সুপ্রীতি ধর:
ফেসবুকের টাইমলাইন স্ক্রল করতে গিয়ে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল। একজন নারী উপুড় হয়ে পড়ে আছে ঘাসের ওপরে, গলার পিছন দিয়ে রক্তের একটি ক্ষীণ ধারা নিচে নেমে গেছে, বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটিকে মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলা হয়েছে। মারা যাবার পরও ওর মুখে ছিল একটি মাস্ক, সেটি একপাশে সরে আছে। করোনার সময়ে ওই মাস্কটিই একটা বার্তা দিয়ে যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক হিসেবে হরহামেশাই, এমনকি এর চাইতে অনেক ভয়াবহ দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত আমরা। কতো পাশবিকভাবে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারে, তা আমাদের চাইতে ভালো কে জানে! কিন্তু কোথায় যেন কী একটা ক্লিক করে উঠলো মাথায়।
মেয়েটির মুখে মাস্ক, এই করোনার সময়ে সে অদৃশ্য ভাইরাসটি থেকে বাঁচতে মাস্ক এর আশ্রয় নিয়েছিল। করোনা তাই হয়তো তাকে ছুতেঁ পারেনি। কিন্তু যে ভাইরাসটিকে দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের ভয় আজন্মের, সেই ভাইরাসটিকে ভুল করে আপাতত নিরাপদ ভেবেছিল হয়তো মেয়েটি। কিন্তু দুর্যোগ হোক বা মহামারীই হোক, একটিমাত্র ভাইরাস সবসময় সজাগ থাকে, কোনকিছুতেই যাকে আটকানো যায় না, সেই ভাইরাসটি ধর্ষক পুরুষ ভাইরাস বা নির্যাতক পুরুষ ভাইরাস। কোনো আবরণই যে ভাইরাস থেকে মেয়েদের রক্ষা করে না। তা মেয়েরা হিজাবই পরুক, বা স্বল্পবসনাই হোক। নারী তো নারীই, তার শরীর আছে, যোনি আছে, স্তন আছে। নির্যাতক বা ধর্ষক পুরুষের আর কিছু তো প্রয়োজন পড়ে না। সেই মেয়েটি বয়সে পাঁচ বছর বা সাড়ে তিন বছর হোক, কিশোরী, তরুণী, মধ্যবয়সী, এমনকি প্রৌঢ়া হোক, কেউ ছাড় পায় না এদের হাত থেকে।
তাই যথেষ্ট ‘শালীন’ পোশাক এবং মাস্ক পরেও রক্ষা পায়নি মেয়েটি,তাকে ছুঁয়ে গেছে আরও ভয়ংকরভাবে। পাশবিকভাবে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে গেছে একদল পুরুষ।
এটি মাত্র একটি ঘটনা। এই লকডাউনের সময়টাতে বিশ্বজুড়েই পারিবারিক সহিংসতা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। ইউএন উইমেন এর সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, কোভিড-১৯ এর বিস্তারের পর থেকে বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা অতীতের যেকোনো রেকর্ডকে হার মানিয়েছে।
বিশ্ব যখন লড়াই করছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ভাইরাসের অস্তিত্ব নির্মূলে, সেই তখনই মানব জনগোষ্ঠীর একটা অংশ লড়াই করতে বাধ্য হচ্ছে আরেকটি অংশের সাথে। শেষোক্ত লড়াইটি দৃশ্যমান হলেও দুটো লড়াই-ই সত্য। কথা থাকে যে, হয়তো বিশ্ব ক্ষুদ্র ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে একসময় মুক্তি পাবে, কিন্তু আদৌ মুক্তি কি মিলবে অপরটি থেকে?
ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য, চীন, তাইওয়ান, ভারত, বাংলাদেশ, সব জায়গা থেকেই একের পর এক ভয়াবহ খবর উঠে আসছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বলা হচ্ছে, অনেক দম্পতিই সন্তানের কথা ভেবে এতোদিন একই ছাদের নিচে বসবাস করে আসছিলেন। যে যার মতোন কাজে ব্যস্ত থাকায়, ছেলেমেয়েরাও স্কুল-কলেজে থাকায় সহিংসতাটা এতোদিন প্রকাশ পায়নি। কিন্তু এখন লকডাউনে সবাই সবার মুখোমুখি হয়ে পড়েছে, ২৪ ঘন্টা একই সাথে থাকতে গিয়ে ঝগড়া, মারামারি, এমনকি খুনোখুনিও ঘটে যাচ্ছে।
এছাড়াও একটি ঘটনা ঘটছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ঘর-গৃহস্থালী কাজগুলো একমাত্র নারীর কাজ বলে বিবেচিত হওয়ায় এই সংকটের সময় পুরো পরিবারের দায়িত্ব এসে একা নারীর ওপর পড়েছে। সেখানে পান থেকে চুন খসার জো নেই। উপরন্তু সেই নারী যদি হয় চাকরিজীবী, তাকে গৃহস্থালী সব কাজের পাশাপাশি অনলাইনে চাকরিটিও করতে হচ্ছে। নি:শ্বাস ফেলারও সময় পাচ্ছে না সে। এতে করে মানসিক ও শারীরিক, উভয়দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেইসব নারীদের জীবন।
অস্ট্রেলিয়ার একটি সংস্থার জরিপ বলছে, তাদের শতকরা ৪০ ভাগ ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারের কাছে মেয়েরা অভিযোগ করেছে, সহায়তা চেয়েছে, তারা বলছে, আগের তুলনায় নির্যাতনের ধরন এবং ভয়াবহতা বেড়েছে।
সেদিক থেকে ভৌগলিকভাবে খুবই নাজুক অবস্থান বাংলাদেশের। ছোট এক টুকরা দেশের জনসংখ্যা সব ধারণার ঊর্ধ্বে এখন। প্রায়ই ভাবি যে এতো এতো জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানালেও কেউই এগিয়ে আসবে না। একে তো বিপুল জনসংখ্যা, তার ওপর অশিক্ষা-কুশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামি বা অন্ধত্ব দেশটিকে ক্রমাগতই পিছনে টানছে।
