রিংকা মুখার্জী:
ফ্রক বা স্কার্ট ব্লাউজ পরে যেতাম তোমাদের বাড়ি। তখন তুমি আমার কাকিমা। টকটকে ফর্সা রঙ ,বড় একটা গোল টিপ আর সবসময় ঝলমলে হাসিখুশি কাকিমা আমার খুব পছন্দের মানুষ হয়ে গেছিল। দেখতাম কোনো সমস্যা কোনো দুঃখ কোনো ভয় স্পর্শ করতো না তোমাকে। বরং তোমার কাছেই সব সমস্যার সমাধান। হৈ চৈ আনন্দ মজা উৎসব পার্বন পেরিয়ে দশ বারো বছর পরে পাকে চক্রে কীভাবে যেন তোমার বাড়ির বৌমা হয়ে গেলাম।
অতি পরিচিত কাকিমা থেকে তোমার নতুন পরিচয় হলো শাশুড়ি মা। খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবেই ‘মা’ বলে ডেকে ফেললাম। আর ঠিক তখন থেকেই তুমি সত্যিই আমার মা হয়ে গেলে।শাশুড়ি বৌমার সাধারণ নিয়মকানুনের কোনো ধার ধারলে না।কোনো কিছু জোর করে চাপালে না।এমন কোনোও একটা কাজ করতে হয়নি, এমন কোনোও একটা নিয়ম পালন করতে হয়নি ,এমন কোনোও একটা কথা শুনতে হয়নি যা আমার অপছন্দ।একটা দিনও তোমার অপ্রসন্ন মুখ দেখতে হয়নি।
প্রথম চাকরি করতে গেছি তোমার সুস্বাদু রান্নায় সাজানো একথালা খাবার খেয়ে। গোছানো টিফিন বক্স আর ঠাণ্ডা জলের বোতল রেডি। শুধু ব্যাগে ভরে নিতে হবে। বাড়ি ফিরে খিদে পেয়েছে বোঝবার আগেই গরম গরম খাবার চলে এল। কবে ধোপার কাছে শাড়ি দিতে হবে, কোন্ ব্লাউজটা একটু সেলাই করতে হবে, ভাঙা ছাতাটা কবে সারিয়ে আনতে হবে, কবে বিছানার চাদর কাচতে হবে কোনোওদিন ভাবতে হয়নি। কোনদিনও না। ঠিক সময় সব কাজ ঠিক ঠিক করে দিয়েছ। মুখে সেই ঝকঝকে হাসি।
অবাক করা ব্যাপার, ছেলে-অন্ত প্রাণ মা, কিন্তু ছেলে-বৌ এর ঝগড়ায় সবসময় বৌমার সাপোর্টে। মিটমাটের পলিটিক্স নয়। আন্তরিকভাবে, যুক্তি দিয়ে আমার পাশে। ছেলে বরাবর হেরে ভূত। তখন থেকেই জানি, বুঝি, উপলব্ধি করি আমি তোমার বৌমা না, মেয়ের মতোও না। মেয়ে। আর তুমি আমার মায়ের মতো না। মা।
তারপর এই মা মেয়েতে কম দিন কাটালাম না। দুজনে চুটিয়ে সংসার করলাম আবার টুক করে সংসার কেটে নাটক দেখে এলাম,গানের অনুষ্ঠান শুনে এলাম, আবার হাতিবাগান বা গড়িয়াহাটে দরদাম করে কাপ ডিস পাপোষ তোয়ালে কিনে এগরোল খেয়ে চলে এলাম। এর মধ্যে কিন্তু আর কেউ নেই।থাকলে ভালো না থাকলেও কুছ পরোয়া নেহি। দুজনেই যথেষ্ট।
তারপর তোমার নাতি হল। চাকুরিরতা মাকে একটুও টেনশন না দিয়ে নিজের দায়িত্বে নাতিকে বড় করলে। এইসব করতে করতে কত দিন মাস বছর যুগ কেটে গেল। তোমার আমার সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে গেল।
বেশ তো চলছিল মা, হঠাৎ করে ঝড় বয়ে এল কেন? ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিলে আমাদের। তারপর আবার তোমার সেই অসীম সাহস মনের জোর আর একমুখ হাসি দেখে আমাদের সব দুশ্চিন্তা কখন যেন দূরে চলে গেল। তুমি যেন শিখিয়ে দিলে ‘হাস্যমুখে করব মোরা অদৃষ্টেরে পরিহাস’। তাই আজ আবার আমরা সুখী পরিবার।
তুমি আছো তাই সব আছে মা। তুমি ঠিক এরকমভাবেই থেকো। আমার মাথায় হাত রেখে, আমার পাশে বন্ধু হয়ে। এত্ত কিছু পেলাম তোমার থেকে হিসেব করতে পারি না। দিতে কি কিছু পেরেছি মা? দেয়া নেয়ার হিসেব মাথায় আসে না। শুধু জানি, খুব ভালোবাসি তোমায়।
আমার সঙ্গে থেকো।