একেই কি বলে গণতন্ত্র?

তামান্না ইসলাম:

একটা খবর দেখে চমকে গেলাম। ফেসবুকে এক নয়, একাধিক সরকারি কর্মকর্তা বন্ধু পোস্ট করেছে বিষয়টি নিয়ে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ৭ মে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সরকারি দপ্তরসমূহে এবং সরকারি কর্মচারিদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে। নির্দেশনা দেখে আমার মনে হচ্ছিল, শুরুতে যে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ শব্দটা ব্যবহার করেছি, সেটা উঠিয়ে নেওয়া দরকার। বরং বলা উচিত কোন একনায়কতন্ত্র বা সামন্ততান্ত্রিক দেশ। আলোচনার সুবিধার্থে নির্দেশগুলো হুবুহু এখানে তুলে ধরলাম।

• সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়- এমন কোন বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া যাবে না। এমন কোন ছবি আপলোড করা, কমেন্ট করা, লাইক দেয়া, কিংবা কোন বিরূপ মন্তব্য বা শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে৷
• জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী কোন রকম তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
• কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন বা ধর্মীয় নিরপেক্ষতা পরিপন্থী কোন তথ্য -উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা আইন শৃংখলার অবনতি ঘটাতে পারে- এমন কোন পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক ও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
• জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোন সার্ভিস/পোশাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এমন কোনো পোস্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
• লিঙ্গবৈষম্য বা এ সংক্রান্ত বিতর্কমূলক কোন তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না ৷
• জনমনে অন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে – এমন কোন বিষয়ে লেখা, অডিও বা ভিডিও ইত্যাদি প্রকাশ বা শেয়ার করা যাবে না৷
• ভিত্তিহীন, অসত্য ও অশ্লীল তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
• অন্য কোন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য সম্বলিত কোন পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক ও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে ৷

এই আটটি নির্দেশের মধ্যে একটি নির্দেশ যুক্তিযুক্ত বলা যায়। ভিত্তিহীন, অসত্য ও অশ্লীল তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। ভিত্তিহীন এবং অসত্য মানলাম, কিন্তু অশ্লীল? এটা একটা আপেক্ষিক ধারণা, তার চেয়েও বড় ব্যাপার কোন কোন সত্য অশ্লীল, সেটা কিন্তু মানুষের সামনে আসা প্রয়োজন। অশ্লীল বলে অন্যায়কে তো ঢেকে রাখা যাবে না। এছাড়া বাকি প্রতিটা নির্দেশনা ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী। সরকার যদি অন্যায় করে, সেই অন্যায়ের সমালোচনা করা যাবে না?

জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের টাকায় চলা জনপ্রতিনিধির জবাবদিহিতা থাকা বাধ্যতামূলক। এটাই গণতন্ত্রের ভিত্তি। বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এগুলো নাগরিকদের নুন্যতম অধিকার। জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে এমন কিছুও পোস্ট করা যাবে না। দেশটার বারোটা বাজতে থাকবে আর সরকারি কর্মকর্তারা মিথ্যে করে শান্তির বাণী ছড়াতে থাকবে? কোন দেশ বা জাতিই বার মাস, চব্বিশ ঘণ্টা সুখের সাগরে ভাসে না। দেশটা জনগণের, সুতরাং দেশের প্রকৃত অবস্থা জানার পূর্ণ অধিকার আছে তাদের। সেটা অসন্তোষই হোক, আর অপ্রীতিকরই হোক।

লিঙ্গ বৈষম্য বা ধর্মীয় নিরপেক্ষতা পরিপন্থী কোন তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না। কেন? তার মানে তলে তলে এইসব অনাচার চলতে থাকবে আর জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে এইসব দিনের পর দিন চলতেই থাকবে? জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী কোনরকম তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে, এটাও অনেকটা এই শ্রেণির অনাচারেই পড়ে। দেশে লিঙ্গ বৈষম্য আছে, ধর্ম বৈষম্য আছে। সেগুলো নিয়ে তথ্য উপাত্ত প্রকাশ পেলে জাতীয় ঐক্য হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। কিন্তু সেটাকে চাপা দিলে তো আর ঐক্য বজায় থাকবে না, আর এইসব সমস্যারও কোন সমাধান হবে না। বরং এইসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তাদেরকে জানাতে হবে আসল ঘটনা। সরকারি কর্মকর্তারা দেশের শিক্ষিত জনপ্রতিনিধি, জনগণের কাছে তাদের দায় আছে। তারা কারো পোষা কুকুর নয়, বিবেক বুদ্ধিহীন রোবটও নয়।

আমার আজ দেশের প্রতিটা সরকারি কর্মকর্তার জন্য ভীষণ মায়া লাগছিল। যাদেরকে আইনের শৃঙ্খল পরিয়ে কিছু গৃহপালিত পশু হিসাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশের নাগরিক, আশা করা যায় অপেক্ষাকৃত বেশি সচেতন আর দায়িত্বশীল নাগরিক। বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাদের নাগরিক অধিকার। কোন ক্ষমতাবলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সেই মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়? একেই কি বলে গণতন্ত্র?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.