হাসনাইন খুরশেদ:
খুব ছোটবেলা থেকেই আমি বাসে উঠতে পারি না। পেট্রোলের গন্ধ নাকে গেলেই সব গুলিয়ে উঠে। সেই আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হলাম ঢাকা ভার্সিটিতে। গণ-যোগাযোগ ও সাংবাদিতা বিভাগে। আজন্ম স্বপ্ন পূরণ হলো। এটাচড হলাম হাজী মুহসীন হলে। কিন্তু আমার হলে থাকার স্বপ্ন ভঙ্গের সব আয়োজন তো অনেক আগেই সম্পন্ন।
আমার একমাত্র বোন আমার চেয়ে সাত বছরের বড়। ওদের বিয়ের পরই দুলাভাই ঢাকায় বাসা নিতে চান। আপুৃমণি রাজি হয় না। ও জানে, শৈশবের বন্ধুদের টানে দুলাভাই প্রতি সপ্তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবেই। আপুৃমণির এক কথা, শুচি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যদি আমাদের সাথে থাকে, তবেই ঢাকায় বাসা নেয়া হবে। নইলে যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলুক। ঢাকার বাসায় একদিনও যদি একা থাকতে হয়, ভয়ে মরেই যাবো।
আমার ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার খবরে পাগলের মতো বাসা খুঁজেন দুলাভাই। উত্তর শাহজাহানপুরের শহীদবাগ মসজিদের গলিতে তিন বেডরুমের বাসা ভাড়া নেন। বাসায় ল্যান্ডফোন আনেন। সবার জোরাজুরিতে সেই বাসায় আমি তাদের স্থায়ী অতিথি। ভর্তি তো হলাম, কিন্তু এতো দূর থেকে ক্যাম্পাসে যাবো কি করে! বাসে তো উঠতেই পারিনা। রিক্সায় শহীদবাগ থেকে ক্যাম্পাসে যেতে-আসতে বিশ-বাইশ টাকা ভাড়া গুণতে হয়। এতো টাকা পাবো কোথায়!

আব্বা তখন চাঁদপুর সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন তখন অনেক কম। সীমিত সেই আয়ে চলে সাত জনের সংসার। সবচেয়ে বড় ভাই বুয়েটে আর্কিটেকচারে পড়ে। মেজো ভাই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। আর ছোট ভাইটা স্কুল পেরিয়েছে কেবল। সব খরচ সামলে আম্মা প্রতি মাসে যে টাকা আমাকে দিতে পারবেন, রিক্সা চড়লে তা ফুরিয়ে যাবে দশ দিনেই। করবোটা কী!
নিজেই নিজেকে বলি, কিছুই করার নেই। মানিয়ে নিতেই হবে। রিকশা চড়েই প্রথম দিন ক্যাম্পাসে যাই। সন্ধ্যায় চাঁদপুরে আমাদের বাড়িওয়ালার বাসা থেকে আম্মা ফোন করেন। খবর নেন ভার্সিটিতে প্রথম দিনটা কেমন কাটলো? কীভাবে যাতায়াত করলাম?
এতো টাকা রিক্সা ভাড়া শুনে চমকে উঠেন আম্মা। আমি বলি, চিন্তা করবেন না। ভার্সিটি বাসে কমলাপুর রুটের মান্থলি টিকেট কেটেছি। খুব কম দাম। আম্মার উদ্বিগ্ন ক্ণ্ঠস্বর ভেসে আসে, বাসে! তুই বাসে যেতে পারবি!
