প্রতিহিংসা

ফাহমিদা খানম:

ঈর্ষা ব্যাপারটা এতো কঠিন আর কঠোর যে মানুষকে অমানুষ করতে বিন্দুমাত্র সময় নেয় না, মৃত্যু সামনে জেনেও তার ভেতরের পাশবিকতার মৃত্যু হয় না।
লকডাউনের এই সময়ে সবাই মোটামুটি ঘরে বন্দীই, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউই বের না হলেও ফ্ল্যাটের সভাপতির বউয়ের ফোনে যেতে বাধ্যই হলাম – গিয়ে দেখি ফ্ল্যাটের আরও কয়েকজন ভাবি উপস্থিত। সভাপতির ক্ষমতা, দাপট আর প্রতিপত্তি অনেক, সাথে বিত্ত – দুই পাশ নিয়ে বিশাল বাসা উনাদের — নিরাপদ দূরত্ব নিয়ে আমরা বসার পরে উনি সরাসরি বললেন,

“দেশের এই অবস্থায় যে কেউই আমরা আক্রান্ত হতে পারি, কিন্তু সেজন্য সতর্কতা নেবার পরেও আমার নীচের প্রতিবেশিনী কিন্তু কিছুই মেনে চলছেন না, জানেন কোনো খবর?”
আমরা অবাক হবার ভান করলাম মাত্র! উনি যে সেই প্রতিবেশীকে সহ্য করতে পারেন না সেটা আমরা বুঝলেও মুখের উপরে বলার সাহস পাই না।
“দুইদিন পর পর রাস্তার বিড়াল, কুকুরের জন্যে খাওয়া নিয়ে বের হয়, আমি তো বুঝি না এসব নাপাক জিনিসের জন্যে এতো মোহাব্বত কই থিকা আসে? আর গেটের দারোয়ান আর সিঁড়ি ঝাড়ু দেওয়ার বুয়াকে কি আমরা বেতন দেই না? উনি নাকি আলাদা করে খাওয়ায় – রাজ্যের আজে-বাজে লোক ফ্ল্যাটে উঠলে পরিবেশই নষ্ট হয়ে যায়, বুঝছেন আপনারা!”

“কিছু মনে করবেন না উনাকে প্রথম থেকেই আমরা এমন দেখে আসছি, হয়তো এখন সবকিছু বন্ধ বলেই বোবা প্রাণীগুলোর জন্যে খাবার দিচ্ছেন —এটাতো অন্যায় নয় আর লিফটে উঠার মুখে হাত ধোওয়া আর বাটন ধরার জন্যে কাঠি উনি নিজ থেকেই উদ্যোগ নিয়েছেন”
“রাস্তায় যখন বের হয় জীবাণু কি উনার সাথে আসতে পারে না? আর উনি এসবের ব্যবস্থা করবার কে? সভাপতি বা তার স্ত্রীর সাথে কথা না বলে এসব কে করতে বলেছে?”
“আপনি ভুল বুঝছেন, আমি তো উনার পাশেই থাকি, উনি নিজ থেকেই অনেক সাবধানে চলেন, আর উনার মধ্যে মায়া বেশি প্রথম থেকেই দেখে এসেছি- উনি ব্যাগে করে খাবার বয়ে নিয়ে বেড়ান রাস্তার অবোধ পশুদের জন্যে”
“আপনাদের নিয়ে এই এক মুশকিল – আবেগ দেখলেই ইমোশনাল হয়ে যান, কেনো বুঝতে পারছেন না এসব মেকী আর লোকদেখানো ব্যাপার! এই যে ফ্ল্যাটে কতো প্রোগ্রাম হয় উনি কয়টাতে আসেন? আর দেখেন সবার বাচ্চাদের জন্মদিন কিংবা ম্যারেজ ডেতে আমরা থাকলেও উনি কখনই সেসব করেন না আবার আসেন পর্যন্ত না, কাউকে দাওয়াত দিতেও দেখি না, যত আদিখ্যেতা ছোটলোক আর কুত্তাবিলাইয়ের জন্যেই!”

সভাপতির বউয়ের আক্ষেপটা কোথায় আমরা সবাই বুঝেও চুপ করে থাকি, কারণ উনার ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি চোখের সামনেই দেখেছি। দেড় বছর আগের কথা– বাসায় থাকা কাজের মেয়েকে প্রায়ই মারধোর করার শব্দ পেতাম, একদিন হঠাৎ করে পুলিশ এসে হাজির, শুনলাম ফ্ল্যাট থেকেই কেউ একজন ফোন করে পুলিশকে জানিয়েছিল — উনাদের ধরে নিলেও কিছুই করতে পারেনি, স্বয়ং সেই মেয়ের মা সাক্ষ্য দিয়েছিল মেয়ের হাতের এই দাগ পুরানো আর উনারা মানুষ হিসাবে খুবই ভালো। জগত এখন চলে ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আর দাপটের জোরে – বাকিরা নতজানু সেসবের কাছে। যাই হোক, সভাপতি আর তার স্ত্রীর ধারণা এই পরোপকার উনাদের নিচতলার প্রতিবেশিনী করেছেন তারপর থেকেই চলছে নিরব নির্যাতন — চিরকাল পৃথিবী যা দেখে আসছে দুর্বলের উপর সবলের আস্ফালন!

