চারা গাছের যত্নআত্তির মতোনই প্যারেন্টিং

কৃষ্ণা দাস:

সন্তান জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না, পিতৃত্ব কিংবা মাতৃত্ব অর্জন করতে হয়। এমন অনেক বাবা কিংবা মা কিংবা উভয়ই আছেন যারা সন্তানের জন্মক্ষণ থেকেই সন্তানকে বিভিন্নভাবে শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করে থাকেন। জন্মক্ষণ বলছি, কারণ এরা মাতৃত্ব বা পিতৃত্ব কী তা বুঝবার আগেই সন্তান ধারণ করে ফেলেন। ফলে যথেষ্ট মানসিক প্রস্ততি এদের থাকে না, আর সে কারণেই সন্তানের জন্মক্ষণ থেকেই যে যে মানসিক ও শারীরিক যত্ন পেয়ে এই বাচ্চাগুলোর বেড়ে উঠার কথা ছিল, তারা তা থেকে শুরুর দিক থেকেই বঞ্চিত।

গুড প্যারেন্টিং বলে একটা কথা আছে, এর সাথে যথেষ্ট পরিচিত না হয়ে সন্তান জন্ম না দেয়াই ভালো। আপনার সাময়িক মজার বোঝা যেন ওই বাচ্চাটি জীবন দিয়ে মেটাতে না হয়, সেদিকে যথেষ্ট সচেতন থাকা’ই শ্রেয়। বিভিন্ন ধরনের শিশু বিকাশমূলক গবেষণা এবং কেস স্টাডি থেকে জানা যায়, শিশুরা বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয় তার নিজ পরিবারেই। আর তার দরুন যা হয় এই শিশুগুলো সেই ছোট্টবেলা থেকেই নানা ধরনের হতাশা, ভয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব, মনোযোগের অভাবসহ নানাবিধ সমস্যায় ভোগে, যা তার সুস্থ মানসিক ও শারীরিক বিকাশের প্রধান অন্তরায়। এজন্যই সাইকিয়াট্রিস্টরা যখন সেশনে বসেন, তখন সবার আগে একেবারে ছোটবেলার গল্প শুনে।

কৃষ্ণা দাস

কিন্তু আমাদের সমাজে এই কথাগুলো তোলা একটা বিরাট ট্যাবু। বাবা-মা সম্বন্ধে নেগেটিভ কথা কেউ বলতে গেলেই তাকে “এই, চুপ চুপ! এরকম বলতে নেই!” করে থামিয়ে দেওয়াটাই একটা অভ্যাস। ওদিকে বৃদ্ধাশ্রমের করুণ জীবন, ছেলেমেয়ে বাপ-মাকে দেখেনি বলে তারা কত পাষণ্ড, এই নিয়ে নিত্যনৈমিত্তিক নানা বিলাপ হয়েই চলেছে।

এবং বাবা দিবস আর মা দিবস জুড়ে ‘ওরা না থাকলে আমরা কত অসহায়’ জাতীয় ন্যাকামির বন্যা বয়ে চলেছে অনন্তকাল ধরে। যে সন্তান হয়তো বাড়ির ভায়োলেন্ট পরিবেশের মোকাবিলা করতে গিয়ে সারাজীবনের মতো ডিপ্রেশনের সঙ্গে যুঝছে, যে সন্তান হয়তো মেয়ে বলে বঞ্চিত হয়েছে বিভিন্নভাবে, যে সন্তান হয়তো গোটা ছেলেবেলা ফিজিক্যালি আ্যবিউজড হয়েছে বাপ-মার দ্বারা, তারাও এইসব ‘দিবস’ উদযাপন করে ট্রমা চেপে রেখে, কারণ “লোকে কী বলবে!”

সন্তান বাবা-মাকে দেখে না এই গল্পটা আমরা জানি, কিন্তু অনেক সময় বাবা মা ও সন্তানকে দেখে না, এই কথাটা জেনেও আমরা অনেকে প্রশ্ন তুলি না। কারণ এসব কথা বলতে নেই, বাবা মা ঈশ্বর তূল্য! এদের কি কোনো ভুল আছে, সে যদি বাবা মার দ্বারা সন্তান হতাশ হতে হতে মস্তিষ্ক ক্ষয়েও ফেলে তাও একথা মুখে আনতে মানা। আর বাবা-মা তো সন্তানকে তার নিজস্ব সম্পত্তি ভাবতেই থাকেন, যেখানে সন্তান জন্ম দিয়েই যেন বিশাল দায়িত্ব পালন হয়ে গেছে, সুতরাং তার নিজস্ব সম্পত্তিকে সে ভাঙ্গবে না মচকাবে এই নিয়ে আমাদের সমাজের প্রকৃতি পক্ষে বলার তেমন কিছু থাকে না। যতদিন না পর্যন্ত তা কোন বিরাট ধামাকায় রূপ নেয়।

