সাবিহা সুলতানা:
গতকাল রাত বারোটায় হঠাৎ করেই রুপকথা আমাকে ‘হ্যাপি মাদার্স ডে’ বলে জড়িয়ে ধরে তার নিজের হাতে বানানো কার্ডটি দিলো। গতকাল সারাদিন সে আমাকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এটি বানিয়েছে। ওর এই উইশ করা দেখেই প্রথম আমার মনে পড়ল আজ মা দিবস। সেই সাথে এটাও মনে পড়লো যে কন্যা হিসেবে নিজের ভূমিকার চেয়ে এখন আমার মা হিসেবে ভূমিকাটাই অনেক বেশি স্পষ্ট।
পৃথিবীর সকল নারীই বোধ হয় এমনিভাবে একদিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করে কন্যা, স্ত্রী, পুত্র বধু, ভাবী এসব নানা মুখী ভুমিকা তার জীবন যতটা না পাল্টে দেয় তার থেকে মার্তৃত্বের ভুমিকাটাই তাদের পাল্টে দেয় বহুগুণ।
তাই, আজ এই মা দিবসে একজন মা হিসেবে আমাদের জেনারেশন এর মায়েদের জন্য কিছু কথা বলতে এসেছি।
না, মাতৃত্বকে খুব বেশি গ্লোরিয়াস করতে আমি চাই না। যুগ যুগ ধরে গল্প উপন্যাসে মাতৃত্বকে যত বেশি মহান, শ্রেষ্ঠ হিসেবে দেখানো হয়েছে, আমি তেমনটা বলতে চাই না। কারণ মাতৃত্ব আপনার সিদ্ধান্ত। যদিও প্রকৃতি তার বংশগতি রক্ষা এবং নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সকল প্রাণী কূলের মধ্যে নারী জাতিকে বেছে নিয়েছে। এটাকে তাই আশির্বাদ হিসেবেই নেয়াটাই বোধ হয় শ্রেয়। নইলে এত কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করে যাকে এই পৃথিবীকে আনতে হয় তার প্রতি এতো স্নেহ, এতো মায়া আর ভালোবাসাই বা জন্মাবে কেনো?
প্রকৃতি আপনাকে ক্ষমতা দিয়েছে সন্তান ধারণ করার, কিন্তু একজন শিক্ষিত নারী হিসেবে আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কখন এই পৃথিবীতে একটি প্রাণকে আপনি নিয়ে আসবেন। এখানে ভূমিকা সম্পূর্ণ আপনার এবং আপনার জীবনসঙ্গীর। আপনার সন্তানের এখানে কোন ভূমিকা নেই। তাই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তাকে এই পৃথিবীতে বাসের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনার। না, বাবাকে আমি এই দায়িত্ব থেকে বাদ দিচ্ছি না, কিন্তু সন্তান যখন একজন মায়ের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এই ধরণীতে পদার্পণ করে তাই মায়ের ভূমিকা কিছুটা হলেও যে বেশি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই মা -ই সন্তানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
জন্মের পর থেকে এই ছোট্ট মানুষটির যত্নে আমাদের কোনো ত্রুটি থাকে না, কিন্তু আমরা মায়েরা আমাদের সন্তানকে শারীরিকভাবে যোগ্য করে তুলতে যত চেষ্টা করি, সন্তান একটু বড় হলে তাকে মানসিকভাবে দৃঢ় করে তুলতে কি ততোটাই চেষ্টা করি?
আপনি হয়তো বলবেন বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সন্তানকে আঁচলে আগলে রেখে মানুষ করার কোনো বিকল্প নেই। কথাটা মিথ্যে নয়, কিন্তু যে আঁচলে আগলে রাখছেন সে আঁচলে যথেষ্ট তাজা হাওয়া প্রবেশ করছে কিনা সেটা কি খেয়াল করেছেন?
দু:খের ব্যাপার হলো সন্তানের প্রতি অন্ধ আবেগ আর ভালোবাসায় আমরা সন্তান সম্পর্কিত যে কোনো দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়াকেই মাতৃত্বের অবমাননা মনে করি।
তাছাড়া মন যদি শক্ত করে সন্তানকে মানসিকভাবে শক্ত করে গড়ে তুলতে চান আমাদের সমাজের অতি আবেগী কিছু মন্তব্য (এ কেমন পাষাণ মা! কোনো মাকে এমন দেখিনি, এ মা হওয়ার যোগ্যই নয় ইত্যাদি ইত্যাদি) আপনার উদ্যোগ রোধ করে দিতে চাইবে। কিন্তু আপনি যদি এই ভয়ে সন্তানকে ব্রয়লার মুরগি বানিয়ে রাখেন, এর ফল কিন্তু আপনার সন্তানই ভোগ করবে, সমাজ নয়, বরং সেই একই সমাজই পদে পদে তার পথ চলা বন্ধুর করে তুলবে।
তাই সন্তানের এই পথ চলাকে যদি বাধাগ্রস্ত করতে না চান তবে সন্তানকে স্বাবলম্বী হতে শেখান। আমাদের যুগ আর আমাদের সন্তানের বেড়ে উঠার সময়ের মধ্যে কিন্তু আকাশ পাতাল তফাৎ। আমাদেরকে আমাদের বাবা মা যেভাবে মানুষ করেছেন তার সাথে তাদের মেলাতে যাবেন না। ঠিক একই ভাবে আমরা আমাদের মাকে যেমন দেখেছি তারাও কিন্তু আমাদের তেমনভাবে আবিস্কার করছে না। তাই সন্তানের কাছে নিজের ইমেজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তাদের সামনে তাই নিজেকে সেইভাবেই উপস্থাপন করুন। সন্তানের মনের নাগাল পেতে চাইলে তার থেকে সব দিক দিয়েই আপনাকে এগিয়ে থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
অনেক মা’ই তার সন্তানের প্রযুক্তি জ্ঞানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সেই সাথে প্রযুক্তিগত জ্ঞানে নিজের অজ্ঞতার সাথে সন্তানের এই বিষয়ের পারদর্শিতার এক তুলনামূলক চিত্র তুলে চরম আত্মপ্রসাদ ও গর্ব অনুভব করেন। সন্তান জিতলে জিতে যায় মা টাইপ এর ব্যাপার আর কি। সন্তানের এহেন জয় গর্বের ব্যাপার কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু সেই সাথে দেখুন সেই জয় অন্যভাবে সন্তানকে স্পয়েল করছে না তো। ডিজিটাল যুগে স্মার্ট টিন এজার সন্তান এর কাছে ঘোল না খেতে চাইলে নিজেও স্মার্ট হোন। আপনার জ্ঞানের অভাবে সে যেনো আপনাকে বোকা বানাতে না পারে খেয়াল রাখুন।
সন্তানকে নিজের কাজ নিজে করাতে শেখান। পরনির্ভর করে গড়ে তুলে তাকে ভবিষ্যতে স্বাবলম্বি হতে বাধা দিবেন না। একটু বড় হতেই তার নিজের হাতে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।সে যেনো নিজেই মাছের কাঁটা বেছে খেতে শেখে । নইলে বড় হয়ে সে কাটা বাছার ভয়ে মাছই খেতে চাইবে না। এছাড়া নিজের ঘর, ব্যবহার্য জিনিসপত্র তাকে নিজেকেই গোছাতে শেখান। দরকার হলে নিজের কাজ নিজে করার জন্য তাকে পুরস্কৃত করুন।
সন্তানের সামনে ‘সন্তানই আপনার জীবন মরণ ধ্যান জ্ঞান, তাকে সুখী করা ছাড়া আপনার জীবনের আর কোনো লক্ষ্য নাই’ এমন ধারণা দিবেন না। সন্তানের সামনে কোনো কুসংস্কারকে কখনো প্রাধান্য দিবেন না। এছাড়া সকল ভালো জিনিস শুধু তারই জন্যে, বাবা মা’র কোনো কিছু না হলেও চলে বরং তাদের একমাত্র কাজ হলো তার জন্য উৎকৃষ্ট জিনিস সরবরাহ করে যাওয়া’ নিজেদের এমন ইমেজ তৈরি করবেন না।
মনে রাখবেন, আপনি লালন পালন করছেন একবিংশ শতাব্দীর যান্ত্রিক সভ্যতার প্রজন্মকে। তারা আপনার সত্তর দশকের ‘শাবানা’ টাইপ ইমেজের যথার্থ মূল্যায়ন নাও করতে পারে। বরং উল্টো আপনি তাদের কাছে,’ দুর্বল, কম মেধাসম্পন্ন বোকা মা হিসেবে গণ্য হতে পারেন। ফলে আপনিও যে স্বতন্ত্র একজন মানুষ, আপনারও যে ভালো লাগা, মন্দ লাগা আছে, আছে ব্যক্তি স্বাধীনতা, তা আপনার সন্তান নাও বুঝতে পারে।
