নাসরীন মুস্তাফা:
করোনা অনেক কিছু চেনালো। খালা’কেও চিনলাম নতুন করে।
টিভিতে কেবলি লকডাউন ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি’দের ভিড়। ঘরে বসে তা-ই দেখি। লক খুলে ফেলাদের চাবিওয়ালা বলা যায়। পুলিশ চাবিওয়ালাদের আটকাচ্ছে। নির্বিকার মুখে একজন বাইরে আসার কারণ বললেন। তার খালা অসুস্থ, খালাকে দেখতে ভাগনেকে যেতেই হবে। পরবর্তী চাবিওয়ালাকে আটকালেন পুলিশ ভাই। কেন বের হয়েছেন, এই প্রশ্নে তিনিও দেখি বললেন, খালা অসুস্থ।
যে সাংবাদিক রিপোর্ট করছিলেন, তিনিও কৌতুহলি হয়ে উঠলেন। কয়েকজনকে থামিয়ে জানতে চাইলেন, কেন বের হলেন? এদের সবার খালা অসুস্থ।
মোরাল অব দ্য স্টোরির মতো করে ‘খালা’ প্রসঙ্গের উপসংহার টানলেন পুলিশ আর সাংবাদিক। বাবা-মা অসুস্থ, এ কথা বলতে বুক কাঁপে। বাবা-মা’কে ভালবাসে বাঙালি, মিথ্যে করে অসুস্থ বানালে আল্লাহ যদি তাদেরকে সত্যি সত্যি অসুস্থ করে দেন! এই ভয়ে ‘খালা’র নাম নেয়। খালা অসুস্থ হলে হবে, সমস্যা নেই।
চমৎকার ভাবনা। করোনা না এলে এ অনুভূতির খোঁজ কি আমরা পেতাম?
টিভিতে ত্রানের আশায় হাত পাতা মানুষদেরও মুখে মাস্ক বলে চেহারা পুরোটা দেখতে পাই না। তবে মাথার চুলে পাক ধরা কোন বয়সী নারীকে দেখলে আমার কিন্তু খালা’র কথা মনে পড়ে। ঘরের কাজে সাহায্যকারী খালা আমার এরকম বয়সেরই। স্বামী নেই। রেখা, রেনু, রিপা ’র মা। ওরাও গৃহকর্মি।
রেনুর স্বামী মাতাল হয়ে প্রায়ই পিটিয়ে আহত করে আর খালা এসে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে সাক্ষী রেখে আল্লাহর কাছে বিচার দেন। বাড়ির পাশেই থানা, মহিলা অধিদপ্তর, হাতের কাছে ‘৯৯৯’। কতবার বলেছি, আল্লাহর বান্দাদের ব্যবস্থাপনা ভালো। রেনুকে বিচার পেতে সাহায্য করার প্রস্তাব দিতেই খালা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাবানা সিনড্রোমের প্রকাশ ঘটিয়ে বলেছেন, হাজার হইলেও স্বামী। আল্লাহরে ডাকলে হ্যার মন ফিরবোই।
রিপা স্বামীহারা বলে তার সাথেই বাস করেন খালা। বাসা ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। বিছানায় রিপা আর ওর দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খালা ঘুমান। মেঝেটা ভাড়া দিয়েছেন দুই হাজার টাকায়। প্রতি মাসে গ্রামে যেতে হ’ত নিজের ও রিপার নামে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা তুলতে।
গত ডিসেম্বরে এক টুকরো জমির বায়না দিতে গেলেন। শেষ বয়সে ওখানেই ঠাঁই নেওয়ার আশায় ধারদেনা করে, বেতনের টাকা জমিয়ে আর বাসাবাড়ির খালাম্মাদের কাছ থেকে যাকাতের টাকা নিয়ে জমির স্বপ্ন সফল করতে চেয়েছিলেন। নারী ক্ষমতায়নের উদাহরণ হিসেবে বিষয়টি আমাকে তৃপ্তি দিত।
মার্চ মাসে করোনা যখন হানা দিল, তখন খালা গ্রামে। ফিরে আসার পর মাসের বেতন দিয়ে বলেছিলাম, আসতে হবে না। বলেছিলাম ঘরে থাকতে, কোন সমস্যা হলে জানাতে। মাথার দিব্যি দিয়ে ঘরেই থাকবে বলে গেলেও দু’দিন পরে আবার গ্রামে চলে যায়। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ‘ইলিপ’ দিতাছে, খালা নারী ক্ষমতায়নের তৃপ্তি মুছে দিয়ে আবারও পথের মানুষ হয়ে উঠছে কিনা ভেবে চিন্তায় পড়ি।
একই রকম ভাবনা করি শ্বশুরের গ্রামের সুফি খালা’কে নিয়ে। ছোটবেলা থেকে এই পরিবারের মা-বউদের ফুটফরমাশ খাটতেন। বাড়িতে এখন কেউ লম্বা সময়ের জন্য থাকে না বলে বিধবা সুফি খালা রান্নার কাজ করেন। নিজের বিধবা মেয়ে ও শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত নাতিকে কষ্ট দিতে নারাজ। করোনা লকডাউনে রান্নার কাজ বন্ধ। সুফি খালা হাত পাতেন।
এরকম খালাদের জন্য চাল-ডাল-আলু-তেল-লবন-পেঁয়াজের ব্যবস্থা অনেকেই করছেন, আমরাও চেষ্টা করলাম কিছু কিছু। তখন খেয়াল করলাম, নারী উপার্জন করছে বটে, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হলেও টেকসই নয় ব্যাপারটা। কাজ নেই বলে আয় নেই। তাতেই এক সপ্তাহে ক্ষমতায়নের প্রাসাদ তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে গেল কেন?
