বিবাহিত জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দোলাচল

প্রিয়াঙ্কা দাস মিলা:

আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সত্যি বলতে কী, এমন একটা সময়ে বিয়ে হয়েছে বা বিয়ে করেছি, যে সময়টাতে আসলে আমি বুঝতামই না দায়িত্ব কী জিনিস! অনার্স প্রথম বর্ষে মাত্র ভর্তি হয়েছি। টগবগে যৌবন কেবল ছুঁই ছুঁই করছে, কৈশোরের গন্ধ পুরোপুরি যায়নি। তখনও ক্লাসে যাওয়ার আগে মা ভাত মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। গ্রুপের প্রথম বান্ধবীর বিয়ে হলো। কলেজে এসে খুব রোমান্সের গল্প শুনতাম, শরীরী প্রেমের গল্প শুনতাম, আর শিহরিত হতাম!! ঐ বয়সে যা হয় আর কী! নিষিদ্ধ জীবনের আকর্ষণ। অস্বীকার করবো না শুনতে ভালোই লাগতো!! ভাবতাম, প্রেম তো আর হলো না, বিয়ের পর বরের সাথেই চুটিয়ে রোমান্স আর প্রেম করবো!

বিয়ে হয়ে গেল! সে কী উথাল-পাথাল শরীরের খেলা!! শুধু সুযোগ খুঁজতাম একসাথে হওয়ার জন্য। এমনও হয়েছে বাড়িওয়ালা এসে মায়ের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলে যেতো। মা বলতো, “তোরা রাতবিরাতে ঝগড়া কম কর, আর আওয়াজ করিস কেন ঝগড়ার সময়”!

আমি বেকুব মাথা চুলকাতাম, আর ভাবতাম, ঝগড়া কখন করলাম! আমার বরটি প্রচুর ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড ছেলে। কিন্তু বাজার (মাছ- মুরগি, শাক-সবজি) করতে ভীষণ পছন্দ করে। আমার এগুলো নিয়ে মাথা ব্যথা নাই। আমি খাই দাই, বান্ধবীদের সাথে চিল করি, আর সুযোগ পেলেই দুজন দুজনায় মিশে যাই। অসাম লাইফ। বিয়ের মাত্র তিনমাসের মধ্যে প্রেগন্যান্ট হলাম। সুস্থ আর হৃষ্টপুষ্ট একটা বাচ্চার জন্ম দিলাম। বাচ্চাকে মায়ের জিম্মায় ফেলে রেখে কলেজ, ক্লাস, বান্ধবী, আড্ডা। এটাই লাইফ তখন আমার কাছে। আবার বিন্দাস। দায়িত্ব নিতে কিন্তু হয়নি। বাচ্চার দায়িত্ব মায়ের আর সংসারের দায়িত্ব স্বামীর। শখ করে যে যাইনি, তা কিন্তু না। গিয়েছি। তখন কিন্তু কেউই শেখায়নি কীভাবে দায়িত্ব নিতে হয়। ঝগড়াও খুব একটা হতো না।

মা বলতো,”ঠ্যাকায় পড়লে এমনিতেই শিখে যাবা।” বরও কখনও শেখানোর চেষ্টা করেনি। এমনি, সংসার কীভাবে চলে, কত টাকা লাগে, কোন কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়….. এসবের কিছুই জানতাম না, জানার চেষ্টা করলে বর বলতো, “তোমার হাতে টাকা দিলে ওই মাসে না খেয়ে থাকতে হবে। কীভাবে কী চলে কিছু তো টের পাও না”, আমি খুব অভিমান করতাম, সে বুঝতোই না। যখন এসে গায়ে হাত দিতো, গলে যেতাম। কীভাবে কীভাবে দিন গেল বুঝলামই না। মা চলে গেলেন। বরের সাথে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরিও হলো না। রোমান্সও হলো না। যেটি হতো সেটি শুধু শরীরের চাহিদা পূরণ ছাড়া আর কিছু না। মনের খোঁজ তখনও নিতে শিখিনি। বান্ধবীরাই সব। ঐ যে মনের মানুষ সিনেমায় একটা ডায়ালগ ছিলো না, “শরীর জাগে শরীরের তাড়নায়! মন জাগে না যে!”

চাকরিতে জয়েন করলাম। অন্যান্য অবিবাহিত মেয়ে কলিগদের কাছে শুনলাম তাদের স্বাধীনতার কথা। তাদের ডেটিং, ঘুরাঘুরি। আস্তে আস্তে মাথায় ঢুকলো, তাইতো, আমি তো যাইনি। আহারে জীবন, আহা জীবন! অন্যের ঘুরাঘুরির ছবি দেখতাম, গল্প শুনতাম। খারাপ লাগা শুরু করলো। “এক্সপেকটেশন” বাড়তে লাগলো। ঝগড়া বাড়তে লাগলো। এর মধ্যে আরেকটা বাচ্চা হলো। মাও নাই। আস্তে আস্তে দায়িত্ব বাড়তে লাগলো। চাইতাম বর আমাকে সময় দিক, প্রশংসা করুক, আমার কষ্ট বুঝুক। আমি তাকে কতটুকু বুঝতাম জানি না, চাইতাম সে বুঝুক। অন্যদের স্বামীদের মতো সকালে দুপুরে কল দিয়ে জানতে চাইবে “কী করি, খেয়েছি কিনা”, মাঝে মাঝে কিছু নিয়ে এসে সারপ্রাইজ দিবে। স্বামী আমার ঘর আর বাচ্চা সামলাতে সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। রোমান্স করার সময় কই তাঁর? তারপরও চেষ্টা করতো।

