সাদিয়া আফরিন:
মে দিবসে লিখছি গৃহস্থালীতে নারীর শ্রম বিষয়ে।
বলবেন এ আবার কেন?
বলছি।
ছেলের সাথে মীনা কার্টুন দেখছিলাম। মীনা গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে উঠে আম পেড়ে আনলেও মা ওকে দেয় এক টুকরো, আর রাজুকে মানে মীনার ভাইকে দেয় দুই। মীনা জানতে চায় রাজু কেন বেশি পেল? পাশে বসা দাদী আর মা বললো, ‘রাজু বেশিই পাইয়া থাকে।’ মীনা ‘ও’ বলে কাজে চলে যায়।
এই কার্টুন দেখতে গিয়ে আপনাদেরও নিশ্চয়ই মীনার মতো জানতে ইচ্ছে করেছে, কেন রাজুরা বেশি পেয়ে থাকে? কারণ এ প্রশ্ন নানান সময়ে আমিও করি এবং লোকের চক্ষুশূল হই, খেতাব পাই ‘তথাকথিত নারীবাদী।’ নারীবাদী শব্দটির আগে ‘তথাকথিত’ বসালে আমি এর দুটো অর্থ করি:
১. এই তথাকথিত নারীবাদীরা আসলে নারীবাদ বুঝে না, শুধু শুধু লাফায়
২. নারীবাদটাদ কিছুনা এরা আসলে লোভী। অর্থসম্পদের লোভে লোভী।
নারীবাদীদের ‘তথাকথিত’ খেতাব দেয়া নারী/পুরুষদের আমি চিনি এবং এদের থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকি।

যাক এবার প্রসঙ্গে ফিরি। রাজুরা বেশি পেয়ে থাকে কেন? কারণ সমাজ, আইন, ধর্ম রাজুদের পক্ষে এবং শিক্ষিত, অশিক্ষিত, মূর্খ, জ্ঞানী নির্বিশেষে এর সুবিধা নেয়। কিন্তু এই যে আপনি শিক্ষিত, অফিসের বড়কর্তা, ফেসবুকে অনেক সামাজিক সমতার বড়বড় বয়ান দেন কিন্তু আপনার স্ত্রী একাএকা হেঁশেল ঠেলেন আবার বাইরেও কাজ করেন। এই গৃহবন্দীত্বের সময়ে আপনার স্ত্রী মিটিংয়ে বসছেন আবার বাচ্চা সামলাচ্ছেন, রান্না করছেন, রিপোর্ট লিখছেন, আপনাকে খেতে দিচ্ছেন এভাবে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছেন। এদিকে আপনি? তিনবেলা টেবিলে খাবার পাচ্ছেন, মিটিং সিটিং সারছেন, ফেসবুকিং করছেন, আর স্ত্রী সবজি কেটে দিতে বললে বা বাচ্চা ধরতে বললে বলছেন, ‘আমার রিপোর্ট সাবমিশন আছে। ডেডলাইন আছে।’ আর যদি ঘরের কাজ কিছু করছেনও সেটা নিয়ে ট্রল করছেন। মাননীয় পুরুষ কেন? কেন আপনি এই সুবিধা পেতে চান? ঘরের কাজকে নিয়ে ট্রল করার সাহস পান কোথা থেকে? মীনার মা-দাদী হয়তো বলবে, ‘ওরাতো এমনি সুবিধা পাইয়া থাকে।’ নিজেকে প্রশ্ন করেছেন কখনও? একবার সৎভাবে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন এটা কি একধরণের শ্রম শোষণ নয়? মে দিবসে শ্রমিকের শ্রম শোষণ ও ন্যায্য মজুরির বঞ্চনা আপনাকে কাঁদায় আর স্ত্রীর বেলায়? ভাবতে থাকুন উত্তর পেয়ে যাবেন।
সাংসারিক কাজকর্মের বিষয়ে আরেকটা ধারণাগত ত্রুটি আমার চোখে পড়ে। আমরা প্রায়ই বলি ‘আজকে আমার হাসবেন্ড সংসারের কাজে হেল্প করেছে।’ পুরুষ বন্ধুদেরও বলতে শুনি, ‘স্ত্রীকে তারা হেল্প করেন রান্নার পেঁয়াজ কেটে দিয়ে, নয়তো এঁটো বাসন মেজে দিয়ে।’ চমৎকার পারিবারিক সমতা। হয়তো বলবেন বাহ ভালো তো! এতে আবার সমস্যা কী?
ওকে বলছি কী সমস্যা। আমরা কখন বলি, প্লিজ হেল্প মি? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যখন আমার কাজটা সাধ্যের অতিরিক্ত হয়ে যায়। তাই তো! কেউ এসে তখন আমাকে হাত লাগালে আমি ভালোভাবে কাজটা শেষ করতে পারি, আমার চাপ কমে। এই যে পুরো ব্যাপারটা, এতে কে কর্তা? মানে কাজটা কার?
উত্তর হলো: আমার।
এখন প্রশ্ন করি, সংসার যদি দুজনের যৌথ খামার হয়, তাহলে কাজের ভার একা আমার উপর কেন? আমিই কর্তা কেন? স্বামী সাহায্যকারী কেন? কেন সংসারের কাজে দুজনার ভার সমান না? স্ত্রী বাইরে কাজ করলেও মূল দায়িত্ব তার ঘাড়েই কেন? এবারও মীনার মা-দাদীর উত্তর হবে, ‘স্বামীরা তো এমনেই কইরা থাকে। যতটা করে ততটাই অনেক।’
কিন্তু আমার উত্তর হলো, এটাও এক ধরনের শ্রম শোষণ। অন্যায় অন্যায়ই। এখানে বেশি বা কম অন্যায় বলে কোনকিছু নেই।
এখন আমার জিজ্ঞাসা হলো, সমান সমান হাত-পা-মাথা নিয়ে স্বামীরা এই সাহায্যকারী হয়ে আর কতদিন বেঁচে থাকবেন? মেঘে মেঘে অনেক তো বেলা হলো! স্বামীরা বাইরের কাজ যদি স্ত্রীর সাহায্য ছাড়াই করতে সমর্থ হোন, তাহলে ঘরের কাজেও তারা স্বাবলম্বী হতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
পরিশেষে বলতে চাই, ঘর-গেরস্থালির কাজ একটা বেসিক স্কিল যা সকল সুস্থ-সবল মানুষের জানা থাকা দরকার এবং এর শুরুটা ঘর থেকেই হতে হবে। প্রারম্ভিক কৈশোরকাল থেকে মেয়েদেরকে যেমন হাতেকলমে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা হয় অর্থাৎ ঘর-গেরস্থালীর কাজ শেখানো হয়, ছেলেদেরকেও তেমনি ঘরের কাজে যুক্ত করতে হবে যাতে করে ভবিষ্যতে ঘরের কাজকে স্ত্রীর কাজ মনে করে তারা হাতগুটিয়ে বসে না থাকেন অথবা স্ত্রীর সাহায্যকারী সেজে তাদের সাহায্যের ডাক আসার অপেক্ষায় না থাকেন।