খালা বাসাবাড়িতে কাজ করে যা আয় করতেন, তা দিয়ে মাস চালাতেন। জমানো টাকা জমির পেছনে ঢেলে ফেলায় কোন অবশিষ্ট থাকেনি। বড় মেয়ে রেখা আর ওর স্বামী দু’জনেই আয় করছিল। তাদেরও টানাপোড়েন, কেননা হাত খালি। টাকা জমানোর ফুরসত হয়নি। ছেলেমেয়ের পড়ালেখা, খাওয়া দাওয়া হ্যানো ত্যানো। রেনুর মাতাল স্বামী জমানো টাকা নিয়ে যেত। আর রিপা তো একলার আয়ে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে হবে ভেবে জমানোর চিন্তাই করেনি।
গড়পড়তা পাঁচ বাসায় কাজ করে মাসে বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকার আয় ছিলো এদের। কোনভাবেই কি সামান্য করে করে অর্থ জমানো যেত না? ভাবি আমি। যে জীবন দোয়েলের, ফড়িঙের বা খালা’দের মতো খেটে খাওয়া মানুষের, তার বাস্তবতা হয়তো বুঝতে পারি না আমি।
মন মানে না। ছোটবেলা থেকে শুনেছি, ভাত রান্নার সময় এক মুঠো চাল তুলে রাখতে হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বেসিক শিক্ষা হিসেবে চিরায়ত বাংলার মায়েরা এই কাজটি করেছেন। এখন কি করেন না?
সুফি খালা’কে আমার শ্বাশুড়ি মা উপদেশ দিচ্ছিলেন, ভাতের ফেনাও ফেলা যাবে না। উঠোন থেকে পুঁই শাক দু’টো ছিঁড়ে ডালের ভেতর দেয়া যায়। মুরগি কি ডিম পাড়ে না? ডিম ভর্তা করে নিলে গরম ভাতে আর কী লাগে? পুষ্টির অভাবও দূর হয়।
টেলিফোনের ওপাশে থাকা সুফি খালার কথা তেঁতো মুখে শুনছেন মা। ঘরের কোণায় শাকসবজি করার কষ্ট এখন আর গ্রামের মানুষরা করেন না। মুরগি পালায় ঝামেলা। এসব করলে মানুষ নাকি চাষা বলে হাসে।
গ্রামে গেলে পাড়াতো খালারা এখন নুডুলস দিয়ে আপ্যায়ন করেন, মনে পড়ে। উঠোনের লেবু গাছ থেকে লেবু পেড়ে শরবত বানিয়ে অতিথি আপ্যায়ন এখন আর হয় না। করোনা ঠেকাতে ভিটামিন সি নাকি খুব কাজের। উঠোনের লেবু গাছ কি সেই কাজটি করতে পারতো না? বাজারে নাকি লেবুর দামে আপেল মিলছে, এমন খবরও চোখে পড়েছে।
টিভিতে পাকা চুলের মানুষ দেখলেই আঁতকে উঠছি। ‘খালা’রা ভিখারি হবে, এ আমি দেখতে চাই না। পরিশ্রমী মানুষগুলোর চেতনায় এই দুর্যোগ ভাবনার জন্ম দিক্। ফুটানি মারা বা জাতে ওঠার ইচ্ছেকে পথে ফেলে এসে ‘খালা’রা আবার টেকসই উপায়ে ক্ষমতায়িত হবেন।
কেবল খালাদের কথাই বা কেন বলছি? মধ্যবিত্ত সংসারেও দুর্যোগ খাতে সঞ্চয়ের অভ্যেস থাক্ এভাবে, সঞ্চয়ের বাজেট ঠিক করে তবেই খরচের হিসাব করতে হবে। বিন্দু বিন্দু সঞ্চয়ে এক সময় যে ‘ভাণ্ডার’ গড়ে ওঠে, তা দিয়ে দুর্যোগের প্রাথমিক ধাক্কা সামলানোর কাজটা সহজ হয়, তাই না?