অনামিকা আহমেদ:
পারুল আন্টির সঙ্গে আমার বয়সের যে পার্থক্য তাতে করে কোনোভাবেই আমার বয়সী একটা সন্তান ওর থাকবার কথা নয়। তবু আমি ওর মেয়ে। এমন করে সে ‘মেয়ে’ বলে ডাকে, প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ওর মতো আদর করে খুব বেশি মানুষ ডাকতে পারে না। সন্তান স্থানীয়দের জন্য আমাদের পারুল আন্টি সবসময়ই দুর্গতিনাশিনী, অসুর বিনাশী। অথচ যে সন্তানটি ওর কোল আলো করে আসতে পারতো, তাকে আন্টি রক্ষা করতে পারেনি।
দেশজুড়ে যখন লকডাউন চলছে, গণপরিবহন পুরোপুরি বন্ধ, তখন অসুরবিনাশীর মতো আমার পারুল আন্টি ছুটে গিয়েছিল ৪০০ কিলোমিটারের বেশি পথ উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের চিলমারী। অনাগত সন্তানের পিতাটি যেন কোনো ভুল না করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করার জন্য। সত্যি রেজাউল করিম ওরফে প্লাবন নামে লোকটির জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। পারুল আন্টির মতো এমন মানুষ রেখে তিনি আবার আবার বিয়ের পিঁড়ি সাজিয়ে বসেছিলেন। ওই বাড়িতে আন্টিকে যে অপমান সইয়ে আসতে হয়েছে, তার বর্ণনা আন্টি দেয়নি। তবে আমরা অনুমান করতে পারি। শ্বশুরের পরিবারের সবাই মিলে ওর সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছেন। স্বভাবে কোমল এই মানুষটিকে মরমে মেরে ফেলার জন্য এটাই তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তাকে সেখানে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছে। বিয়ের মাত্র মাসখানেক যেতে না যেতেই নতুন বউকে কেউ এমন বিড়ম্বনায় ফেলতে পারে, এটা আমি ভাবতেই পারছি না।
পারুল আন্টির স্বামীটিকে দেখলাম টেলিভিশনের পর্দায়। কতোটা নির্লজ্জ হলে একজন মানুষ বলতে পারেন, বিয়ে গোপন রাখার শর্ত পালন না করায় তিনি স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। তাও আবার কখন, যখন তার স্ত্রী শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তারই মাকে দেখতে যাচ্ছেন। পথে আন্টি ওই তালাকনামা পান হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে।
শুনেছি, আন্টিকে পাঠানোর আগে তালাকনামাটি প্লাবন পাঠিয়েছেন তার সাংবাদিক বন্ধুদের। যে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে প্লাবন বাড়ি গিয়েছিলেন, তার সেই মরণাপন্ন মা’টি আমার আন্টিকে মারধর করতে তেড়ে এসেছিলেন। আন্টির ভাসুর-দেবর মিলে বলতে থাকেন, প্লাবন বলে গেছে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট বাড়ি কিনে দিতে হবে অথবা নগদ ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দিতে হবে। আন্টিদের ঢাকা শহরের একপ্রান্তে একটা ছোটখাটো বাড়ি আছে। বাড়িটা তো ওর একার নয়। ওর মা-বাবার এবং তাদের আরও সন্তান আছে। একার হলেও কী প্লাবনকে দিয়ে দিতে হবে? যে মানুষটি স্ত্রীর সবকিছু নিজের মনে করতে পারে না, যৌতুকের জন্য যে সদ্য বিয়ে করা বউকে নির্যাতন করতে পারে, তালাক দেয়, তাকে তো কিছু দেওয়ার থাকে না। বিয়ে এবং তালাকের নিয়ম আমার ভালো জানা ছিল না। এই ঘটনা শোনার পর নিয়মগুলো জেনে নিয়েছি। ধর্ম ও রাষ্ট্র তালাকের নিয়ম রেখেছে। কিন্তু পারুল আন্টির কাছে পাঠানো তালাকনামাটি পাঠানোর ক্ষেত্রে সেইসব নিয়মের বালাই মানেননি তার স্বামী। তাতে তিনি লজ্জাও পাননি। অন্তত টেলিভশনে যখন কথা বলছিলেন তখন তা মনে হয়নি। লজ্জা পাবেন কেমন করে। বউয়ের কাছে যৌতুক হিসেবে যিনি ফ্ল্যাট চাইতে পারেন, বউকে পিটিয়ে নিজের অনাগত সন্তানটিকে ভ্রুণ অবস্থায় হত্যা করতে পারেন। সে তো আসলে নির্লজ্জ ঠাকুর।