এক্ষেত্রে ঐশীর প্রসঙ্গটা (বাবা মা কে খুনের অভিযোগে আজ কারাবন্দী) এক বিরাট উদাহরণ। এই বাচ্চা মেয়েটা যে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো তা কি কেবল ওই মেয়েটার একার দায়? এর দায় থেকে ঐশির বাবা মা’কে কি কোনভাবে বাদ রাখা থেকে বিরত রাখা যায়? সমাজে এই ধরনের হাজার ঐশী আছে, হয়তো নেশায় বুঁদ হয়ে খুনটা করার মতো সাহস যোগাতে পারছে না।

সন্তানকে যদি আমরা চারাগাছ ভাবি, তবে বাবা-মা কি তার মালি বা রক্ষক নয়?! চারা গাছের যত্নের ত্রুটি থাকলে গাছ তো তার নিয়ম মাফিক বড় হওয়া থেকে বিরত থাকবেই (মানসিক)। বিভিন্ন পোকা আর আগাছার আক্রমণ তো তখন তাহলে খুবই স্বাভাবিক ৷ কাজেই বাবা মা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব নয় কি একজন দায়িত্ববান মালি/রক্ষক হয়ে উঠে এই চারা গাছগুলোর সংরক্ষণ করে বড় গাছে পরিণত করা? তবেই তো তার সুবাতাস পাবে পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র। কাজেই যথেষ্ট মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই সন্তান জন্মের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করা উচিত।

এক্ষেত্রে আরেকটা প্রসঙ্গ টানা দরকার, অধিকাংশ মানুষ আসলে সন্তান জন্ম দেয় হয় সমাজের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি এড়াতে (কী ব্যাপার, এখনো ছেলেপুলে হল না?) অথবা নিজেদের একাকিত্ব কাটাতে। এবং প্রচুর বাপ-মা নিজেদের সমস্ত ক্ষোভ, হতাশা, ব্যর্থতা, প্রেজুডিস, অপূর্ণ-আকাঙখা, ইত্যাদি উগরে দেয় সন্তানের ওপর। আসলে হয়ত খুব কম মানুষই আছে যারা সন্তানের জন্য ‘নিঃস্বার্থ’ভাবে আদৌ কিছু করেছে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই, স্বার্থের হিসেবে অনেক বেশী পাওয়ার পরেও তারা অন্তত প্রাপ্যটুকুও ফিরিয়ে দিতে অক্ষম হয়৷

শুধুমাত্র সন্তানের জন্ম দেওয়া কোনো মহৎ কাজ নয়, হতে পারে না৷ পৃথিবীর যে কোনো পশু মাঝেমধ্যেই সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকে, চাক বা না চাক, কারণ তাদের কাছে কন্ট্রাসেপ্টিভ নেই। মানুষের কাছে অন্তত ‘প্রোটেকশন’ বলে একটা বস্তু আছে৷ যে সন্তান ছেলেবেলার ট্রমার প্রকোপে অথবা বাপ-মায়ের এক্সপেক্টেশনের চাপে আত্মহত্যা করে, সে বোধয় একটা কন্ট্রাসেপ্টিভের সাহায্যে নিজ জন্মরোধে তেমন আপত্তি করত না।

আসুন আরেকটু সচেতন হয়ে সন্তানের বেড়ে উঠার পথকে প্রশস্থ ক’রে তুলি। এক্ষেত্রে গুড প্যারেন্টিং এর উপর বিভিন্ন বই বাজারে এবং গুগলের সাহায্য নিয়ে জানার আর জানাবার আগ্রহ তৈরি করে তুলি। বাবা-মা হওয়াটা সোজা, পিতৃত্ব আর মাতৃত্ব অর্জন করাটা কিন্তু বেশ কঠিন। এটা অজর্নের চ্যালেন্জটা গ্রহণ করেই এগুনোর প্রক্রিয়াটা মনে মনে ধারণ করুন। আমরা সবাই জানি, আজকের শিশুই, আগামীর ভবিষ্যৎ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.