আচ্ছা ক্ষমতা থাকলে কী ন্যায় –অন্যায় বোধ হারিয়ে গিয়ে অন্যকে কষ্ট দেবার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায় কিছু মানুষ? আমরা সবই বুঝি, কিন্তু কিছু বলার সাহস পাই না – কথায় আছে না ঝিকে মেরে বউকে শেখানো! বেচারির ছাদে অনেক গাছ ছিলো – প্রথমে বলা হলো গাছ সরাতে, ছাদ নাকি ড্যাম হয়ে যায়। তারপর একদিন গাছগুলো দুমড়ে মুচড়ে পাওয়া গেলেও কেউই জানে না কে করেছে! সেদিন গাছের জন্যে বেচারির বুকফাটা আর্তনাদ আমাদের চোখে পানি এনে দিলেও ক্ষমতাবানরা অবাক হবার ভাণ করেছিল এই বলে, কার এতো সাহস হলো?

“রাস্তা দিয়ে ফকির গেলেও ব্যাগে করে খাবার দেয়, আরে আমরা কি এই সময়ে সাহায্য করছি না? অসামাজিক প্রাণী একা নিজের মতো করে থাকে, সেদিন টাকা চাইলাম পাঠিয়ে দিয়েই দায়িত্ব খালাস করলো তার কি এসে প্যাকেট করতে হেল্প করা উচিত ছিলো না?”

আমার মনে পড়ে গেলো সভাপতি আর উনার স্ত্রী শো- অফ করতে খুবই পছন্দ করেন, সবকিছু ঢোল পিটিয়ে দেখানো আর বলা উনাদের স্বভাব, মাঝেমধ্যে অবাকই লাগে উনাদের ছকের বাহিরে কেউ চলা মানেই কি মেকী?

“দুপুরবেলা যে একটু ঘুমাবো সেই উপায় নাই, বারান্দায় দুনিয়ার কাউয়া আর পাখি এসে ডাকতে থাকে – কতো আর সহ্য করা যায় আপনারাই বলুন?”
মনে পড়ে গেলো উনার বারান্দায় কাঠের তাকে পাখির জন্যে পানি আর খাওয়া দেখে আমি খুবই অবাক হইছিলাম, ভালো মানুষেরা এখন পদে পদে হেনস্থা হয় দেখেও চুপ করে থাকি, ক্ষমতার জোরের দাপট দেখি অসহায় হয়ে।

“কিছু মনে করবেন না, উনি তো কারো সাতেপাঁচে থাকেন না, আচ্ছা আমরাই না হয় উনাকে বুঝিয়ে বলবো”
সাহস করে কথাটা আমি বলেই ফেললাম।

“আপনাদের নিরাপত্তার জন্যেই আমরা ভাবছি। এছাড়া আমাদের অন্য কি সমস্যা আছে বলেন? সবার নিরাপত্তা আমাদেরকেই ভাবতে হয় কিনা!”
একজন নারীকে চিনতে আরেকজন নারীর কখনই ভুল হয় না, উনাদের ক্রোধ বুঝেও না বুঝার ভাণ করি আর কয়েকজন আছে যারা উনাদের তেলিয়ে চলতে খুবই পছন্দ করে, আমরা কয়েকজন আছি বিপদে কারণ যতটুকু বুঝেছি সে আসলে খুবই বড়ো মাপের মানুষই — একবার তার বাসায় থাকা সহকর্মীর মুখেই শুনেছিলাম রাস্তায় এক্সিডেন্ট করা কুকুরকে নিয়ে উনি হাসপাতালে নাকি গেছেন, আর বাসায় থাকা মেয়েটির পরিচয় দেন আমার সহকারি বলে – কাজের লোক বা বুয়া পর্যন্ত বলতে শুনিনি। অথচ এই মানুষটাকে পদে পদে অপমান করে পৈশাচিক আনন্দ যারা নিচ্ছে তাদের মুখে মানবতা শব্দটা বেমানান মনে হয় আমার কাছে।

যুগের হাওয়া আসলেই বদলে গেছে – এখন যার কাছে ক্ষমতা আর দাপট আছে সেই প্রভাব খাটিয়ে নিজেকে মানবতাবাদী বলতে পারে, আর যারা সেসব পারে না তাদের কাজই উল্টো হয়ে গেছে মেকী আর লোকদেখানো!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.