পারুলকে বলছি, মূল লড়াইটা তোমাকেই করতে হবে

সুপ্রীতি ধর:

অনেকেই দেখলাম সাংবাদিক পারুল আর প্লাবনের ঘটনায় পারুলকে আত্মমর্যাদাহীন, আত্মসম্মানহীন, নারীবাদের একেবারে নিচের ওয়েভে পড়ে থাকা ‘শাবানা মার্কা’, ‘নারী জাতির কলংক’ বলে গালিগালাজ করছে। পারুলের কান্নাকে থোড়াই কেয়ার করছে, ভিকটিম ব্লেমিং গেইম খেলছে। আপাত:দৃষ্টে এই সমালোচকদের আমরা ‘আধুনিক’ বা ‘অত্যাধুনিক’ এবং নারীবাদের চতুর্থ স্তম্ভে আরোহনকারী বলেই ধরে নিতে পারি। এতে করে অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপে পারুলকে নিয়ে বাজে মন্তব্য যারা করছে, তারা আরও শক্তিশালী হচ্ছে। তাদের মুখের ‘অসংযত ভাষা’কে আরও লাগামহীন করে দিচ্ছে এসব লেখা। 
যখনই এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে, বিশেষ করে কোনো নারীর সাথে, তখনই দেখি এক ধরনের মানুষ দাঁড়িয়ে যায় ভিকটিমকে নানাভাবে পর্যুদস্ত করতে। নিজেদের সামাজিক অবস্থান থেকে অন্যকে জাজ করার মানসিকতা এক পর্যায়ে ভিকটিম নারীর চরিত্রহননেও পিছপা হয় না।  এদের বেশিরভাগই হয় সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির, যারা সাধারণ ঘরের মেয়েদের জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না বা ধারণা করার শক্তিও যাদের নেই, তারাই তখন মেরুদণ্ড সম্পর্কে জ্ঞান দিতে তৎপর হয়।
 
আমরা এই ‘আধুনিক’দের তুলনায় একেবারেই সেঁকেলে মানুষ, বুঝি কম। বড় বড় তত্ত্ব নিয়ে লেখাপড়া কম। তবে এইটুকু বুঝি যে নারীবাদে মানবিকতা বলে একটা শব্দ আছে। সিস্টারহুড বলে একটা বিষয় আছে। বিশেষ করে সেই ‘বাদ’ বা ‘ইজম’ যদি হয় সমাজের শৃঙ্খলিত গোষ্ঠী সংশ্লিষ্ট, তখন পথটা খুব ধীরে হাঁটতে হয়। তাড়াহুড়ার করার স্থান এটি নয়। তাড়াহুড়া করলেই পা পিছলে যাবার আশংকা থাকে।  কখন হাতটা ধরতে হবে, কখন কাঁধটা এগিয়ে দিতে হবে, আর কখন বকা দিতে হবে, সমালোচনা করতে হবে, এটা জানা সবচেয়ে বেশি জরুরি নারীমুক্তি আন্দোলনে। মুখে মুখে নারী মুক্তি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ চাপাবাজি করে ফেললাম আর নারীরাও মুক্তি পেয়ে তা ধেই তা ধেই করে নেচে উঠবে, বিষয়টা এতো সোজা না।
মনে রাখতে হবে, সবার চলার পথ সমান না, মসৃণও না। সবার জুতার মাপ এক না। সুতরাং হাঁটার গতিটাও যে এক হবে না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাই বলে যে ধীরে হাঁটছে বা দ্রুত হাঁটতে অক্ষম, তাকে ফেলে অন্যরা এগিয়ে যাবে? তাও এগিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু হাতটা পিছনদিকে সম্প্রসারিত রাখতে হয় যাতে করে পিছিয়ে থাকারা সেই হাতটা ধরে সামনের দিকে এগোনোর সাহস পায়, পথ খুঁজে পায়। 
প্রায়শই আমরা বলি যে, ‘এতো সহ্য করার কী আছে, বেরিয়ে আসো ওই শৃঙ্খল ভেঙে’, ‘নির্যাতক স্বামীকে ছুঁড়ে ফেল বা শাস্তি দাও’। এসব বলি, কারণ বলতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু যে ওই পরিস্থিতিতে খাবি খাচ্ছে, যে নিত্য পাঁকে পড়ে আরও অতলে তলিয়ে যেতে থাকে, তার পক্ষে বেরিয়ে আসাটা কি এতোই সহজ? নাকি সম্ভব? মেয়েদের জন্য বেরিয়ে আসার কোন পথ যদি আমি তৈরি করে দিতে না পারি তবে এ ধরনের উদ্ধত কথা বলা আমাকে মানায় না।
আমি, আপনি, আমরা কিছু মানুষ হয়তো বা সমাজের কিছুটা ভালো অবস্থানে আছি, তাই বলে সবাই আছে? একেক জনের জীবন নানান অভিজ্ঞতায় ঠাসা। বইতে বা পত্রিকার অক্ষরে যে জীবন লেখা থাকে, সেখান থেকে আসল জীবনের নির্যাস নেয়াটা অসম্ভব একেবারে। তাই বলে এটা বলছি না যে, যারা নির্যাতিত বা অবহেলিত বা বঞ্চিত, শোষিত, তাদের অবস্থা বোঝার জন্য আমাকেও সেই শ্রেণিভুক্ত হতে হবে! তা নয় মোটেও। কিন্তু তাদের জীবনের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। নানাভাবেই সেটা সম্ভব। ওই যে আগেই বললাম, বার বার বলি এই কথাটা, অন্যের কষ্টটা বুঝতে হলে তার জুতাটা পায়ে লাগিয়ে হাঁটার চেষ্টাটা করতে হয়। তাহলেও বোঝা যায়, কতোটা ক্ষরণ, কতোটা রক্ত ঝরলেই কেবল একটা মানুষ অন্যের চোখে এমন ‘আত্মমর্যাদাহীন’ হয়ে উঠে! কতোটা বিপাকে থাকলে, কতোটা ভালবাসাহীনতার নর্দমায় আটকে গেলেই মানুষ এমন বাঁচার জন্য খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে অথৈ সমুদ্রে। তখন ভালোমন্দ জ্ঞান লোপ পায়, কাছের বন্ধুদেরও শত্রু বলে মনে হয়। সম্পূর্ণ মানসিক ভারসাম্যহীন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন। কাজেই তখন বকাঝকা নয়, বরং ভালবেসে তার পাশে দাঁড়াতে হয়। তাকে আশ্বস্ত করতে হয় এই বলে যে, ‘তোমার পাশে আছি’। 
আমি মোটেও সাজিদা ইসলাম পারুলের সাফাই গাইছি না। ওর অনেক ভুল আছে। ধরলাম ওর পুরো জীবনটাই ভুলে ভরা। তো? এখন কী করতে হবে পারুলকে? ওকে ‘নারী জাতির কলংক’ বলতে হবে? ওকে আমার ‘থাপ্পর’ দিতে হবে? আমি কে তাকে এই কথা বলার? আমাকে কে এই ক্ষমতা দিয়েছে যে এক কথায় ওর কষ্টটাকে, ওর কান্নাকে আমি ওড়িয়ে দেবো?
সবার প্রতিবাদের শক্তি বা ক্ষমতা এক থাকে? অন্যের জন্য রাস্তায় প্লেকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়ানো অনেক সহজ কাজ, কিন্তু যখন আঘাতটা নিজের ওপরে আসে তখন বোঝা যায় শক্তি কতুটুকু! পারুল আজ সেই জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে আছে। এসময় প্রয়োজন সমস্ত প্রশ্ন উহ্য রেখে ওর পাশে দাঁড়ানো। আশা করি পারুল এই বৈরি সময়টুকু পার হয়ে যাবে, পিছনের দিকে তাকিয়ে তখন তার হাসিই পাবে এই বোকামিগুলোর জন্য। ততদিন একটু না হয় অপেক্ষা করিই আমরা!
পারুলের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে নিজের অবস্থানটাকেও একটু বিবেচনা করতে হবে বৈকি! সমাজের সব পাওয়াদের অবস্থানে দাঁড়িয়ে না-পাওয়াদের বা খানিকটা পাওয়ার জন্য লড়াই করা মানুষের কষ্টটা অনুভব করা রীতিমতো দু:সাধ্যই বটে!
আমাদের সাংবাদিক সহকর্মিদের মধ্যে অনেকেই এর আগে এমন অনেক ঘটনার শিকার হয়েছে, তাদের সময়ও একইরকম সমালোচনা একটা পক্ষ করেছে। পুরুষরা যখন সব একপক্ষ হয়ে সেই নির্যাতক পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে যায় তখন আমরা বুঝতে পারি ওদের ‘শক্তির উৎস’টা কোথায়! কিন্তু যখন একইভাবে নারীরাও ওই পুরুষদের মতোনই তাদের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে, তখন মেয়েটি ‘একলা’ হয়ে যায়। ভীষণ একা। নারীবাদের এতো এতো তত্ত্ব কপচানোর পরও যদি এই সাধারণ বোধবুদ্ধিটা কারও না হয়, তখন আর কিছু বলার থাকে না।