পারবো আম্মা। পারতেই হবে।
পরদিন সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। সবার পরে বাসে উঠি যেন প্রয়োজনে নেমে যেতে পারি। দরোজার হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকি। আশায় থাকি, বাইরের বাতাসের তোড়ে পেট্রোলের গন্ধ নাকে পৌঁছাবে না। মালিবাগে বাস থামতেই আমার সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে। আমি আর পারি না। বাস থেকে নেমে পড়ি। হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরে আসি।
যথারীতি সন্ধ্যার পরই আম্মার ফোন। না বলে পারলাম না। সব শুনলেন। কথায় কথায় জানতে চাইলেন, মোটরবাইকের দাম কেমন। বললাম, জেনে জানাবো। ফোন রেখে বাইরে বেরুতেই দেখা সোহেলের সাথে। আমার শহীদবাগ-জীবনের প্রথম বন্ধু। বাইক বিশেষজ্ঞ।
শাহজাহানপুরের কয়েকটা ওয়ার্কশপ নিয়ে গেলো সোহেল। রাত দশটার আগেই একটা পুরনো বাইকের হদিস মিললো। সব দেখে পছন্দ হলো। দাম ফুরালাম আট হাজার টাকা। কিন্তু এতো টাকা আমি কোথায় পাবো! আম্মাকে বলেই বা কী হবে! আমি তো আমাদের অবস্থা জানি। তবুও অনন্ত আকাশে উড়াই মধ্যবিত্তের স্বপ্নের ঘুড়ি।
পরের সন্ধ্যায় আবারও আম্মার ফোন। ক্যাম্পাস আর পড়াশোনার খোঁজ-খবর নেন। কথায় কথায় জেনে নেন, আট হাজার টাকার বাইক আমার পছন্দ হয়েছে। আর কিছু বলেন না। বাস জার্নিতে মানিয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করি। প্রতি সকালে ভার্সিটির বাসে উঠি। যত দূর পারি যাই। না পারলে নেমে পড়ি। বাকি পথটুকু হাঁটি। বাসে চড়তে পারি না বলে তো জীবন থমকে যাবে না।
জানি, আব্বা-আম্মা অনেক স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি পথ চলি। পয়লা সপ্তাটা এভাবেই কেটে যায়। বন্ধুবান্ধব জুটে যায়। জমে উঠতে থাকে ক্যাম্পাস-জীবন। সেদিন টিএসসিতে আড্ডা দিয়ে ফিরতে বেশ রাত হলো। বাসায় ঢুকতেই আপুমণি বললো, আম্মা ফোন করেছিলেন। তোকে কালকেই বাসায় যেতে বলেছেন। খুব জরুরি।
সব ঠিক আছে তো? আব্বা-আম্মার শরীর ভালো তো?
উনারা ভালো আছেন।
তাহলে?
কী জানি।

আমার টেনশন হয়। সকাল হতেই সদরঘাটে ছুটে যাই। স্টিমার ‘বেঙ্গলে’ চেপে বসি। এতো জরুরি ডাক কেনো?
আমার ভেতরটা ছটফট করে।
সাড়ে বারোটার দিকে নাজিরপাড়ার বাসায় পৌঁছে যাই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে চিৎকার করে ডাকি, আম্মা.. আম্মা..
দরোজা খুলে হাসি মুখে আম্মা বেরিয়ে আসেন। পরম আদরে জড়িয়ে ধরেন।
জানতে চাই, কী হয়েছে?