একাত্তরে দেশ স্বাধীনের পর থেকে গত ৪৯ বছরে আমাদের যতোটা অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল সংবিধানের আলোকে, বার বার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, রাজনৈতিক হত্যা, ধর্মীয় অপসংস্কৃতির উত্থান বাংলা ও বাঙালীকে ততোটাই অনগ্রসর করে দিয়েছে। ফলে আমাদের অর্জন এবং ব্যর্থতার মধ্যে ফারাকটা বিস্তর।
আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য আর সীমাহীন অরাজকতা, বিচারহীনতা দেশকে এমনিতেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিচারহীনতা দেশটিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে একজন স্বামী ফেসবুক লাইভে এসে স্ত্রীকে খুন করার সাহস পর্যন্ত করছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোন নারী নির্যাতনের ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় সেই মাত্রা দ্বিগুণ, চতুর্গুণ আকারে বাড়ছে। কোভিড-১৯ এর আশংকা থেকে মুক্ত হতে যে ঘরকে আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণ করতে বলা হচ্ছে সবাইকে, সেই হয়ে উঠছে অধিকাংশ নারীর জন্য অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পুরো বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন তার স্বামী ও তার পরিবারের সদস্য দ্বারা শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতনের শিকার। সারাবছর যে শঙ্কায় নারীর জীবন কাটে, এই বুঝি তাকে ঘরছাড়া হতে হবে, এবং শুধুমাত্র এই ঘরটিই রক্ষা করার জন্য নারীটি আমৃত্যু মেনে নেয় সব ধরনের বৈষম্য, নির্মমতা, আজ বাগে পেয়ে পুরুষ নারীকে হারে হারে বুঝিয়ে দিচ্ছে এই ঘর পুরুষের। পুরুষ যখন ইচ্ছা, যেভাবে খুশি নারীকে ঘরহীন-আশ্রয়হীন করতে পারে। এবং করছেও। অনেক ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কোথাও যেতে পারবে না বলে মুখ বুঁজে মেনে নিচ্ছে সব নির্যাতন।
সেদিনই পড়লাম একজনের লেখায় যে, তিন বছরের এক সন্তানের মাকে রাতের বেলা মেরে রক্তাক্ত করে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের ঘটনা। মেয়েটি সেই মধ্যরাতেই রিকশায় করে যাচ্ছে বাবার বাড়ি মিরপুরের কাজীপাড়ায়। যদিও আমরা এই ঘটনার পরবর্তি অধ্যায়টা জানি না। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাবা-মা মেয়েটিকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে, মেনে নেয়া এবং মানিয়ে নেয়ার ছবক দিয়ে উল্টা ফেরত পাঠাবে। কারণ মেয়েটির দায়িত্ব আর কোনপক্ষই নিতে রাজী হয় না এসব ক্ষেত্রে। মেয়েটির যদি আর্থিক সাপোর্ট যথেষ্ট থাকে, সেইক্ষেত্রে নির্যাতন থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব। যদিও সামাজিক নির্যাতন বলেও আরেকটি বিষয় বিদ্যমান আমাদের সমাজে। এ এক ভয়াবহ সংসার চক্র। একে ছিন্ন করা অনেক কঠিন হয়, সবাই তা পারেও না।
গবেষকরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে এই মহামারীর কারণে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে, তা পরিবারের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। আর এর ফলে নির্যাতনের তীব্রতা বেড়েছে। সেইসাথে বাড়ছে মানসিক সমস্যাও। এর শিকার হচ্ছে পরিবারের শিশু সন্তানটির ওপরও। তারাও মা-বাবার নৈমিত্তিক কলহের কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে।
গবেষকরা এটাও আশংকা করছেন যে, করোনা সংকট কেটে গেলে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন মুখ থুবড়ে পড়বে, তেমনি পরিবারগুলোও ভেঙে পড়বে। ডিভোর্সের হার বাড়বে। আত্মহত্যার হার বাড়বে। হত্যা, নির্যাতন তো আছেই। ফলে একটা ভয়াবহ ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে সবখানেই।
এদিকটাতে নজর দেয়ার জন্য বিশ্বের বড় বড় সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সংকট মোকাবিলায় হয়তো বিশ্বব্যাপী অনেক প্রকল্পে কাটছাঁট শুরু হবে, কিন্তু পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টি যেন গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়। দ্রুততার সাথে এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন দক্ষ লোকবল তৈরি রাখা এবং ইমারজেন্সি শেল্টার হোম প্রতিষ্ঠা করা।
নিজের দেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবারও। একটি সিস্টেমলস এবং ততোধিক দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশের প্রতিটা সেক্টরই যখন করোনা সংকটে বিপর্যস্ত, তখন নারী নির্যাতন রোধে সরকার কতোটা আন্তরিক হবে, আন্তরিক হলেই কতোটা কার্যকর হবে তাদের গৃহীত পদক্ষেপ, এসব নানান ভাবনা স্বস্তি দেয় না মোটেও।
লেখাটি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘বাঙালী’ সাপ্তাহিক এ প্রথম প্রকাশ পেয়েছে। ধন্যবাদ বাঙালী’কে।