সোমা দত্ত:
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রশমনে ক্রমাগত লকডাউন চলছে। অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এরই মধ্যে। বিশ্বজুড়ে তৈরি হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দা। প্রতিদিন কর্মহীন হয়ে পড়ছে হাজার হাজার খেটে খাওয়া মানুষ।
কর্মসংস্থানের ঘাটতি, আয়ের অপ্রতুলতা, সামাজিক সেবার অনুপস্থিতি ইত্যাদি চরম আকার ধারণ করছে। তবে যে সমস্যা সবচেয়ে প্রকটা বলে আবির্ভূত হয়েছে, তা হচ্ছে খাদ্য সঙ্কট। আমি যেখানটায় থাকি – সেখানের একটি মাঠে ভোর হতে না হতেই চলে আসে একদল নারী পুরুষ। বসে বসে প্রহর গোনেন কোন সহৃদয় ব্যক্তির খাবার নিয়ে আসবার। একদিন একটি পুলিশের ভ্যান আসে। আমি একটু শংকিত হয়ে পড়লাম এটা ভেবে যে আজ এই বিপন্ন মানুষগুলোর ভাগ্যে না জানি কী দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করে আছে! হয়তো এখনই ওঠিয়ে নিয়ে যাবে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে!
ওই যে – সেই বাক প্রতিবন্ধী রিকশাচালকের গলা শোনা যাচ্ছে। দু’মুঠো খাবারের জন্য চিৎকার করে ডাকছে। তাঁর রিকশায় আজ কোন সোয়ারী নেই। কী করে খাবার তুলে দেবেন পরিবার পরিজনের মুখে। ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে আগেই ছোট দুধের শিশুকে কোলে নিয়ে আসেন আরও কয়েকজন নারী। তাঁদেরও একই দাবি- ‘খালাম্মা গো, একটু খাবার দেন। কুলের বাচ্চাটা আজ কয়দিন ধরে না খাওয়া’। তাঁদের প্রত্যেকের কাজ নেই, আয় নেই, সঞ্চয় নেই। ফলে ভীষণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা।
ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে যে, দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ বা ৫ কেটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। আগামীতে প্রায় ১ কোটি পরিবার খাদ্য সঙ্কটের শিকার হবে। এ পরিবারগুলোর জন্যে এক মাসের খাদ্য সুরক্ষার জন্যে ৬ হাজার কোটি লাগবে বলে ভাবা হয়েছে। সেই হিসেবে আগামী ছয় মাসের জন্যে লাগবে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। সরকার ইতোমধ্যে অর্থনৈতির প্রণোদনার জন্যে মোট ৭২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। আমাদের দাবি- এই মুহূর্তে ঐ বরাদ্দ থেকে এসব অনাহারী মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। পাশাপাশি এই পাঁচ কোটি মানুষের জন্য আগামী ছয় মাসের খাদ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হোক। এ নিয়ে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা কী ভাবছেন এটাও জানা প্রয়োজন। তাঁরাও সরকারের সাথে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারেন। আমরা আশা করছি তাঁরা সময় নষ্ট না করে যত দ্রুত সম্ভব সহযোগিতার হাত বাড়াবেন।
অস্থিরতা চলছে দেশের তৈরি পোশাক খাতে। সরকারের সাথে সমঝোতা করে মালিকপক্ষ কারখানা খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আবারো রাস্তায়, ফেরিঘাটে উপচে পড়া ভিড়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে, রিকশা চেপে, ভ্যানে করে, কেউ কেউ আবার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় ফিরছেন। তৈরি পোশাক খাতে নিয়োজিত মানুষগুলোর স্বাস্থ্য, আবাসন, জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনায় না এনে এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
এর আগেও একবার এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল গত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে। তখনও দলে দলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অমানুষিক কষ্ট করে ঢাকা এসে পৌঁছান তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা। কারণ তাঁরা জানতে পেরেছিলেন কারখানা খুলে যাবে, প্রত্যেকে উপস্থিত না হলে বেতন পাবেন না। আছে চাকুরি হারানোর ভয়।
এ খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে সারাদেশে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। আবার এসময়ই ঢাকা পুরোপুরি লকডাউন করে দেয়া হয়। ফলে এসব শ্রমিকদের কেউ কেউ কষ্ট করে বাড়ি ফিরে যান। আবার অনেকেই আটকা পড়েন শহরে। যারা আটকা পড়েন, তাঁদেরকে করোনার সম্ভাব্য সংক্রমণকারী ভেবে বাসা বাড়িতে হেনস্থা হতে হয়েছে। কেউ কেউ বেরিয়ে এসেছেন খোলা আকাশের নীচে।
তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায়- তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৪১ লাখ শ্রমিক কর্মরত। যাদের অধিকাংশ নারী শ্রমিক। দেশের ৮২ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয় এ খাত থেকে। জিডিপিতে পোশাক শিল্পের অবদান ১৩ শতাংশ। তাহলে যাদের শ্রমে-ঘামের বিনিময়ে টিকে আছে এ পোশাকশিল্প, তাদের অবহেলা করে কতখানি সামনে আগ্রসর হতে পারবে।
গত মার্চ মাসের শেষে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক ভিডিও বার্তায় আসেন। তাঁর কথা থেকে জানা যায়- করোনাকালীন বৈশ্বিক চাহিদা ও বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্রেতারা এদেশ থেকে ক্রয়াদেশ বাতিল করে দিচ্ছেন। এমন অবস্থা চলতে থাকলে তৈরি পোশাক শিল্পে ধস নামবে। এই মুহূর্তে সরকার যদি সাহায্যের হাত না বাড়ায় তাহলে থমকে যাবে এই শিল্পখাত। বেকার হয়ে পড়বেন হাজার হাজার মানুষ।
এর দুই একদিন পরেই জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। আমরা জানি না এই প্রণোদনা কতখানি সাধারণ শ্রমিকের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজে লাগবে।
কেননা এই চলমান করোনা সংকটের মধ্যেই দেশের ৫৫টি পোশাক কারখানায় প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। যেসব পোশাক শ্রমিকের চাকরির বয়স এক বছর বা তার কম, জোরপূর্বক তাঁদের চাকরি থেকে না করে দেওয়া হয়েছে।
গাজীপুরসহ নানান জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। ভালুকার একটি তৈরি পোশাক কারখানাতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদ ও বেতনের দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করতে গেলে মালিকপক্ষের হামলা ও ধাওয়ায় মহাসড়ক পার হয়ে পালানোর সময় ট্রাকের চাপায় দুই শ্রমিক নিহত হন। ওই ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যসহ কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছেন। সরকার কি এদিকটায় নজর দিবেন- না পুঁজিবাদী মালিকপক্ষের তেলে মাথায় তেল দিয়ে যাবেন সেটাই প্রশ্ন!
চলমান লকডাউন এ ভেঙে পড়েছে কৃষিজাত কাঁচা পণ্যের বিপণন ব্যবস্থা। পদকপ্রাপ্ত কৃষক তার উৎপাদিত টমেটো রাস্তায় ফেলে দিয়ে যাচ্ছেন। পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন উপজেলার কৃষকরা তাদের কষ্টার্জিত লাউ, বেগুন, করলাসহ বিভিন্ন সব্জি নামমাত্র মূল্যে ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করছেন। গত ২০ এপ্রিল তারিখ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায় পঞ্চগড় জেলার বটতলী গ্রামের জনৈক বেগুনচাষি জহিরুল ইসলাম তার খেতের ২২ বস্তা বেগুন ৫০০ টাকায়, বামনকুমার গ্রামের জনৈক মামুন লাউ প্রতি পিস ৩ টাকা দরে বিক্রি করেন। তারা জানান, স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকলে বেগুন কেজি প্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা আর লাউ ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারতেন। করোনা পরিস্থিতিতে যে দামে তারা সব্জি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন এতে তাঁদের শ্রমিকের খরচও পাচ্ছেন না।
অথচ ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরগুলোতে চড়া মূল্যে এসব সব্জি বিক্রি হচ্ছে। সরকার সদয় হলেই মাঠ প্রশাসন, সেনাবাহিনী কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে কৃষকের এসব পণ্য দেশের নানান প্রান্তে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে পারেন। ন্যায্য মূল্যের বাজার সৃষ্টি করে কৃষকের মুখে হাসি এনে দিতে পারেন। একই সাথে সচল রাখতে পারেন দেশের অর্থনীতির চাকা।
শেষ করতে চাই জনগণ কেন লকডাউন মানছেন না সে বিষয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কিছু বক্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছেন, কিছু মানুষ ভাবছে কীভাবে করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। কিছু মানুষ ভাবছে খাবার জুটবে কিনা। লকডাউনে মানুষ কর্মসংস্থান হারালে রোজগারের পথই বন্ধ হয়ে যাবে। পরিস্থিতি এমন হবে যে, খাবারের অভাবে মানুষকে মরতে হচ্ছে।
তবে শুধু খাবারের সরবরাহ নয়, নিশ্চিত করতে হবে অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ যেন আতঙ্কিত না হয় সেজন্য সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো যেতে পারে। কৃষি, শিল্প খাত ও বিভিন্ন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে কর্মীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বিশেষ নজর দিতে হবে। তবেই সচল থাকবে উৎপাদনশীলতা।