমাও! মা আসবে।”

মা যখন মারা গেলেন, একদিন হঠাৎ আলমারির ছাদ পরিস্কার করতে গিয়ে বাবা দেখলেন – ঠাকুরমার খালি জর্দার কৌটোয় ভরে মা টাকা জমিয়েছেন – দু’টাকা! পাঁচ টাকা! দশ টাকা! একশো! হাজার!

বাবা আজকাল মাংস তেমন পাতেই নেন না। জোর করে দিতে গেলে বিরক্ত হয়ে বলেন- “তোমার মায়ের রান্নার হাত কেউ পাওনি তোমরা! “আমি যেদিন আমার স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে এলাম, বাবা বলেছিলেন – ” ভাবতেই পারি না, তুমি এমন মায়ের মেয়ে! “

শেয়ার করুন: