ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
মা,
জীবনে তোমাকে কোনোদিন চিঠি লিখিনি, তুমিও আমাকে লেখোনি। অথচ অন্য সব সন্তানদের তুমি কোনো না কোনো পরিস্থিতিতে একাধিক চিঠি লিখেছো!
তোমাকে চিঠি লেখার জন্য ভোরের আলো ফোটার এই সময়টাই বেছে নিলাম। একটা মজার পাখি আসে এই সময়টাতে আজকাল জানো তো! আমার কানে স্পষ্ট বাজে – ‘হুসেইনা! হুসেইনা’! অচেনা পাখিটার ‘হুসেইনা’ ডাক শুনে শুনে রাত ভোর হয়। মা, সংসারে এখন আমার সারাটা দিনরাত্রি একটু অবসর মেলা ভার।
তোমাকে বলা হয়নি, করোনা নামের ভয়ংকর ভাইরাসের সাথে পৃথিবী এক অনিবার্য বিশ্বযুদ্ধে শামিল। বিশ্বজুড়ে একটাই আহবান – ‘ঘরে থাকুন।’ বাড়ছে লাশের মিছিল।

বিদেশ বিভূঁই পার হয়ে শত্রু এখন আমাদের দোরগোড়ায়। ঘরে আছি মা, আব্বুকে নিয়ে। পৃথিবীর সব মানুষ শুধু নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, আর কোনো উপায় নেই তাদের।
অন্যদিকে প্রকৃতি মেতে উঠেছে এক আশ্চর্য খেলায়! আমাদের এখানে কিছুদিন আগে চৈত্রের আকাশ ছিলো স্বচ্ছ নীল সরোবর। কালবৈশাখী ঝড়ে কী দোর্দণ্ড প্রতাপ! তোমার মনের মতো ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে/ গগনে গগনে ডাকে দেয়া।’
পাখিদের কলতান শোনা যায় দিনভর। রাস্তার বড় বড় গাছগুলোর পাতা ঝকমকে সবুজ, তোমার সাহচর্য পাওয়া গাছেদের মতো। মাগো, তুমি জানোনা করোনার এই ক্রান্তিকাল আমার জন্য কি নিদারুণ বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়েছে। কেবল ঘরে থাকতে হলে কোনো কথা ছিলোনা। তুমি তো কখনো হতাশায় বাঁচতে শেখাওনি! মনের শেষ শক্তিটুকু সম্বল করে তুমুল বাঁচার প্রেরণা দিয়ে গেছো। আব্বুকে- তোমার পরম যত্নে আগলে রাখা ভালুককে এবার বোধহয় ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি।
হোম কোয়ারেন্টাইনের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে দু’বার হাসপাতাল যেতে হয়েছে তাকে নিয়ে। মা, আব্বু সারাক্ষণ তোমার কথা বলে, তার বড় কন্যা রাজেশ্বরীর কথা বলে। নাতনিদ্বয় তাকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখে। মা, তুমি কী দেখতে পাচ্ছো সে ভালো নেই? আমার জন্য লড়াইটা কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে উঠছে প্রতিদিন। তবু আমি হাল ছাড়িনি। কারণ সংসারের শত অসংগতির ভিড়েও তুমি হারিয়ে যাওনি মা। তোমার জন্য জমানো কান্না, এলোমেলো কথামালা ঝরে যায় স্নানের জলের সাথে রোজ। তোমার কাছে আমার দিনলিপি পৌঁছায় কিনা জানিনা। যদি তাই হয়, আমার উদয়াস্ত পরিশ্রম দেখে আর কেউ না হোক তুমি নিশ্চয়ই ব্যথিত চোখে চেয়ে থাকো। সে দৃষ্টি আমার অন্তর ভেদ করে মা। মাতৃহারা সন্তানের জীবনে মায়ের মতো বলে কিছু থাকেনা, মায়ের তুলনা মা স্বয়ং।
মা, আজ নাকি বিশ্ব মা দিবস! তোমাকে ভালোবাসার জন্য একটি দিবস কিছুই না মাগো! তোমাকে ভালোবাসার জন্য মৃত্যুহীন এক অনন্ত জীবন চাই আমার।
মা হারা পৃথিবীটা করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর চেয়ে গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন। বিশ্ব একদিন এই মহামারী থেকে মুক্ত হবে। সবকিছু আগের মতো হলেও তুমি তো ফিরে আসবেনা মা!
যদি আসতে! একটিবারের জন্যে যদি আসতে! তোমার হাত ধরে হেঁটে যেতাম নতুন সূর্যোদয়ে। জাপানের রাস্তায় নেমে আসা হরিণের পাল, ভেনিসের হ্রদের টলটলে জল, প্যারিসে পাখিদের ঐকতান, অনন্ত বৃক্ষরাজির সবুজ ছায়াতল – এমন ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ বসুন্ধরাই তো চেয়েছিলে তুমি! নিদেনপক্ষে কক্সবাজারের সমুদ্রে গোলাপি ডলফিনের আনন্দ উদযাপন দেখতাম তোমাকে নিয়ে, সৈকতের বালুতে দেখতাম আশ্চর্য সাগরলতা অথবা সুন্দরবনের হিরণ্ময় সকাল! তাও যদি না হতো অন্তত বর্ষার মেঘে ‘হংসবলাকার পাখায়’ উড়ে যেতো আমাদের মন!
যদি ফিরে আসতে মাগো! সে এক অন্য জীবন হতো আমাদের…
ইতি,
তোমার অধম সন্তান
ফুলেশ্বরী।