বড় ঝড়টা আসলো, ছোট বাচ্চাটা পেটে আসার পর। আগেই দুই বাচ্চা, সাথে আমার বাবা আর বোনও থাকে। বাঁধা কাজের মানুষ নাই। বোন সকাল ১১/১২ টায় ঘুম থেকে উঠতো। সকালে রান্নাবান্না করে রেখে যেতাম, রাতে এসে আবার রান্না। বাচ্চাদের খাওয়ানো, প্রেগন্যান্সি সময়ের ধকল, সংসারের কাজ কর্ম, অফিসের হ্যাপা, ঘুমের অসুবিধা, জামাইয়ের সাথে খিটমিট, বোনের আক্কেলহীনতা, সব মিলিয়ে দম বের হয়ে যেতো। সমস্ত রাগ যেয়ে পড়তো বরটির ওপর, আর বর দোষ দিত পেটের বাচ্চাটার। মাথাটা আরও খারাপ হয়ে যেতো। গত ৫ টা বছর কী যে গেছে বাচ্চাগুলার উপর দিয়ে বলে বোঝানো যাবে না।

তবে কি ঝড়ও সবসময় থাকে না, শান্ত তো হয়ই। কিন্তু নিজেদের সময়টা কীভাবে ফুরুৎ করে উড়ে গেলো টেরই পেলাম না। কোথায় সেই রোমান্স! কোথায় সেই শরীরের আকর্ষণ!
আমি ভালো আছি, ভীষণ ভালো আছি। বর হলো কাদা মাটির মতো, যাতে পা আটকে রাখা যায় বা খুঁটির মতো, শক্ত করে ধরে রাখলে সেই অবলম্বন।

আসলে চাওয়া পাওয়ার হিসেব করতে গেলেই ঝামেলা…. একজীবনে তো সব পাওয়া সম্ভব না। আমাদের সমস্যা হলো আমরা বাচ্চাদের ছোট থেকেই শক্ত হতে শেখাই না, কলেজে পড়ুয়া একটা মেয়েকে ভাত খাইয়ে দিয়ে আমরা তাকে ননীর পুতুল বানিয়ে রাখি। যখন দায়িত্ব আসে, তার জন্য আমরা প্রস্তুত থাকি না। নড়বড়ে হয়ে যাই, অন্যের লাথি ওষ্ঠা খেয়ে তারপর আমরা জীবনে চলতে শিখি।

জীবনের প্রথম ৪০/৪৫ বছর পর্যন্ত স্বামীরা বউদের মর্ম বোঝে না। কারণ ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নির্ভরশীল থাকে তাদের ইগোর উপর। তাদের শিশ্নের ক্ষমতার উপর। আস্তে আস্তে তাদের শিশ্নের ক্ষমতার স্থায়িত্ব বাড়ে আর মনের খোড়াক দরকার হয়, যেটা তারা তাদের বউদের কাছে খুঁজতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে আমাদের মনটা ভেঙে চুড়ে একটা পাথর হয়ে যায়। সে মেনে নেয় এটাই তার নিয়তি। বাকি সমাজ, বাচ্চা, ভালোবাসা নামক অভ্যাস, অনুভূতি, লাইফ স্টাইল, সর্বোপরি মরার “দায়িত্ব” তাকে আঁকড়ে ধরে, পেঁচিয়ে ধরে যেখান থেকে চাইলেই বের হওয়ার উপায় থাকে না।

আমরা আসলে বুঝতেই পারি না, সব হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে ফেলছি যেগুলো চাইলেই আমরা আর ফেরত আনতে পারবো না। আমি অনলাইন শপিং এর উপর বেশ নির্ভরশীল। প্রায়ই আমার কলিগের থেকে টাকা ধার নিই, ড্রেস কিনি টাকা শর্ট থাকলে। তো প্রথম প্রথম টাকা ধার চাইতে আনইজি লাগলে, আপা (কলিগ) টাকা নিজে থেকে দিয়ে বলতেন, “যা শখ মিটানোর মিটিয়ে নাও, দুইদিন পর তাও থাকবে না”। ভেবে দেখলাম আপাতো সত্যি-ই বলেছেন, এখন আর শরীর এর চাহিদা নেই, রোমান্স করতে চাই না, চলে যাচ্ছে জীবন জীবনের নিয়মে।

আহা জীবন, আহারে জীবন, জলে ভাসা পদ্ম যেমন….

প্রিয়াঙ্কা দাস মিলা
ব্যাংকার
০৭.০৫.২০২০

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.