পারুল আন্টি নিজেও কম দায়ী নয়। সে কেন প্লাবনকে বিয়ে করতে গেল! এতো সারল্য দিয়ে জীবন চলে? আন্টির স্বভাবই প্রাণ উজাড় করে অন্যের জন্য করা। আন্টির সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় একবছর হবে। কিন্তু এর অনেক আগে থেকেই তিনি আমাদের পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এবং আমি তার কথা জানি। আমার বড় মামা-মামি যখন এক্সিডেন্টে পায়ে আঘাত পেয়ে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হলো, তখন তাদেরকে খুব ভালো করে না চিনেই কয়েক রাত তাদের জন্যই হাসপাতালে কাটিয়ে দিয়েছিল পারুল আন্টি। আমার মামাতো ভাই প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কাছে আন্টির গল্প শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার খালাতো বোন পূর্ণির বিয়ের শাড়িটাও পারুল আন্টিকে সঙ্গে নিয়ে কেনা। পূর্ণি আপু বলেছে, এই দোকান ওই দোকান ঘুরে অনেক দামের শাড়িটা কত সস্তা আন্টি কিনে দিয়েছিল ওকে।
আমার মেজো মামির আক্ষেপ, তার কোনো ননদ নেই। তাই আন্টি হয়ে গেলেন তার পারুল ননদিনী। আমার বোন অপার। ও যখন আরো ছোট. তখন ওর বিছানায় আমাদের জায়গা হতো না। কারণ ওর সঙ্গে থাকত ওর প্রজাপতি। প্রজাপতি ওর টেডিবিয়ার। এটা পারুল আন্টির দেওয়া। মামির কাছে শুনেছি, চকবাজারের অলিগলি ঘুরে আন্টি এই টেডিবিয়ারটি কিনে এনেছে অপারের জন্য। আন্টির গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু ওর জন্মকর্ম সবই ঢাকায়। তবু ওই জন্মভিটের প্রতি কী টান তার! ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষাটা ভালো বলতে পারে না। বলতে চেষ্টা করে এবং সেটা শুনতে যে আমার কী ভালোই না লাগে! একবার আমাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল নবীনগর উপজেলায় অবস্থিত আন্টিদের গ্রামে। ঢাকায় বেড়ে ওঠার কারণেই আঞ্চলিক ভাষাটা যেমন ওর ভালো করে রপ্ত করা নেই, তেমনি নিজের অঞ্চলটা চেনাও নেই। তবে ঢাকা শহরটা সে চিনে আদ্যোপান্ত। এই শহরের শিশু একাডেমিতে সে নাচ-গান শিখেছে। ঘুরে বেড়িয়েছে বহুবছর পথে পথে। ইডেনে পড়েছে। ফলে অপারের টেডি বিয়ার কোথায় ভালো এবং সস্তায় কিনতে পাওয়া যাবে, এটা ওরই ভালো জানা আছে। শুধু অপার নয়, শিশু মাত্রই আন্টির কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত। সেই আন্টিটা মা হতে চেয়েও পারলো না। আমি নিশ্চিত একবার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ১০ বছর পর পারুল আন্টি আবার বিয়ে করেছিল একটা সন্তানের মা হবে বলে।
নাট্যকলার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় সহযোগিতা করতে আসার আন্টিকে আমার পুরোপুরি চেনা হয়েছে। আমার কিছু বইপত্র পড়া ছিল, লিখিত পরীক্ষায় বেশ ভালোই করেছিলাম। কিন্তু নাট্যকলার ভর্তি হওয়ার জন্য শুধু পড়াশোনা থাকলেই চলে না। ব্যবহারিক পরীক্ষায় অভিনয়ও করে দেখাতে হবে। আমার কাছে অভিনয় তখনো অ-তে অভিনয় হয় পর্যন্ত। প্রায়ই সারাদিন অফিস শেষে পারুল আন্টি চলে আসত আমাদের বাসায়। মাঝরাত পর্যন্ত শেখাত অভিনয়। আমরা একেক সময় আবিদ-রুমুনি, অমল-সুধা হয়ে যেতাম। রিহার্সেলের ফাঁকে কত কত গল্প করতো। আন্টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকের সুধা চরিত্রটিতে অভিনয় করতো। আমাকে সে শিখিয়েছে সুধা আর অমলের চরিত্রটি। অমল যখন সুধাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি তাহলে ফুল তুলে আসবে?’ সুধা উত্তরে ‘আসব। অমল আসব’ বলে ছুটে যায়।
