শীলা মোস্তাফা:
ইত্তেফাক এর মতো একটি দায়িত্বশীল পত্রিকা কী করে করোনাকালিন বিশ্বগ্রাসী মহামারির সময় এমন একটি বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছাপালো, তা আমার মাথায় আসে না। তারপর লক্ষ্য করে দেখলাম লেখক আশরাফুল আলম খোকন, প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেসসচিব!
তো, সেই খোকনকেই বলছি, আপনার লেখার শিরোনাম “দুঃখিত ড. জাফরুল্লাহ, আপনার উদ্দেশ্য মহৎ নয়”, কিন্তু আপনার নিজের উদ্দেশ্য কী করে মহৎ, তা আমি বুঝতে পারছি না। আপনি প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেসসচিব, আর আপনিই যদি এইরকম ভুল তথ্যবহুল লেখা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেন, তাহলে সরকার যে ড. জাফরুল্লাহর করোনা সনাক্তকরণে র্যাপিড কিট ব্যবহারে টালবাহানা করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে বুঝতে পারছি।
প্রথমত আপনি লিখেছেন “ডা. জাফরুল্লাহ ভালো করেই জানেন র্যাপিড কিট ব্যবহার করে ইতালি, স্পেনের মতো দেশে করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।” ডা. জাফরুল্লাহ কী জানেন তা আমি জানি না, তবে আপনি এই বিষয় কতটুকু জানেন, তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
করোনা ইতালি এবং স্পেনে কেন এতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে সে বিষয়ে সবেমাত্র গবেষণা শুরু হয়েছে। ভয়াবহ আকার ধারণ করার পেছনে যেসব কারণ বিশেষভাবে দায়ী মনে করা হচ্ছে, তার মধ্যে আছে দেরি করে লকডাউন বা অবরুদ্ধকরণ, আক্রান্তদের সময়মতো সাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নকরণ না করতে পারা, পর্যাপ্ত পরিমাণে টেস্টিং ক্যাপাসিটি বা শনাক্তকরণ না করতে পারা, বহুল পরিমাণ বয়স্ক জনগোষ্ঠি ইত্যাদি। বয়স্ক জনগোষ্ঠি একটি বড় কারণ রোগ সংক্রমণের।

জাপানের পর ইতালিতেই সবচেয়ে বেশী বয়স্ক জনগোষ্ঠি বসবাস করে। সাধারণত জনগণের তুলনায় বয়স্ক জনগোষ্ঠির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে ভাইরাস সংক্রামিত হয়। মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে।
কোথাও ভুলে ভরা র্যাপিড কিট ব্যবহার/তড়িৎ নিরূপণ কিটকে দায়ী করা হয়নি। কোন গবেষণা থেকে আপনি এই তথ্য পেলেন যে এই তড়িৎ নিরূপণ কিট ইতালি এবং স্পেনের মহামারির জন্য দায়ী, তা সংবাদে উল্লেখ্য থাকলে ভাল হতো।
করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল/সনাক্তস্থল যাই বলি না কেন, চায়নার সেই উহান নগরীকে পৃথিবী থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে, সেখানে শুধুমাত্র উত্তর ইতালির এগারোটি শহর অবরুদ্ধ করা হয়েছে ফেব্রুয়ারির শেষে এবং সম্পূর্ণ ইতালি অবরুদ্ধ করা হয় মার্চের ৯ তারিখে। ততদিনে সংক্রমণ এতোটাই ব্যাপক আকার ধারণ করে যে আপনার ভাষায় “করোনার ভয়াবহতায় সেসব দেশের সরকার প্রধানরা অসহায় হয়ে সব ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দিয়েছেন”!
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানী, সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে একমত যে যত বেশি রোগী সনাক্ত করা হবে এবং তাদের সুস্থ মানুষের কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে চিকিৎসা দেয়া হবে, ততই এই রোগের সংক্রমণ বৃত্ত থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। কোন দেশ কীভাবে কোন পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ সনাক্ত করবে তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO (The World Health Organization) নির্ধারণ করে দেয় না। তারা কেবল তাদের সুপারিশ জানায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ আনুযায়ী ব্যাপক পরিসরে দ্রুত এবং বারংবার পরীক্ষাই রোগ নির্ণয় করা রোগের সংক্রমণ দমন করার এখন পর্যন্ত অন্যতম উপায়। যদি তাই হয় তবে ডা. জাফরুল্লাহর প্রস্তারিত “কিট” বাংলাদেশের জন্য একটি আলোকবর্তিকা। যার মূল্য তিনশত টাকার নিচে, তা যদি সহজলভ্য করা হয় এবং বার বার পরীক্ষা করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ এই বিশ্বগ্রাসী মহামারির হাত থেকে রক্ষা পেলেও পেতে পারে।
দ্বিতীয়ত আপনি লিখেছেন র্যাপিড কিট ব্যবহারে ৭০% ভুল ফলাফল আসে। এই তথ্যটিই বা আপনি কোথায় পেলেন? যে পরীক্ষা ৭০% ভুল ফলাফল দেবে এমন কোনো পরীক্ষা কি কোনদিন পৃথিবীর কোথাও ব্যবহৃত হয়? এটা কি বাংলা রচনা পরীক্ষা যে ৩৩ নম্বরে পাশ! এই নম্বর আপনি পেলেন কোথায়? তাও আমাদের মতো সাধারণ জনগণকে জানাবেন। যেহেতু এই পরীক্ষাটি রক্তের মাধ্যমে করা হয় তাই রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে ভুলভাবে “নেগেটিভ” আসতে পারে। উপসর্গ দেখা দিলে তড়িৎ নিরূপণ কিট ব্যয়ভার করে রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে।
যেদেশে স্বাস্থ্যসেবা “concept” মানে হয় ধনী হতে হবে, অথবা বিখ্যাত, উভয়ক্ষেত্রে চিকিৎসা মানে হংকং ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর গিয়ে চিকিৎসা নেয়া। ধনীদের টাকার জোরে আর খ্যতিমানরা প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পায় (যদিও টাকা যায় জনগণের তহবিল থেকে)। আর বাকি ৯৯ ভাগ জনসাধারণ এপোলো, ল্যাব এইড, আর স্কয়ারের মতো রক্তচোষা অসেবা প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি। অতএব করোনাকালিন এই সময়ে রাজনৈতিক সুবিধাভোগের হিস্যার কথা না ভেবে মানুষের কথা ভাবুন। যে দল বা গোষ্ঠীর পদলেহন করে অকারণ কালক্ষেপণ করছেন, সেই দল বা গোষ্ঠী আপনার শূন্যস্থান পূরণ করবে আপনার সমাধির মাটি শুকোনোর আগেই। কারণ নাযিম হিকমত বলেছিলেন “বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর এক বছর”। কিন্তু মনে রাখবেন করোনা কালে মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর এক দিন।
ক্যালিফোর্নিয়া
এপ্রিল ২৯, ২০২০