দেশীয় পোশাক শিল্পকে বাঁচানো প্রয়োজন (পর্ব -০২)

তানিয়া ওয়াহাব:

আমাদের দৃশ্যমান অতীতে সমগ্র পৃথিবী একযোগে এতো বড় মহামারীর সম্মুখীন আর হয়নি। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এই পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মানুষ এখন সবচাইতে বড় যে প্রশ্নটার সম্মুখীন তাহলো “জীবন না জীবিকা”!! তৃতীয় বিশ্বের এই বাংলাদেশের পক্ষে, মধ্যম আয়ের দাঁড় প্রান্তে দাঁড়িয়ে জীবিকাকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র জীবন রক্ষা করার বিষয়ে চিন্তা করা প্রায় অসম্ভব।

কাজেই আমাদের দরকার জীবন এবং জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বা সমন্বয় সাধন করা। বিষয়টাও খুব যে সহজ তা কিন্তু না। মহামারী পরবর্তি সময়ে পুরো পৃথিবীতে এক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং স্থবিরতা আসবে যা সহজেই অনুমেয়। যার আগমনী বার্তা আমরা এক্ষুণি দেখতে পাচ্ছি। সে সময়টা অতিক্রম করার জন্য বাংলাদেশের মানুষের নিজেদের দেশী পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ততা হবে এক অনন্য শক্তি। পোশাক শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে কিছুটা ব্যখ্যা করার চেষ্টা করছি।

আমাদের হাতে যখন একটা তৈরি পোশাক আসে, সে পোশাক জন্মের ইতিকথার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, পোশাক তৈরির প্রথম ধাপের কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। যে তুলা বা Raw Cotton বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে আমদানি হয়ে আসে ভারত, পশ্চিম আফ্রিকা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকে। উজবেকিস্তান বা ব্রাজিল থেকেও আসে কিছু।

সে তুলা থেকে সুতা উৎপাদন হয় আমাদের দেশের স্পিনিং মিলগুলোতে। স্পিনিং এ উৎপাদিত সুতা থেকে বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে একটা অংশ তৈরি পোশাক হিসেবে বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। আর একটা বড় অংশ আসে দেশের বাজারে। সেই সুতা সাইজিং হয়ে আসে টেক্সটাইল মিলে। সেখানে সুতা থেকে কাপড় বোনা হয়। এর মধ্যেও রয়েছে কয়েকটি ধাপ। সেই তৈরি কাপড় বা Grey Fabrics পরবর্তী ধাপে যায় ডাইং কারখানাগুলোতে। সেখানে কাপড় রঙ এবং প্রিন্ট হয়ে পোষাক বানানোর প্রায় উপযোগী হয়। এ সকল কাপড় বেঁচাকেনার জন্য চলে আসে বাবুরহাট, সিরাজগঞ্জ, ভুলতা গাউসিয়া, রংপুরসহ দেশের বৃহৎ পাইকারি কাপড়ের বাজারগুলোতে।

সেখান থেকে তৈরি পোষাক বানানোর আগের ধাপ হিসেবে সেই কাপড় আবার ভাগ হয়ে চলে যায় ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্ট, হাতের কাজ, এম্ব্রয়ডারি, বাটিক, হ্যান্ড পেইন্টসহ বিভিন্ন ধাপের কারখানাগুলোতে। সেখান থেকে একটা কাপড় পোশাক তৈরির উপযোগী হিসেবে আসে সেলাই কারখানায়, তারপর খুচরা বিক্রয় কেন্দ্র পার হয়ে আসে আপনার বা আমার হাতে।

একটি দেশী পোশাক উৎপাদনের ধাপগুলোতে অর্থাৎ তুলা-স্পিনিং মিল-টেক্সটাইল-ডাইং-কাপড়ের বৃহৎ পাইকারি বাজার-পোষাক তৈরি পূর্ববর্তী প্রক্রিয়ার কারখানা (ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্ট, হাতের কাজ, এম্ব্রয়ডারি, বাটিক, হ্যান্ড পেইন্ট ইতযাদী)-খুচরা কাপড়ের বাজার-সেলাই কারখানা-পোশাক বিক্রয়কারী এই এতোগুলো ধাপে সরাসরি জড়িত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এবং তাদের পরিবার। এবং সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোর উদ্যোক্তারা।

আবার পরোক্ষভাবে এই প্রতিটি ধাপের কারখানাগুলো থেকে ট্যাক্স, ভ্যাট আদায় সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস, যা ব্যয় হয় দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। আবার দেশের ব্যাংকগুলোর মূলধন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান খাত এই দেশীয় কারখানাসমূহ। অর্থাৎ আমাদের একটা দেশীয় পোশাক ব্যবহারের সরাসরি সুফল ভোগ করে উপরে উল্লেখিত এতগুলো ধাপের সাথে সংশ্লিষ্ট লক্ষ, কোটি বাংলাদেশের মানুষ। সেই সাথে সরকারের আয়ের মাধ্যমে অব্যাহত থাকে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।

আমি আমদানিনির্ভর পোশাক বিক্রয় বা ব্যবহারের বিরোধিতা করছি না। আমদানির ক্ষেত্রে এর সুফল ভোগ করা জনগণের তুলনায় দেশীয় পোশাক ব্যবহারের মাধ্যমে কত বিপুলসংখ্যক মানুষের বেঁচে থাকা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয় জড়িত, সে দিকটাতে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আপনার একার দেশী পোশাক ব্যবহারে আসলে কতোটুকু কী এসে যায়! আপনি, আমি, আমরা সবাই মিলেই কিন্তু সতের কোটি মানুষের বাংলাদেশ। আগামী একটা বছর আপনি দেশী পণ্য ব্যবহার করুন, এমন একজন করে দেশীয় পণ্যমুখী হওয়ার মাধ্যমেই একদিন “আমরা” হবো, আমরা থেকে একদিন “আমার সবাই” হবো। আর এই সম্মিলিত “আমরা সবাই” মিলেই টিকিয়ে রাখবো দেশ, বাঁচিয়ে রাখবো আমাদের বাংলাদেশ।

আগের লেখাটার লিংক:

দেশীয় পোশাক শিল্পকে বাঁচানো প্রয়োজন (পর্ব -০১)

#Tania_Wahab

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.