এখনো পারুল আন্টি কিশোরীর মতো ছুটে। অমল জানতে চায়, ‘আমাকে ভুলে যাবে না? আমার নাম অমল। মনে থাকবে তোমার?’ সুধা না ভোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছুটে, ‘ভুলব না। দেখো, মনে থাকবে।’ আমার পারুল আন্টি এই রকমই জীবনের সুধা, আমাদের সুধা। সেলিম আল দীনের নাটকের চরিত্র রুমুনি সে আমাকে তুলে দিয়েছে। আমি তার শেখানোটা ভালো করেই উপস্থাপন করতে পেরেছি এবং শেষপর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অনেকের মধ্যে তৃতীয় হয়ে সুযোগ পেয়েছি।
সুধা-রুমুনিসহ আরো অনেক চরিত্রেই পারুল আন্টি মঞ্চে অভিনয় করেছে। আমার থেকে আন্টিরই বোধ হয় শখ ছিল বেশি যে আমি জাহাঙ্গীরনগরে পড়ি। স্বপ্ন দেখাতো। বলতো ‘আমার তিনবার সুযোগ হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরের মুক্তমঞ্চে অভিনয় করার। তুমি তো অনেক করবে। তুমি তো অনেক বড় অভিনেত্রী হবে, টিভিতে ইন্টারভিউ দিবে। তখন কী আমার কথা মনে রাখবে।’ আমি আন্টিকে ‘গুরুজী’ বলে ডাকি। আমি মনেপ্রাণে তাকে ‘গুরুজী; বলে মানিও।

সেইসব রাতে যখন আমাকে নাট্যকলার ভর্তি পরীক্ষার জন্য তৈরি করছে পারুল আন্টি। হঠাৎ হঠাৎ বলতো কখনো প্রেম করবে না। সব ছেলেই খারাপ। আন্টি তাহলে কেন এই খারাপ ছেলেদের একটা প্লাবনকে চিনতে পারলে না তুমি! এই প্লাবন, তিনি আন্টির নামে অপবাদ দিচ্ছেন যে আন্টি তার আগের বিয়ের কথা লুকিয়েছেন। আমি যতটুকু দেখেছি আন্টির সব পরিচিতরাই এই আগের বিয়ের কথাটা জানেন। আন্টি তাদেরকে নিজেই বলেন। প্লাবনকে পারুল আন্টি এটা জানায়নি, তিনি এসে আমার কাছে মাথাকুটে বললেও আমি বিশ্বাস করব না। যার সঙ্গে বাকি জীবন কাটাবার পরিকল্পনা করেছে, তাকে আন্টি সব জানাবে না, এটা পারুল আন্টির পরিচিতদের কেউ বিশ্বাস করবে না। এমনকি তার সন্তানস্থানীয়দের কাছে নিজের ভুলগুলো কত সরল করে বলে সে, সেতো আমিই সাক্ষী।
লকডাউনের পর আমি বাড়িতে চলে এলাম। আন্টির সঙ্গে এই এক মাসের ভেতরেই আমার ভিডিও কলে কথা হয়েছে। আন্টি তখনও তার বিয়ের কথাটি গোপন করে হাসবেন্ডকে তার বিএফ বলছিল। তাহলে গোপনীয়তার শর্ত রক্ষা করেছিল। বলছিল, ক্যাম্পাস খুললে তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসবে। তখনও আমি আন্টির বিয়ের খবর জানি না। যেদিন ফেসবুকে প্রথম দেখলাম, তখন একটু অভিমানই হয়েছিল। আন্টি আমাকে জানালোও না।
প্লাবন আপনি জানেন না, কাকে পেছনে ফেলে গেলেন। পারুল আন্টি তুমি একদম মন খারাপ করবে না। প্লাবনের বিচার করতে হবে। তোমার শতপুত্র তোমার সঙ্গে আছে। না, পুত্র বাদ দাও। আমরা তোমার শত কন্যা আছি। ব্যাসদেবের সেবা করে গান্ধারী শতপুত্রের জননী হয়েছিলেন। সেই পুত্রদেরই কেউ দুর্যোধন, কেউ দুঃশাসন হয়েছিল, যাদের জন্য কুরুক্ষেত্র হলো। একালে দুর্যোধনরাই প্লাবন হয়ে জন্মায়, এদের বিনাশ করতে হবে।
লেখক পরিচিতি:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্বের শিক্ষার্থী