‘আম্মার মুখটা আবার দেখতে চাই’

রেহনুমা কাদীর:

প্রায় পনেরো বছর পর আজ আমি আম্মার সাথে দেখা করতে যাবো। সেই হিসাবে আমার অনেক খুশি হওয়া উচিৎ। কিন্তু ভেতরে যে অনুভূতিটা চলছে সেটাকে ঠিক খুশি বলা চলে না। বুকের ভেতরটা পাথরের মতো ভারী লাগছে, ওঠার শক্তিও পাচ্ছি না। তবুও কোনরকমে জামা পরে চুলটা আঁচড়ে ড্রইংরুমে এলাম। আব্বাও তৈরি হয়ে বসে আছে। আব্বাই আজকে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। সে কী মনে করে রাজি হলো জানি না। তার মনে কী চলছে সেটাও আমার খুবই জানতে ইচ্ছে করছে। কারণ ডিভোর্সের পর তারও তো আম্মার সাথে এই প্রথম দেখা হবে।

কিন্তু পুরোটা রাস্তা আমি আর আব্বা কেউই কোনো কথা বললাম না। পথে যেতে যেতে অনেক কথাই আমার মনে পড়লো। আমি আট বছরের ছিলাম, যখন আব্বা আম্মার ছাড়াছাড়ি হয়। এতোকিছু মনে থাকার কথা না। যেটুকু আছে তার বেশিরভাগই খুব বিষাক্ত। আব্বা-আম্মা অকথ্য ভাষায় একজন আরেকজনকে গালাগালি করছে। জিনিসপত্র ভাংচুর করছে, আর ছোট্ট আমি ভয়ে স্টোর রুমের অন্ধকারে দু হাত দিয়ে কান চেপে বসে আছি।

কিছু অদ্ভুত সুন্দর স্মৃতির আবছা ছবিও দেখতে পাই মাঝে মাঝে। আমি আর আম্মা প্রায়ই লুকোচুরি খেলতাম। আমি যখন জানলার পর্দার পেছনে লুকিয়ে পরতাম, আম্মার পর্দার নিচে আমার ছোট্ট পা দুটো দেখেও না দেখার ভান করে বলতো, “কই গেল আমার ময়না পাখিটা? আমি তো খুঁজেই পাচ্ছি না!” আর আমি হঠাৎ করে পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বলতাম, “এই যে আমি এখানে!” আমি যখন খেতে চাইতাম না আম্মা ভাতের থালা নিয়ে সারা বাড়ি আমার পেছন পেছন ছুটতো। আর ঘুম পাড়ানোর সময় খুব সুর করে “লাল পরী নীল পরী” গানটা গাইতো। যেই গানের সুর এখনো আমার কানে এলোমেলো ঘোরাফেরা করে।

সবকিছুই সুন্দর ছিল, ভীষণ রকম সুন্দর। কিন্তু একদিন সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। আব্বার ব্যবসায় বিশাল বড় একটা লস গেল। তাই তার মেজাজ প্রচণ্ড খিটখিটে হয়ে গেল। শুরুতে আম্মার সাথে ছোটো ছোটো মনোমালিন্য, তারপর ভয়ানক ঝগড়া আর মারামারি! তার উপর আম্মার অসুখ। হ্যাঁ, এইসব কিছুর মাঝে হঠাৎ আম্মা কেমন বদলে গেল। কেন জানি সে ভাবতে শুরু করলো, সবাই তাকে খুন করতে চায়। সবাইকে সন্দেহ করতো। কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিত না। এমনকি একদিন সে আমার দিকেও একটা কাঁচের বাটি ছুঁড়ে মেরেছিল। কপাল কেটে প্রচুর রক্ত ঝরেছিল সেদিন। চারটে সেলাইও লেগেছিল। বড় হয়ে আমি জানতে পারি আম্মার এই অসুখটার নাম ছিল, “স্কিজোফ্রেনিয়া”। সেদিনের পর আব্বা অনেক ভয়ে পেয়ে গেল। ‘পাগল’ বউ এর সাথে ধৈর্য্য নিয়ে ঘর করবে এতোটা উদার আমার আব্বা ছিল না। সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আম্মাকে তালাক দিয়ে দিল!

তারপর একদিন মামা আর নানু বাসায় এলো আম্মাকে নিতে। আম্মা কিছুতেই যেতে চাচ্ছিল না। আমাকে শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলছিল, “আমি যাবো না, আমার মেয়েকে রেখে আমি যাবো না!” আব্বা রীতিমতো যুদ্ধ করে তার বুক থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসলো। নানু আর মামা জোর করে তাকে টেনে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় সে বার বার চোখভর্তি জল নিয়ে আমার দিকে পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। এরপর আম্মার সাথে আর আমার কখনও দেখা হয়নি। মামারা কেউ যোগাযোগ করতে চাইলেও আব্বা দিত না।

বছর না ঘুরতেই ঘরে নতুন মানুষ এলো। যাকে ঠোঁটে আম্মা ডেকেছি। অন্তরে ডাকা হয়নি আজও! যাই হোক এতো বছর পর নিজের আম্মার সাথে আজ আবার আমার দেখা হবে। এবার আব্বাই আমাকে আগ বাড়িয়ে নিয়ে এলো। আমি তার চেহারায় গাঢ় একটা অপরাধবোধ এর ছায়া দেখতে পেলাম। হয়তো সে অনুতপ্ত, এতো বছর একটা সন্তানকে তার মা থেকে দূরে রাখার জন্য!

গেটে কড়া নাড়তেই এক ভদ্রলোক দরজা খুললো। আমাকে কেউ বলে দেয়নি তবে আমি বুঝলাম, এই ব্যক্তি আমার তিন মামার একজন হবে। অশ্রুসজল চোখে সে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, “তুমি আসছো মামণি? তোমার আম্মা তোমার জন্য কত্ত অপেক্ষা করছে! আসো ভিতরে আসো।” গেট পেরিয়ে উঠোনের দিকে আসতেই অনেক মানুষের জটলা। কান্নার রোল আর আগরবাতির গন্ধে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। লাশের কাছে বসে কিছু নারী কোরান পড়ছিল।
মামা তাদের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপা, এরে একটু বসতে দেন, এ কনকের মেয়ে’! উপস্থিত নারীরা সাথে সাথে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো। একজন আমাকে একটা চেয়ার টেনে বসতে দিল, আর লাশের মুখের কাপড়টা সরিয়ে দিল। আমার আম্মা ঘুমাচ্ছে। কী সুন্দর শিশুর মতো নিষ্পাপ এই ঘুমন্ত মুখ। চোখ ফিরিয়ে নেয়া যায় না কিছুতেই।

আমার বুকটা ফেটে যায়। মনে হয় আর একবার যদি আম্মার সাথে একটু কথা বলতে পারতাম! আহারে, আমার আম্মা! আহারে! ওই নারী দ্রুতই আবার লাশের মুখে কাপড় উঠিয়ে দিলেন। আমি চোখে জমে থাকা জলটা মুছে নিয়ে বললাম, “কাপড়টা একটু সরায় দ্যান, আমি আমার আম্মার চেহারাটা আরেকবার দেখতে চাই!”

লেখা: রেহনুমা কাদীর
#মন_মৃদঙ্গ

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.