সবশেষে পারুলকে শুধু এই কথাটাই বলতে চাই, প্রিয় পারুল, থেমে যেও না! মূল লড়াইটা তোমাকেই করতে হবে! আমরা শুধু পারবো সাহস যোগাতে আর সান্ত্বনা দিতে! যা কীনা ভীষণ জরুরি এই সময়ে।

একজন সহকর্মির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতেই পারি, নির্যাতক রেজাউল করিম প্লাবনের পক্ষাবলম্বন করা বন্ধ হোক। আর পারিবারিক বিষয় আর নারীর প্রতি সহিংসতা যে এক নয়, এটাও বুঝিয়ে দিতে হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলা সাংবাদিকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে! সুতরাং এটাকে পারিবারিক বিষয় বলে আমরা আর এড়িয়ে না যাই!

সাংবাদিক সাজিদা ইসলাম পারুল যৌতুকের জন্য নির্যাতন এবং ভ্রুণ হত্যার অভিযোগে রেজাউল করিম প্লাবনের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা করার পরও অভিযুক্তকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। শুনেছি প্রধানমন্ত্রীর খবর কভার করেন প্লাবন। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটা বিশাল দায়িত্ব এখানে বর্তাচ্ছে। প্লাবনের বিষয়ে তারা কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা দেখার আশায় রইলাম। আর প্লাবনের নিজ কর্মস্থল ‘যুগান্তর’ পত্রিকা তো আছেই, মূল দায়িত্বটা তাদেরই পালন করতে হবে।

অবিলম্বে অভিযুক্ত প্লাবনকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হোক। পাশাপাশি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং সাংবাদিক নেতাদের দিকেও তাকিয়ে রইলাম অন্যসব ঘটনার মতোন এটিও যেন তারা এড়িয়ে না যায়। এর আগেও অনেক অভিযোগ উঠেছে অন্য পুরুষ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, তখনও সবাই চুপ ছিল। কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। এবার অন্তত নিজেদের মেরুদণ্ডের অবস্থানটা প্রকাশ করুক।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.