নারীকে সম্মান করতে শেখান। মনে রাখবেন আপনার সন্তানের জীবনে আপনিই প্রথম নারী। আপনাকে দেখেই সে নারীজাতিকে চিনবে ও জানবে। তাই নারী মানেই দুর্বল, ছিচকাঁদুনে, তার সাথে যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করা যাবে এমন কোন ইমেজ তার সামনে তুলে ধরবেন না। আপনার ভূমিকাই সংসারে তাকে তার স্ত্রীর প্রতি যথার্থ সম্মান দেখাতে সাহায্য করবে। একইসাথে সন্তানের বাবার সাথে আপনার ব্যবহারও কিন্তু একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রতি আপনার শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার তাকে তার জীবন সংগীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলবে। সেইসাথে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন তার সামনে কোনো অন্যায় আচরন আপনি মেনে নিচ্ছেন কিনা। যদি নেন তাহলে সেও ভবিষ্যতে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলবে।
আপনি সারাদিন জি বাংলা সিরিয়াল দেখে সংসারের বিভিন্ন সম্পর্কগুলোকে এক কাতারে ফেলে দিয়েছেন। আপনার কাছে পরের মেয়ে, পরের মা মানেই নেগেটিভ কিছু। সন্তানের সামনেই আপনি অন্যর সমালোচনায় মুখর হয়ে থাকেন। ফলাফল সেও শুধু নেগেটিভিটিই শিখবে। পরিবারের অনেক আত্মীয়কেই সে অপছন্দ করা শুরু করে দিবে। যার ফলাফল হয়তো একদিন আপনাকেই ভোগ করতে হবে। তাছাড়া আপনি যখন শাশুড়ি হবেন তখন আপনার সিরিয়াল না দেখা পুত্রবধুটির সাথে সম্পর্ক যে খুব সুখকর হবে না তা আর বলে দিতে হয় না। আর যদি সে সিরিয়াল দেখে থাকে তাহলে যে সেটা কুরুক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কাজেই সিরিয়াল দেখুন কিন্তু তা জীবনে প্রয়োগ করবেন না।
টিনএজ সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠুন। মাকে যেনো তারা সব সময় বন্ধু মনে করে সব কথা বলতে পারে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলুন। সন্তানের যে দিকে আগ্রহ আছে তা খুজে উৎসাহ দিন।
একাধিক সন্তান থাকলে কখনোই কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না।অন্যায় যে করবে সে বড় বা ছোট যেই হোক না কেনো, তাকে শাস্তি দিন। সন্তানের সামনে সর্বদা ন্যায় বিচার করুন। তবেই তারা নৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন হবে এবং আপনার প্রতি আস্থাশীল হবে।
সবচেয়ে বড় কথা সন্তানকে ভালোবাসুন, কিন্তু তার প্রতি কোনো প্রত্যাশার চাপ রাখবেন না। ‘তোমার জন্য ছোট বেলায় এই করেছি সেই করেছি ‘ বার বার মুখে বলবেন না। তাকে সেটা নিজেকেই উপলব্ধি করতে দিন। তাকে ছেড়ে দিন, অতিরিক্ত স্নেহের চাপে তাকে দমবন্ধ করা কোনো অনুভুতি এনে দিবেন না। আপনার সুশিক্ষা ও ভালোবাসার যদি প্রভাব থাকে তার জীবনে তাহলে সে যত দূরই যাক না কেনো এক অদৃশ্য সুতার টানে বাধা থাকবেই আপনার সংগে ঠিক যেমন ছিলো নয় মাস নয় দিন। আর এই অদৃশ্য সুতাটিই হলো শ্রদ্ধা, নির্ভরতা ও ভালোবাসা যার গোড়াপত্তন আপনি তার প্রতি আপনার আচরণ দিয়ে করেছেন। এই আচরণই হচ্ছে একজন সন্তানের তার মায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা।
সন্তানের জন্য ক্ষতিকর সকল দুর্বলতা কাটিয়ে পৃথিবীর সব মায়েরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠুন এই কামনা করি।
মা দিবসের শুভেচ্ছা সবার জন্যই।