না, কিছু না। হলে থাকতে দিলাম না। তুই কতো কষ্ট করে ভার্সিটিতে যাস।
আম্মার কণ্ঠ জড়িয়ে যায়।
আমি কিছু বলতে পারি না। আম্মাকে জড়িয়ে থাকি।
পরদিন সকাল। ঢাকায় ফিরবো বলে বাসা থেকে বের হচ্ছি। আম্মা আমার হাতে একটা খাম তুলে দিয়ে বললেন, খুব সাবধানে রাখ। দশ হাজার টাকা আছে। ঢাকা গিয়েই মোটর বাইকটা কিনে নিস। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। তারপর.. তারপর খুশিতে লাফিয়ে উঠি। বেরিয়ে পড়ি বড়স্টেশন লঞ্চঘাটের উদ্দেশ্যে। আকাশ রঙের ইয়ামাহা ওয়াই বি এইটি। আমার প্রথম মোটরবাইক। আম্মার আদর আর দোয়া মিশে থাকা বাইকটি আমার জীবন বদলে দেয়। জীবনে দূরন্ত গতি এনে দেয়।
মোটরবাইকটা কেনার ক’দিন পরই বেতার-টিভিতে জাতির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির ভাষণ। ঘোষনা এলো, বিশ্ব-বাজারে পড়তি দামের সাথে সঙ্গতি রেখে দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হলো। প্রতি লিটার অকটেনের দাম পনেরো টাকা থেকে কমে দাঁড়ালো আট টাকা।
আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।
শুরু হলো ঢাকায় আমার দুর্দান্ত জীবন। আমি সাংবাদিকতায় মেতে উঠি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসাবে চাকরিতে যোগ দেই। নানা ম্যাগাজিনে লিখি। বিভিন্ন এনজিও’র নানান রকম কাজে ব্যস্ত থাকি। বিটিভি’র অনুষ্ঠানে নেপথ্য-কর্মী হিসাবে কাজ করি। আমার কোন দিন থাকে না। আমার কোন রাত থাকে না। আমি সারাক্ষণ মোটরবাইক দাবড়ে বেড়াই সারা শহর জুড়ে। মাস শেষে বেতন পাই। মাঝে মাঝেই নানা কাজের বিল পাই। পকেট গম গম করে।
আমার জীবন ভরে ওঠে অপার আনন্দে।
২০০১ সাল। একুশে টেলিভিশন তখন তুমুল জনপ্রিয়। টেরিস্ট্রিয়াল ও স্যাটেলাইট দুই মাধ্যমেই সম্প্রচার হয়। দেশের আনাচে-কানাচে আর বিশ্ব জুড়ে বাঙালির প্রাণের টেলিভিশন। সেই একুশে টেলিভিশনের সূচনালগ্নের সাত রিপোর্টারের একজন আমি। দেশ-বিদেশে অনেকেই আমাকে চেনে।
প্রতিদিন টিভি-পর্দায় আমাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন আম্মা। ডায়াবেটিসে আব্বার দৃৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে। তিনি কান পেতে থাকেন। ততদিনে আম্মার পছন্দে পুতুল আর আমি সংসার পেতেছি। আমাদের অর্পার বয়স আড়াই বছর পেরিয়ে গেছে। বড়ো ছেলে অর্ক জন্মেছে কেবল। ওকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় পুতুলকে। আম্মা-আব্বা আমাদের বাসায় আসেন। আম্মা দারূণ মমতায় অর্পাকে আগলে রাখেন।
সেই সোনালি সময়ে আমি প্রতিদিন আম্মার পাশে এসে বসি। দাদু-নাতনির গল্প শুনি। আমাকে পাশে বসিয়ে আম্মা অর্পাকে বলেন, জানো দাদু, তোমার বাবা যখন অনেক ছোট ছিলো, ঠিক তোমার মতোন..
অর্পা মুগ্ধ হয়ে দাদুর মুখে বাবার ছোটবেলার গল্প শোনে। আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকি। গল্প শুনতে শুনতে অর্পা ঘুমিয়ে পড়ে। আমরা মা-ছেলে হাজারো কথা বলি। আমাদের কথা ফুরোয় না। আম্মার সাথে এমনি নানা কথার ফাঁকে জানলাম, আম্মার সোনার অলংকারগুলো সবই সংসারের কাজে লেগেছে। ছেলে-মেয়ের কাজে লেগেছে। কথায় কথায় জেনে গেলাম, শেষ অলংকার সোনার চেইনটা বিক্রি করেই আম্মা আমাকে কিনে দিয়েছিলেন সেই আকাশ রঙের মোটরবাইক- ইয়ামাহা ওয়াই বি এইটি।
২০০২ সালের ৯ জুলাই রাতে হার্ট অ্যাটাকে আম্মা চলে গেছেন। এরপর কেটে গেছে প্রায় আঠারো বছর। আজও রাজপথে মোটরবাইক দেখলেই আম্মাকে মনে পড়ে। কেঁদে ওঠে আমার হৃদয়।
আমার আর কান্না ফুরোয় না!