কোনদিক সামলাবো, করোনা, নাকি নারীর প্রতি সহিংসতা!

রুবিনা ইয়াসমিন:

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত ‘জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট- ২০২০’ বলছে, নারী – পুরুষ সমতায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। যেখানে ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম, সেখানে ২০২০ সালে ১৫৩ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০ এর কোঠায়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটিই বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে গত ৫০ বছরে পুরুষের তুলনায় নারীরা অধিক সময় ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন।

রীতিমতো হাফ ছেড়ে বাঁচার মতো এ সংবাদ আমাদের খানিক স্বস্তি দিলেও একটা বড় প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় সমতার শীর্ষে দাঁড়িয়েও সহিংসতা থেকে কতটা নিরাপদে রয়েছেন একজন নারী? বিশেষত কোভিড- ১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাব কি পারিবারিক সহিংসতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে? বাড়িতে অবস্থান করা কোভিড- ১৯ থেকে বাঁচার জন্য নিরাপদ স্থান হলেও সেটি একজন নারীর জন্য ঠিক কতটা নিরাপদ?

ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বেশ কিছু খবর উঠে এসেছে নির্যাতন ও সহিংসতার। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় নারীর প্রতি সহিংসতা এবং আগ্রাসন বাড়ছে আশংকাজনকভাবে। উইমেন হেল্প ডেস্ক, কোর্ট হেল্প ডেস্ক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জাতীয় মহিলা অধিদপ্তরের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ মার্চ থেকে ৮ মে, ২০২০ পর্যন্ত বগুড়া জেলায় নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগ এসেছে ৮৯৯ টি, জামালপুর জেলায় ৩৬৪ টি, পটুয়াখালী জেলায় ২২১ টি এবং কক্সবাজার জেলায় ৪৫১ টি। অন্যান্য জেলার অবস্থাও খুব একটা সুখকর নয়!

এছাড়াও এমন আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে যেগুলো বাড়ির ছাদের নিচ থেকে কোর্ট হেল্প ডেস্ক অথবা থানার কাগজ কলমে উঠে আসে না। শুধুমাত্র সন্তান এবং সামাজিকতার কথা ভেবে যেমন অনেক নারী সকল অভিযোগ গলাধঃকরন করে ফেলেন, ঠিক সেরকমই। তাছাড়া বর্তমানে স্কুল- কলেজ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণেও এই ধরনের ঘরোয়া সহিংসতা আরো বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকেরা।

সেইসঙ্গে করোনা পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশংকাও বর্তমানে অনেকের মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেই বিপর্যয় থেকেও বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা ও নির্যাতন। জেলাভিত্তিক পর্যায়ে যার অবস্থা নিতান্তই করুণ। ২৪ ঘন্টা ঘর সামলান যে গৃহিণী, তার ওপর বেড়েছে কাজের চাপ। কাজের চাপের সাথে সাথে বেড়েছে বৈষম্য, রোষানল এবং সহিংসতা।

গৃহিণী মাত্রই নয়, ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয় কিশোরীরাও। মাস দুয়েকও হয়নি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে, অনেক কিশোরীর জন্যই সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবার যোগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আইন অমান্য করে পাল্লা দিয়ে চলছে বাল্য বিবাহও। গবেষণা আমাদেরকে দেখায় যে, বিশ্বব্যাপী যেকোনো মহামারীর পরেই ঘটেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়। এর প্রভাব এবং আশঙ্কাই এ ধরণের কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, এই সময় সহিংতার সময় নয়, বরং এখনই সময় সহমর্মী হওয়ার। এই বিপর্যয়ে যদি নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে না আসেন, তাহলে এই দুর্ভোগ মোকাবিলা করা আমাদের জন্য দিনকে দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়বে। বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা দমনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের যথাযথ পদক্ষেপ না থাকলে করোনা পরবর্তী সময়েও হয়তো এই লড়াইটা আমাদের লড়ে যেতে হবে অনেকদিন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.